পানাম নগর – দ্যা সাইলেন্ট সিটি

টিউন বিভাগ ইউটিউবিং
প্রকাশিত
জোসস করেছেন

এ জগতে কতই না সভ্যতার উত্থান ঘটেছে আবার তার পতনও ঘটেছে। আবার এসব সভ্যতায় অনেক নগরীও গড়ে উঠেছিল আবার তা কালের বিবর্তে হারিয়েও গিয়েছে। তবে আমি বলতে যাচ্ছি এমন এক নগরীর সম্পর্কে যদিও তা সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে গড়ে উঠেছিল ঠিকই তবে তা কালের বিবর্তে ধ্বংস বা পরিত্যক্ত হয়ে সময়ের নীরব সাক্ষী হয়ে রয়ে গিয়েছে আমাদের বর্তমান সময়ের মাঝে। সবুজ-শ্যামলা আমাদের এই দেশে রয়েছে না কতই বিচিত্র দেখার মতো জিনিস। তবে এসব জিনিস একজনের কাছে ভালো লাগবে তো অন্যজনের কাছে বিরক্তিকর। হ্যাঁ, এটা সত্যি যে আমার যেটা ভালো লাগবে সেটা অন্যজনের কাছে ভালো নাও লাগতে পারে তবে এই বলে যে আমি অন্যজনের ভালো লাগাকে অবজ্ঞা করব তা কিন্তু নয়।

 

 

 

গত মাসের ঠিক এই তারিখে আমার সাথে ঘটেছিল এক বিচিত্র ঘটনা। এই ঘটে যাওয়া ঘটনারই বর্ণনা করছি আজ। গিয়েছিলুম বাংলার প্রাচীন রাজধানীর সোনারগাঁয়ের এক প্রাচীন নগর, আজ যা পরিত্যক্ত এবং যাকে ২০০৬ সালে বিশ্বের ১০০ টি ঐতিহাসিক ধ্বংসপ্রায় নগরীর স্থানে স্থান দেওয়া হয়েছে, সেই হারিয়ে যাওয়া নগর "পানাম নগর"। যাগ্গে এই নগরীর সম্পর্কে আজ লিখতে বসলাম, যদিও এই নগরীর সম্পর্কে আমার জ্ঞান এক্কেবারে নেই বললেই চলে তবে এই নগরের প্রতি ভালোবাসা রয়েছে প্রবল। সেই ভালোবাসার জোড়েই এই নগর সম্পর্কে কিছু হলেও লিখব, লিখব আমার কল্পনায় দেখা পানাম নগরের সাথে আমার স্বচক্ষে দেখা "পানাম সিটি"।

 

 

 

পানাম নগরী ছাড়াও সোনারগাঁয়ে আরেকটি দেখার মতো, জানার মতো স্থাপত্য রয়েছে। এমনকি যেখানে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের তৈরি জাদুঘরটিও রয়েছে। যেহেতু এটা সোনারগাঁও পানাম সিটি সিজন সেহেতু ওটা সম্পর্কে অন্য কোন দিন লেখা যাবে।

 

 

 

পানাম সিটির গেটে এসে যখন দাঁড়ালাম আমি এক্কেবারে থ হয়ে গেলাম। একতলা, দুতলা, তিনতলা বাড়িও রয়েছে। পানাম নগরে যখন প্রবেশ করলাম হঠাৎ শরীরের মধ্যি থেকে কেমন যেন ঠান্ডা জলের প্রভাব বয়ে গেল। সত্যি আমি দাঁড়িয়ে আছি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই নগরীতে। হঠাৎ যেন কল্পনার জগতে পৌঁছে গেলাম। শুনতে পাচ্ছি ঘোড়া টগবগ টগবগ আওয়াজ। দেখতে পেলাম কত লোকের সমাগম। বিচিত্র তাদের পোশাক -আশাখ। এই একবাড়িতে বিশাল আসর বসেছে তো অন্য বাড়িতে কথাবার্তা চলছে আবার কেউ কেউ তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার চারিপাশ সেই সময়কার রূপ ধারণ করেছে। আমার মন যেন দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে, একজন বলছে এই সময়টার একটা ছবি তুলে নিতে। তো অন্যজন বলছে এই সময়টা উপভোগ না করে ছবি তুলে লাভটা কি হবে? এই দণ্ড চলতে চলতে একজন বলে উঠলো, " এই ছবিটা তুলে দেনা। " এইবার আমার জ্ঞান ফিরলো। আমার পাশের একজন আরেকজনকে বলছে ছবি তুলে দিতে। তার মানে আমি এতক্ষণ কল্পনার জগতে হারিয়ে গিয়েছিলাম। কি জানি! সে যা হোক সেই সময়কার রূপ সত্যি সত্যি না দেখলেও কি হবে কল্পনাতে তো দেখেছি এই অনেক। সত্যি কথা বলতে কল্পনাতেও বা ক'জন পারে বলুন। এইসব সাত পাঁচ ভাবছি আর এক একটি বাড়ি পার করছি, হাঁটছি আর বাড়ি পার করছি। ছোটবেলায় যেন কোনো এক বইতে পড়েছিলাম পানম নগরের সম্পর্কে। সেই সময় সেই নগরের যে চিত্রটা আমি কল্পনা করেছিলাম সেই চিত্রটাই এখন ভেসে উঠেছে যেন আমার আখির সম্মুখে। পানাম নগরের পরিকল্পনা নাকি অনেক সুপরিকল্পিত ছিল। হ্যাঁ, এটা একদমই সত্যি। ঠিক ইউরোপীয় স্থাপত্য রীতিতে দু পাশে বাড়ি আর তার মধ্যিখান থেকে রাস্তা। শুনেছি পানাম নগরে প্রতিটি বাড়িতে নাকি কুপ বা কুয়ো রয়েছে। তবে ওই জিনিসটি অন্ততপক্ষে আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি। যদিও আপনাদের কেউ হয়ে থাকলে তো জানাবেন। তবে নগরীতে যে জল সরবরাহের জন্য পুকুর ছিল এটা দেখেছি। তারপর জল নিষ্কাশনের জন্য দু'পাশে খাল এবং ভূমিটা খালের দিকে যে ঢালু তা তো মশাই নিজের চোখে দেখেছি। এবার আমি পানাম নগরীর বিখ্যাত বাড়িগুলো সম্পর্কে কিছু বলি। এই বাড়িগুলো ছিল নাকি হিন্দু বণিকদের। তারাই নাকি এই নগরী স্থাপন করেছিলেন তাদের ব্যবসার স্বার্থে। সে যা হোক সে বিষয়ে আমাদের মাথা না ঘামালেও চলবে তবে পানাম নগরীর বাড়িগুলোর বেশিরভাগই কেমন যেন ছোট ছোট। অন্ততপক্ষে আমার ধারে মনে হয়েছে। মানে বর্তমান সময়ের যে বাড়িগুলো রয়েছে ওর চেয়ে তো বড় হবেই। তবে বর্তমান সময়ের স্থাপত্যের থেকে ওই সময় স্থাপত্য অনেক সুন্দর ছিল। পানাম নগরে প্রতিটি বাড়িতে দরজা জানালা বলে কিছু নেই, থাকলে সেটা একটা নিদর্শন হয়ে থাকতো। ও, হ্যাঁ, আরেকটা কথা, পানাম নগরে নাকি বর্তমানে ৫২ টি বাড়ি রয়েছে তবে আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে মাত্র ৫০টি বাড়ি। আর দুটো বাড়ি আমার স্বচক্ষে দেখা হয়নি।

 

এখানকার প্রায়শই বাড়ি ১৫ শতকের দিকে নির্মিত যা সরাসরি বারো ভূঁইয়াদের সাথে সম্পর্কযুক্ত তবে এখানকার বেশিরভাগ বাড়ি উনিশ শতকের হিন্দু ব্যবসায়ীদের দ্বারা তৈরি। এর মধ্যে একটি ভবনের (কাশীনাথ ভবন, ১৩০৫ সন) গায়ে লেখা এর তৈরি সন দেখে বোঝা যায় যে এই বাড়িগুলো অন্ততপক্ষে ১২৪ বছরের পুরনো।

 

এই যে বাড়িগুলো রয়েছে তার স্থাপত্যশৈলীতে গান্ধারা ও মোঘল স্থাপত্যের ছোঁয়া আছে তা দেখে বোঝা যায়। এই নগরীতে অনেক বিষয়ের মধ্যে একটি রয়েছে শিল্পকলা। যার অনেক নমুনা আমরা আজ আর চোখের সামনে দেখতে পাই না। তাই এই আর্টের গুরুত্বটাও আমাদের বুঝতে হবে। একে যথার্থ মূল্য দিতে হবে। এর প্রতিটি বাড়ির কারুকার্য দেখে সত্যিই মুগ্ধ হতে হয়। শৌল্পিক নিদর্শন এর প্রতিটি বাড়িতে ফুটে রয়েছে। ডাক্তারি ভাষায় একটা কথা আছে, " মানুষ মারা যাওয়াটা স্বাভাবিক কিন্তু মানুষের বেঁচে থাকাটাই আশ্চর্যের বিষয়। " ঠিক তেমনি এই বাড়িগুলো যদি এখন ভেঙে পড়ে সেটা স্বাভাবিক কিন্তু এত বছর ধরে এই বাড়িগুলো যে টিকে রয়েছে সেটাই এখন আশ্চর্যের বিষয়। আরেকটা কথা এই পানাম নগরীর ইতিহাসের দিক থেকে এর মূল্য টাকার অংকে বোঝানো সম্ভব নয়।

 

কিন্তু আমাদের দেশে এরকম অনেক মানুষ রয়েছে যাদের মতে এই নগরী শুধুমাত্র ইটের স্তুপ ছাড়া আর কিছু নয়। এরকমটা যারা মনে করে তাদেরকে একটি কথা বলে রাখতে চাই যে এই যে ইটের স্তুপ রয়েছে এটাকে যদি ইতিহাসের চোখ থেকে দেখা যায় তবে এর মূল্য সত্যিকার অর্থে বোঝা যাবে নচেৎ এটাকে ইটের স্তূপই মনে হবে। একটি দালানকে সামনে থেকে বোঝা যায় না যে এর মধ্য টা বা এর পেছনটা কি অবস্থায় আছে তেমনি ইটের স্তুপটাকে ব্যবসার দিক থেকে দেখলে হবে না একে বরং ইতিহাসের দিক থেকে দেখতে হবে।

 

 

 

আমাদের দেশে আরেকটা বিখ্যাত উক্তি আছে, "আমাদের দেশে তো ভাই আগ্রার তাজমহল নেই, চীনের মহাপ্রাচীর নেই, মিশরের পিরামিডো নেই যে আমরা গর্ব করবো। আসলে মশাই এটা আমাদের একটা রোগ যে আমাদের সম্মুখে এত কিছু থাকতে আমরা পরের জিনিসই দেখে যাবো। আমাদের তো কম ছিল না বা কম আছে তা নয় তাহলে। আজ যা সাক্ষী হয়ে আছে তার অনেকটাই আজ ধ্বংসের পথে। আবার তাজমহল, চীনের মহাপ্রাচীর, মিশরের পিরামিড সম্পর্কে যে আমরা বলি তা তাদের নিজ দেশ থেকে রক্ষণাবেক্ষিত হয়ে আসছে এবং এখনো হচ্ছে যার ফলে আজ তা তাদের দেশের জন্য গর্বের বিষয়। পুরো পৃথিবীর জন্য তা গর্বের বিষয়। কিন্তু অপরদিকে দেখুন আমরা কি এই প্রানাম সিটির মতো দুষ্প্রাপ্য নগরকে রক্ষা করছি, বরং দিন দিন সেটা তার জৌলুস হারিয়ে ফেলছে। তাহলে আমরা গর্ব করবো কি নিয়ে? আসলে কিছু পেতে গেলে কিছু দিতে হয় তাই নয় কি। ফলে এখন থেকেই আমাদের দেশবাসী ও সরকারকে এই বিষয়ে সচেতন ও এগিয়ে আসতে হবে যেন এত বছরের পুরনো স্থাপত্য যেন কালের সাক্ষী হয়ে আরো কয়েকশো বছর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে যাতে এই স্থাপত্য বিশ্বের দরবারে নিজেকে রিপ্রেজেন্টেড করতে পারে যে এককালে বাংলার রাজধানী কতটা সমৃদ্ধশালী ছিল অন্ততপক্ষে এর কারুকার্য, স্থাপত্য দিক এবং এর ঐতিহাসিক দিক থেকে বিচার করে আমাদের এটাকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে আমাদের এই কথাটির (ঘুরে এলাম সোনারগাঁও) অনেকাংশে তাৎপর্য কমে যাবে।

 

Level 0

আমি অয়োশীষ দাস। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 1 বছর 3 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 2 টি টিউন ও 0 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 1 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 1 টিউনারকে ফলো করি।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস