ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরা প্রকৃতির এক অনন্য দান। মানুষ যুগে যুগে খাদ্য, পানীয়, চিকিৎসা ও সৌন্দর্য চর্চায় ভেষজ উদ্ভিদ হিসাবে ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরা ব্যবহার করে আসছে। এর সরবত শরীরকে শীতল ও সুস্থ রাখে, রোগ প্রতিরোধ করে এবং ত্বকের ভেতর থেকে সৌন্দর্য বাড়ায়। অন্যদিকে রূপচর্চায় এর বহুমুখী ব্যবহার একে করে তুলেছে নারীদের বিশেষ বন্ধু। শুধু নারীদের নয়, পুরুষদের জন্যও এটি সমান কার্যকর। প্রাচীনকাল থেকেই সৌন্দর্য চর্চায় ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরার ব্যবহার প্রচলিত। মিশরের রানী ক্লিওপেট্রা নাকি নিয়মিত অ্যালোভেরা ব্যবহার করতেন সৌন্দর্য ধরে রাখার জন্য। আজও সৌন্দর্য প্রসাধনী শিল্পে অ্যালোভেরা একটি প্রধান উপাদান। তাই ঘৃতকুমারীকে বলা হয় “প্রকৃতির প্রাকৃতিক কসমেটিক”।
ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরার পরিচিতি
ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরা এক ধরনের বহুবর্ষজীবী ভেষজ উদ্ভিদ। এর বৈজ্ঞানিক নাম Aloe vera। এটি আসলে মরুভূমি অঞ্চলের উদ্ভিদ হলেও বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই জন্মে। এর পাতার ভেতরে থাকা স্বচ্ছ জেল বা রস হলো ঔষধি উপাদানে সমৃদ্ধ, যা ভিটামিন A, C, E, B-কমপ্লেক্স, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, জিঙ্কসহ প্রায় ৭৫ ধরনের পুষ্টিগুণ বহন করে।
ইতিহাসে ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরা
- প্রাচীন মিসরঃ ৪, ০০০ বছর আগে থেকে সৌন্দর্যচর্চায় ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হতো। ক্লিওপেট্রা নাকি ঘৃতকুমারীর জেল ত্বক ও চুলে ব্যবহার করতেন।
- ভারতীয় আয়ুর্বেদঃ এখানে একে “কুমারী” নামে পরিচিত। আয়ুর্বেদে বলা হয়েছে এটি দেহ শীতল রাখে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
- চীনা চিকিৎসাঃ চীনারা এটিকে প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিক ও প্রদাহনাশক হিসেবে ব্যবহার করতো।
ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরার পুষ্টিগুণ ও উপাদান
ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরার ভেতরে থাকা জেল ও ল্যাটেক্সে রয়েছে অসংখ্য স্বাস্থ্যকর উপাদানঃ
- ভিটামিনঃ ভিটামিন A, C, E, B1, B2, B6, B12, ফলিক অ্যাসিড।
- খনিজঃ ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, জিঙ্ক, আয়রন, পটাশিয়াম, সেলেনিয়াম।
- অ্যামাইনো অ্যাসিডঃ মানুষের শরীরে প্রয়োজনীয় ২২টির মধ্যে ১৮টি অ্যামাইনো অ্যাসিড ঘৃতকুমারীতে আছে।
- অ্যান্টিঅক্সিডেন্টঃ ফ্ল্যাভোনয়েড ও পলিফেনল, যা দেহকে ফ্রি-র্যাডিকেল ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে।
- এনজাইমঃ অ্যালকেলাইন ফসফাটেজ, ক্যাটালেজ, লিপেজ, সেলুলেজ ইত্যাদি।
ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরার সরবতঃ স্বাস্থ্যকর পানীয়
গরমকালে ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরার সরবত পান শরীরকে সতেজ রাখে। শুধু তাই নয়, এটি হজমে সহায়ক, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং ত্বককে ভেতর থেকে উজ্জ্বল করে।
সরবত তৈরির উপকরণঃ
- টাটকা ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরার পাতা- ১টি (মাঝারি আকারের)
- মধু বা চিনি- স্বাদ অনুযায়ী
- পানি- ১ গ্লাস
- এক চিমটি লবণ (ইচ্ছেমতো)
সরবত তৈরির পদ্ধতিঃ
প্রথমে ঘৃতকুমারীর পাতা ছাড়িয়ে ভেতরের স্বচ্ছ জেল বের করে নিতে হবে। জেল ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে, যেন হলুদাভ ল্যাটেক্স না থাকে (এটি হালকা তিক্ত স্বাদযুক্ত)। ব্লেন্ডারে জেল, পানি ও মধু একসঙ্গে মিশিয়ে নিতে হবে। ঠাণ্ডা করে পরিবেশন করতে হবে।
ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরা সরবতের উপকারিতা
- হজম শক্তি বৃদ্ধিঃ এনজাইম হজমে সাহায্য করে।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়ঃ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ভিটামিন সমৃদ্ধ।
- যকৃত পরিষ্কার রাখেঃ লিভার ডিটক্সিফাই করে।
- চর্ম সৌন্দর্য বৃদ্ধিঃ ভেতর থেকে ত্বক উজ্জ্বল করে।
- শরীর ঠাণ্ডা রাখেঃ গরমে দেহের অতিরিক্ত তাপ কমায়।
রূপচর্চায় ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরার ব্যবহার
বাজারের বহু বিউটি প্রোডাক্টের মূল উপাদান হলো ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরা।
ত্বকের যত্নঃ
- প্রাকৃতিক ময়েশ্চারাইজারঃ সরাসরি জেল মুখে লাগালে ত্বক নরম ও আর্দ্র থাকে।
- ব্রণ নিরাময় করেঃ এতে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান থাকায় ব্রণ কমায়।
- রোদে পোড়া দাগ দূরীকরণঃ সানবার্নের ক্ষেত্রে জেল লাগালে শীতলতা দেয়।
- দাগ হালকা করাঃ নিয়মিত ব্যবহার করলে ব্ল্যাক স্পট ও দাগ হালকা হয়।
চুলের যত্নঃ
- চুল পড়া রোধঃ স্ক্যাল্পে জেল লাগালে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে, চুল শক্ত হয়।
- খুশকি দূরীকরণঃ এর অ্যান্টিফাঙ্গাল গুণ খুশকি দূর করে।
- প্রাকৃতিক কন্ডিশনারঃ চুল মসৃণ ও উজ্জ্বল করে।
সৌন্দর্যচর্চার ঘরোয়া কিছু টিপসঃ
- ফেসপ্যাকঃ ঘৃতকুমারী জেল + শসার রস = উজ্জ্বল ও সতেজ ত্বক।
- হেয়ার প্যাকঃ ঘৃতকুমারী জেল + লেবুর রস + নারকেল তেল = চুল মজবুত।
- স্ক্রাবঃ ঘৃতকুমারী জেল + চিনি + লেবু = প্রাকৃতিক স্ক্রাবার।
ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরার ঔষধি গুণ
ঘৃতকুমারী শুধু সরবত ও রূপচর্চার জন্য নয়, এটি নানা রোগ নিরাময়েও কার্যকর।
- পেটের সমস্যাঃ গ্যাস্ট্রিক, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
- ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণঃ রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে সাহায্য করে।
- হৃদরোগ প্রতিরোধঃ কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইড কমায়।
- ক্ষত সারানোঃ কাটা-ছেঁড়া স্থানে জেল লাগালে দ্রুত সারে।
- প্রদাহনাশকঃ শরীরের অভ্যন্তরীণ প্রদাহ কমায়।
সতর্কতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
ঘৃতকুমারী অত্যন্ত উপকারী হলেও কিছু ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা জরুরি।
- অতিরিক্ত সেবন ক্ষতিকরঃ অতিরিক্ত খেলে ডায়রিয়া হতে পারে।
- গর্ভবতী নারীঃ সেবনের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
- অ্যালার্জিঃ কারও কারও ত্বকে সরাসরি লাগালে অ্যালার্জি হতে পারে, তাই প্রথমে অল্প করে পরীক্ষা করা উচিত।
ছাদে টবে ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরা চাষ
ছাদের টবে ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরা চাষ করা খুব সহজ এবং খরচ সাশ্রয়ী। এটি খুব বেশি যত্ন ছাড়াই বাড়তে পারে।
মাটি প্রস্তুতি
- ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরা বেলে দোআঁশ মাটিতে ভালো জন্মে।
- টবে মাটি প্রস্তুতের সময় ৫০% বালি, ৩০% দোআঁশ মাটি এবং ২০% জৈব সার মিশিয়ে নিতে হবে।
- মাটির সাথে সামান্য কাঠকয়লার গুঁড়ো বা শুকনো পাতা মিশিয়ে দিলে মাটি হালকা হয়।
টব নির্বাচন
- টব অবশ্যই গভীর ও প্রশস্ত হতে হবে, যাতে শিকড় সহজে বিস্তার করতে পারে।
- প্লাস্টিক, মাটির টব বা ড্রাম কেটে ব্যবহার করা যায়।
চারা রোপণ
- ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরার চারা সাধারণত পুরোনো গাছের গোড়া থেকে বের হওয়া শাখা দ্বারা রোপণ করা হয়।
- চারা রোপণের পর ২-৩ দিন পানি না দিয়ে রাখা উচিত, যাতে শিকড় ভালোভাবে মাটিতে বসে যায়।
পানি সেচ
- ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরা খুব বেশি পানি সহ্য করতে পারে না।
- সপ্তাহে একবার বা মাটির উপরের স্তর শুকিয়ে গেলে পানি দিতে হবে।
- টবে পানি জমে থাকলে গাছ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
আলো ও পরিবেশ
- ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরা গাছ সূর্যালোকে ভালো জন্মে।
- প্রতিদিন অন্তত ৪-৬ ঘণ্টা রোদ পাওয়া উচিত।
- ছাদে রাখলে পর্যাপ্ত রোদ পাওয়া যায়।
সার প্রয়োগ
- বছরে ২ বার জৈব সার যেমন গোবর সার, ভার্মি কম্টিউন বা পচা পাতার সার দেওয়া ভালো।
- রাসায়নিক সার ব্যবহার না করাই উত্তম।
রোগ-পোকা দমন
- ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরা তুলনামূলক কম রোগে আক্রান্ত হয়।
- পাতায় দাগ পড়লে বা পচন ধরলে আক্রান্ত অংশ কেটে ফেলতে হবে।
- জৈব কীটনাশক যেমন নিমপাতার রস ব্যবহার করা যেতে পারে।
অর্থনৈতিক দিক
বাংলাদেশে ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরার চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। প্রসাধনী কোম্পানি, ঔষধ কোম্পানি এবং পানীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এ গাছ ব্যবহার করছে। তাই বাণিজ্যিকভাবে এটি চাষ করলে কৃষকেরা লাভবান হতে পারেন।
উপসংহার
ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরা প্রকৃতির এক অনন্য দান। এর সরবত শরীরকে শীতল ও সুস্থ রাখে, রোগ প্রতিরোধ করে এবং ত্বকের ভেতর থেকে সৌন্দর্য বাড়ায়। অন্যদিকে রূপচর্চায় এর বহুমুখী ব্যবহার একে করে তুলেছে নারীদের বিশেষ বন্ধু। শুধু নারীদের নয়, পুরুষদের জন্যও এটি সমান কার্যকর। তাই ঘরে ঘরে একটি ঘৃতকুমারী গাছ থাকলেই স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্যের জন্য অনেকটাই প্রাকৃতিক সমাধান পাওয়া যায়।