এক সময় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান (Big Tech) গুলোতে কাজ করা ছিল ক্যারিয়ারের শীর্ষ বিন্দু। তরুণ প্রযুক্তি কর্মীদের জন্য গুগল, ফেসবুক, অ্যামাজনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল সেই চূড়া যেখানে পৌঁছানো মানে স্বপ্নপূরণ। কাজের সুবিধাগুলো ছিল বর্ণিল: অফিসে ফ্রি খাবার, মেডিটেশন রুম, ন্যাপক্যাপ, এমনকি নিজের পোষা প্রাণী নিয়ে আসার সুযোগ। কর্মজীবন আর ব্যক্তিজীবনের ভারসাম্য যেন এই প্রতিষ্ঠানের ভিতরে খুঁজে পাওয়া যেত। প্রযুক্তি কর্মীদের জীবনকে স্বপ্নময় করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে "বিগ টেক" কোম্পানি গুলো তৈরি করেছিল এক রূপকথার পরিবেশ। কিন্তু আজ সেই রূপকথার গল্প কোথায়?
চাকরি বাজারের বর্তমান চিত্র দেখে মনে হচ্ছে, বিগ টেকে কাজ করা আর স্বপ্নের মতো নয়। বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মী ছাঁটাই করছে, এবং তাদের ছাঁটাইয়ের কারণ হিসেবে আঙুল তুলছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দিকে। তবে সত্যি কি এটাই সব? এর পেছনে আরও কি কোনো অজানা গল্প লুকিয়ে আছে?
কয়েক বছর আগেও প্রযুক্তি খাত ছিল এক বিস্ময়। ২০০৯ সালে অর্থনৈতিক মন্দার পর, বিনিয়োগ ব্যাংকিংয়ের মতো প্রতিষ্ঠিত খাতগুলো তাদের প্রভাব হারায়, কিন্তু প্রযুক্তি খাত সেই মুহূর্তে মাথা তুলে দাঁড়ায়। তখন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকাররা বলত, “এখন বিনিয়োগ ব্যাংকার হওয়া মানে Air Hostess (বিমান সেবিকা) হওয়া”—আগে সম্মান ও উচ্চ বেতন ছিল, এখন তেমন কিছুই নেই।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো তখন সুদের হার কমিয়ে দেয়, যা ব্যাংকগুলোর জন্য খারাপ হলেও প্রযুক্তি খাতের জন্য ছিল দুর্দান্ত। নতুন নতুন স্টার্টআপ তৈরি হয়, বিনিয়োগ আসে, আর কাজের সুযোগ বাড়তে থাকে। প্রযুক্তি খাতের কর্মসংস্থান তখন সাধারণ অর্থনীতির দ্বিগুণ হারে বেড়ে যাচ্ছিল। শুধু তা-ই নয়, প্রযুক্তি খাতের বেতনও প্রতিনিয়ত বাড়ছিল, যার ফলে এই খাতে কাজ করার আকর্ষণ আরো বেশি বাড়তে থাকে।
প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো শুধু বেতনের জন্য নয়, কর্মীদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্যও বিখ্যাত ছিল। গুগল, ফেসবুক, স্পটিফাই—প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কর্মপরিবেশ যেন এক ধরনের রূপকথার গল্পের মতো। তারা শুধু চাকরি দিতো না, বরং কর্মীদের জন্য এমন একটি জীবন তৈরি করত যা অন্য খাতের কর্মীরা কল্পনাও করতে পারত না।
কোনো কোনো অফিসে ছিল স্পোর্টস রুম, ন্যাপ পডস, ফ্রি লন্ড্রি সার্ভিস, এমনকি যোগব্যায়াম ও ম্যাসাজ সেশনও। কর্মীরা সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ডে ইন দ্য লাইফ’ (Day in the Life) ভিডিও Post করতেন, যেখানে তারা দেখাতেন কীভাবে অফিসে বসে তারা শুধু কাজই করেন না, বরং মজা করতেও সময় পান। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় এসব ভিডিও দেখা যায় না। এখন ‘ডে ইন দ্য লাইফ অফ আউট অফ ওয়ার্ক টেক ওয়ার্কার’ (Day in the Life of Out of Work Tech Worker) ভিডিওগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে।
২০২০ সালে করোনা মহামারি আমাদের জীবনধারা সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছিল। মানুষ ঘরে বসে কাজ করতে শিখলো, বাচ্চাদের অনলাইনে পড়াশোনা করাতে লাগলো, এবং ব্যবসায়ীরাও অনলাইনে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করতে শুরু করলেন। এই পরিবর্তনের ফলে প্রযুক্তি খাতের জন্য এক স্বর্ণযুগের সূচনা হয়েছিল। ই-কমার্সের উত্থান এবং টেকনোলজির ব্যবহারের বৃদ্ধি কোম্পানিগুলোর আয়ে ব্যাপক পরিবর্তন এনে দেয়। মেটা (Meta) তার ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি মেটাভার্সে (Metaverse) এ বিনিয়োগ করে, এবং কর্মী সংখ্যা ৬০% বাড়িয়ে দেয়। গুগল, মাইক্রোসফটসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোও কর্মী সংখ্যা বাড়িয়ে চলতে থাকে। সেই সময়ে বড় টেক কোম্পানিগুলোর সম্মিলিত কর্মী সংখ্যা ৩৫% বৃদ্ধি পায়।
কিন্তু মহামারি-পরবর্তী সময়ে, যখন অর্থনীতি কিছুটা স্থিতিশীল হয়, তখন প্রযুক্তি খাত একটি বড় ধাক্কা খায়। ২০২২ সালে শুরু হয় প্রযুক্তি শেয়ারের পতন, এবং বড় কোম্পানিগুলো বুঝতে পারে যে তারা অপ্রয়োজনীয়ভাবে অনেক বেশি কর্মী নিয়োগ দিয়েছিল। প্রথমে টুইটার ছাঁটাই শুরু করে, এবং তারপর অন্যান্য কোম্পানিগুলোও এই পথে হাঁটে। শুধু ২০২২ সালেই ১.৬৫ লাখ প্রযুক্তি কর্মী চাকরি হারায়, ২০২৩ সালে এই সংখ্যা বেড়ে ২.৬ লাখে পৌঁছে যায়, এবং ২০২৪ সালের প্রথম দিকে প্রায় ১.২৫ লাখ কর্মী ছাঁটাই হয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, প্রযুক্তি কর্মীরা কোথায় যাচ্ছেন? তারা কি নতুন চাকরি পাচ্ছেন, নাকি অন্য খাতে স্থানান্তরিত হচ্ছেন?
প্রযুক্তি খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশ কর্মীদের জন্য নতুন এক ধরনের চ্যালেঞ্জ বয়ে এনেছে। বিগ টেক কোম্পানিগুলো এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং জেনারেটিভ এআই প্রকল্পে বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ করছে। কিন্তু এই প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে কর্মীদের পুনরায় দক্ষতা অর্জন করতে হবে, যার জন্য অনেক কর্মীকে চাকরি হারিয়ে নতুন করে শিখতে হবে।
আজকের কর্মীরা যদি এআই, মেশিন লার্নিং এবং ডেটা অ্যানালাইসিসের মতো দক্ষতায় দক্ষ না হন, তবে তাদের জন্য চাকরি খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। অনেক সময় রি-স্কিলিং (Re-Skilling) প্রক্রিয়া অত্যন্ত কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ হয়ে যায়।
যদিও প্রযুক্তি খাতের অনেক কর্মী চাকরি হারাচ্ছেন, তবে টেকের বাইরে নতুন নতুন সুযোগ তৈরি হচ্ছে। আজকের দিনেও, প্রযুক্তি দক্ষতা শুধুমাত্র টেক খাতেই সীমাবদ্ধ নয়। অনেক প্রযুক্তি কর্মী এখন ফিনান্স, স্বাস্থ্যসেবা, কনসালটিং, এবং ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে কাজ খুঁজে পাচ্ছেন। এছাড়া, অনেকেই নতুন স্টার্টআপ শুরু করছেন এবং নতুন নতুন উদ্ভাবনী পণ্য বাজারে আনছেন। বিগ টেক থেকে ছাঁটাই হওয়া কর্মীরা হয়তো নতুন কিছু নিয়ে আসবেন যা ভবিষ্যতে বড় কিছু হবে।
এই পরিবর্তনশীল প্রযুক্তি বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যারা নতুন দক্ষতা শিখছেন, এবং টেক খাতের বাইরের সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন, তারা হয়তো আজকের ছাঁটাইয়ের ধাক্কা কাটিয়ে উঠবেন। প্রযুক্তি খাতের পরিবর্তনশীলতা সেই খাতের কর্মীদের জন্য নতুন সম্ভাবনার পথ খুলে দিচ্ছে।
তাহলে, প্রশ্ন থাকে—বিগ টেক কি আর স্বপ্নের কর্মক্ষেত্র নয়? সত্যি বলতে, পরিবর্তন একটি ধ্রুবক বিষয়। প্রযুক্তি খাতের এই পরিবর্তন নতুন চ্যালেঞ্জ এবং নতুন সুযোগ উন্মোচন করেছে। হয়তো এক সময়ের মতো আজ আর বিগ টেক চাকরির ক্ষেত্রে সেরা নয়, কিন্তু এর মানে এই নয় যে সুযোগ শেষ। বরং, প্রযুক্তি খাতের পরিবর্তনই কর্মীদের জন্য একটি নতুন ভবিষ্যৎ তৈরি করছে।
আজকের ছাঁটাই হওয়া কর্মীরা হয়তো আগামী দিনের নতুন কিছু নিয়ে আসবেন, ঠিক যেমন ডট-কম বাবল (Dot Com Bubble) ধ্বংসাবশেষ থেকে নতুন প্রযুক্তি কোম্পানির উত্থান হয়েছিল। তাই, হয়তো এই পরিবর্তনই আগামী দিনের বড় কিছু তৈরি করবে।
আমি রায়হান ফেরদৌস। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 11 বছর 2 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 181 টি টিউন ও 131 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 73 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 1 টিউনারকে ফলো করি।