
কখনও কি এমন হয়েছে যে ফোনের মেমোরি ফুল, তাই বাধ্য হয়ে পুরনো ছবি ডিলিট করতে হচ্ছে? কিংবা ল্যাপটপটা হঠাৎ ক্র্যাশ করল আর সাথে নিয়ে গেল আপনার বছরের পর বছরের জমানো প্রজেক্ট ফাইলগুলো? এই পরিস্থিতিগুলো কেবল বিরক্তিকরই নয়, রীতিমতো আতঙ্কের। আসলে আজকের যুগে আমাদের পুরো জীবনটাই তো তথ্যের ওপর দাঁড়িয়ে। অফিসের ফাইল, বিয়ের ভিডিও, জন্মদিনের ছবি কিংবা ব্যাংকের জরুরি নথি সবই এখন ডিজিটাল। আর এই ডিজিটাল সম্পদ যদি সঠিক উপায়ে সংরক্ষণ না করা হয়, তবে যেকোনো মুহূর্তে বড়সড় বিপদে পড়তে পারেন।
তথ্য হারিয়ে ফেলার কষ্টটা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বোঝে না। হার্ডওয়্যার ফেইলিয়র, ভাইরাস অ্যাটাক, কিংবা নিছকই অসাবধানতা কারণ যাই হোক, ফলাফল কিন্তু একটাই: আপনার মূল্যবান ডেটা গায়েব। তাই সময় থাকতেই সাবধান হওয়া জরুরি। শুধুমাত্র একটি জায়গায় সব তথ্য জমিয়ে রাখাটা বোকামি। প্রযুক্তি এখন এত এগিয়েছে যে, তথ্য সংরক্ষণের জন্য আমাদের হাতে আছে নানা অপশন। কোনটা আপনার জন্য সেরা, সেটা বুঝতেই আজকের এই আলোচনা।
চলুন, দেখে নেওয়া যাক তথ্য সংরক্ষণের ১০টি কার্যকর ও নিরাপদ উপায়।
কম্পিউটার প্রযুক্তির শুরুর দিক থেকেই হার্ড ডিস্ক ড্রাইভ বা HDD আমাদের সঙ্গী। আজও যখন আমরা বেশি পরিমাণ তথ্য কম খরচে সংরক্ষণ করতে চাই, তখন HDD-র কথা সবার আগে মাথায় আসে। এর মেকানিজমটা অনেকটা গ্রামোফোনের মতো, ভেতরে একটা চাকতি ঘোরে এবং ম্যাগনেটিক হেডের মাধ্যমে তথ্য রিড বা রাইট করা হয়।
যদি আপনার কাছে টেরাবাইট টেরাবাইট মুভি, গান বা পুরনো প্রজেক্ট ফাইল থাকে যা আপনি খুব ঘনঘন খোলেন না, তবে HDD সেরা। এর প্রধান সুবিধা হলো এর দাম। এসএসডি-র তুলনায় এর দাম অনেক কম, কিন্তু ধারণক্ষমতা অনেক বেশি।
যেহেতু এর ভেতরে যান্ত্রিক বা মুভিং পার্টস আছে, তাই হাত থেকে পড়ে গেলে বা জোরে আঘাত লাগলে এটি নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই এটি নাড়াচাড়া করার সময় একটু সাবধানে থাকতে হয়।
HDD-র দিন কি শেষ? পুরোপুরি না হলেও, সলিড স্টেট ড্রাইভ বা SSD এখন রাজত্ব করছে। এতে কোনো ঘূর্ণায়মান চাকতি নেই, পুরোটাই চিপ-ভিত্তিক মেমোরি। সহজ কথায়, এটি পেন ড্রাইভের এক বিশাল ও শক্তিশালী সংস্করণ।
কম্পিউটার চালু হতে সময় নিচ্ছে? একটা SSD লাগিয়ে দেখুন, ম্যাজিকের মতো কাজ করবে। এটি সাধারণ হার্ড ড্রাইভের চেয়ে বহুগুণ দ্রুত। আর যেহেতু এতে কোনো মুভিং পার্টস নেই, তাই এটি অনেক বেশি টেকসই। ল্যাপটপ হাত থেকে পড়ে গেলেও ভেতরের ডেটা সুরক্ষিত থাকার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
যারা ভিডিও এডিটিং, গেমিং বা ভারী সফটওয়্যার নিয়ে কাজ করেন, তাদের জন্য SSD মাস্ট। তবে মনে রাখবেন, এর দাম সাধারণ হার্ড ডিস্কের চেয়ে বেশ বেশি।
কম্পিউটারের ভেতরের স্টোরেজ ভরে গেছে? কোনো সমস্যা নেই। পোর্টেবল এক্সটার্নাল ড্রাইভ হলো আপনার ডিজিটাল ব্যাগের মতো। এটি হতে পারে HDD বা SSD প্রযুক্তির। ইউএসবি পোর্টে লাগালেই কাজ শুরু।
অনেকে তাদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের ব্যাকআপ রাখতে এটি ব্যবহার করেন। ধরুন, আপনার পিসিতে র্যানসামওয়্যার অ্যাটাক হলো, তখন এই এক্সটার্নাল ড্রাইভটিই আপনার জীবন বাঁচাবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে পরামর্শ দিই, সপ্তাহে অন্তত একবার আপনার পিসির সব জরুরি ফাইল একটি এক্সটার্নাল ড্রাইভে কপি করে রাখুন এবং কাজ শেষে ড্রাইভটি খুলে নিরাপদ জায়গায় রাখুন।
সাইজে ছোট, কিন্তু কাজের বেলায় ওস্তাদ। পেন ড্রাইভ চেনে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। চাবির রিংয়ের সাথে ঝুলিয়ে রাখা যায়, আবার পকেটেও নেওয়া যায়।
এক কম্পিউটার থেকে অন্য কম্পিউটারে ছোটখাটো ফাইল, ডকুমেন্ট বা প্রেজেন্টেশন নেওয়ার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। ইন্টারনেট নেই? সমস্যা নেই, পেন ড্রাইভ তো আছে।
খুব দীর্ঘমেয়াদী স্টোরেজের জন্য এটি খুব একটা ভরসাযোগ্য নয়। ছোট হওয়ায় এটি হারিয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। তাছাড়া ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও এতে বেশি থাকে কারণ এটি বিভিন্ন ডিভাইসে লাগানো হয়।
"ফাইলটা ক্লাউডে তুলে রাখো" এই কথাটা এখন অফিস-আদালতে খুব শোনা যায়। গুগল ড্রাইভ (Google Drive), ড্রপবক্স (Dropbox), বা ওয়ান ড্রাইভের (OneDrive) মতো সেবাগুলো আমাদের জীবনকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। এখানে আপনার ফাইল আপনার কম্পিউটারে থাকে না, থাকে কোনো এক রিমোট সার্ভারে।
সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, আপনি যেখানেই থাকুন না কেন, ইন্টারনেট থাকলেই আপনার ফাইলে প্রবেশ করতে পারবেন। ফোন হারিয়ে গেছে? ল্যাপটপ চুরি হয়েছে? কুছ পরোয়া নেহি! নতুন ডিভাইসে লগইন করলেই সব ফাইল আবার আপনার হাতের মুঠোয়।
বেশিরভাগ সার্ভিসই ফ্রিতে কিছু জায়গা দেয় (যেমন গুগল দেয় ১৫ জিবি)। এর বেশি লাগলে মাসিক বা বাৎসরিক ফি দিতে হয়। তবে ক্লাউড ব্যবহারের সময় অবশ্যই শক্তিশালী পাসওয়ার্ড এবং টু-ফ্যাক্টর অথেনটিফিকেশন (2FA) ব্যবহার করবেন।
স্মার্টফোন, ডিজিটাল ক্যামেরা বা ড্রোনের জন্য মেমোরি কার্ড অপরিহার্য। আকারে আঙুলের নখের সমান হলেও এখন ১ টেরাবাইট পর্যন্ত মেমোরি কার্ড পাওয়া যাচ্ছে।
যারা ফটোগ্রাফি করেন, তাদের কাছে এটি সোনার হরিণ। ক্যামেরা থেকে ছবি তুলে সরাসরি ল্যাপটপে নেওয়ার জন্য এটি দারুণ। আধুনিক স্মার্টফোনগুলোতে ইন্টারনাল মেমোরি ফিক্সড থাকলেও, অনেক ফোনেই এখনো মেমোরি কার্ড স্লট থাকে যা বাড়তি সুবিধা দেয়।
সস্তা বা নামহীন ব্র্যান্ডের মেমোরি কার্ড কিনবেন না। এগুলো যেকোনো সময় করাপ্ট (corrupt) হয়ে যেতে পারে। ভালো ব্র্যান্ডের ক্লাস ১০ (Class 10) বা তার উপরের গতির কার্ড ব্যবহার করা বুদ্ধিমানের কাজ।
এটা একটু টেকনিক্যাল মনে হতে পারে, কিন্তু আসলে ব্যাপারটা খুব মজার। NAS হলো আপনার ব্যক্তিগত ক্লাউড সার্ভার যা আপনার ঘরেই থাকে। এটি আপনার ওয়াইফাই রাউটারের সাথে যুক্ত থাকে।
বাসার সবাই মিলে সিনেমা দেখবেন বা ফাইল শেয়ার করবেন? NAS-এ ফাইল রাখলে বাসার যেকোনো ডিভাইস থেকে (স্মার্ট টিভি, ফোন, পিসি) সেটা অ্যাক্সেস করা যায়। ছোট অফিস বা যারা ভিডিও প্রোডাকশনের কাজ করেন, তাদের জন্য এটি দারুণ সমাধান। গুগলের সার্ভারে ফাইল না রেখে নিজের সার্ভারে রাখার আনন্দই আলাদা।
অনেকেই হয়তো বলবেন, "এগুলো তো জাদুঘরে পাঠানোর সময় হয়েছে!" কথা সত্য, কিন্তু পুরোপুরি ফেলনা নয়। সিডি বা ডিভিডি হলো 'কোল্ড স্টোরেজ'-এর জন্য চমৎকার।
একবার ডেটা রাইট (Write) করে ফেললে, সেটা আর পরিবর্তন করা যায় না (Read-only)। তাই এতে ভাইরাস ঢোকার কোনো সুযোগ নেই। আপনার বিয়ের ভিডিও বা খুব পুরনো নথিপত্র আর্কাইভিং বা দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণের জন্য ব্লু-রে ডিস্ক বা ডিভিডি এখনো বেশ কার্যকর। তবে এগুলোকে শুষ্ক ও অন্ধকার জায়গায় সংরক্ষণ করতে হয়, নইলে ফাঙ্গাস পড়ে নষ্ট হতে পারে।
খুব গুরুত্বপূর্ণ ছোট কোনো ডকুমেন্ট, যেমন পাসপোর্টের স্ক্যান কপি বা সার্টিফিকেটের ছবি এগুলো সংরক্ষণের সবচেয়ে সহজ উপায় হলো নিজেকেই ইমেইল করে রাখা।
ইমেইল ইনবক্স হলো এমন এক জায়গা যা আমরা প্রায় প্রতিদিনই চেক করি। সাবজেক্ট লাইনে ফাইলের নাম লিখে নিজেকে মেইল করে রাখলে প্রয়োজনের সময় সার্চ দিলেই পাওয়া যায়। তবে সেনসিটিভ পাসওয়ার্ড বা ব্যাংক ডিটেইলস এভাবে না রাখাই ভালো। সেগুলোর জন্য লাস্টপাস (LastPass) বা ওয়ানপাসওয়ার্ডের (1Password) মতো ডিজিটাল ভল্ট বা পাসওয়ার্ড ম্যানেজার ব্যবহার করা উচিত।
ডিজিটাল দুনিয়ায় বাস করেও কাগজের গুরুত্ব কমে নি। হ্যাকার আপনার কম্পিউটার হ্যাক করতে পারে, কিন্তু আপনার আলমারির ভেতরে রাখা ফাইল হ্যাক করতে পারবে না।
জমির দলিল, চুক্তিপত্র, সার্টিফিকেট বা উইল এই ধরনের অতি গুরুত্বপূর্ণ কাগজগুলোর ডিজিটাল কপির পাশাপাশি মূল কপি বা ফটোকপি লেমিনেটিং করে নিরাপদ জায়গায় রাখা উচিত। প্রযুক্তির ওপর ১০০ ভাগ ভরসা করাটা সবসময় ঠিক নয়। বিদ্যুৎ নেই, ইন্টারনেট নেই, ডিভাইস নষ্ট—এমন পরিস্থিতিতে কাগজই আপনার একমাত্র সম্বল।
এতগুলো উপায়ের কথা জানলেন, কিন্তু আসলে আপনার কী করা উচিত? তথ্য প্রযুক্তির বিশ্বে একটা স্বর্ণসূত্র আছে, যাকে বলা হয় '৩-২-১ ব্যাকআপ রুল'।
বিষয়টা খুব সহজ:
তথ্য হারিয়ে যাওয়ার পর আফসোস করার চেয়ে আগেভাগে সতর্ক হওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। আজই চেক করুন, আপনার গুরুত্বপূর্ণ ফাইলগুলো সুরক্ষিত আছে তো?
আমি আমির হুসেন। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 1 মাস 1 সপ্তাহ যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 2 টি টিউন ও 2 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 1 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 3 টিউনারকে ফলো করি।
বই খুব পছন্দ আমার ।