বারোমাসী পেয়ারা চাষ! রেজাউলের সফলতার সোপান!

বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। এখানে কৃষকের ঘাম, মাটির উর্বরতা আর প্রকৃতির আশীর্বাদ মিলে জন্ম নেয় নানান ফসল ও ফলমূল। যুগ যুগ ধরে কৃষকরা ধান, পাট, আখ, গম কিংবা শাকসবজি চাষ করে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করেছেন। তবে বর্তমানে কৃষিতে বহুমুখীকরণ ঘটেছে। এখন কৃষকরা শুধু ধান চাষেই সীমাবদ্ধ নন, তারা ফল, সবজি, মসলা ও উচ্চমূল্যের বাজারজাতযোগ্য ফসল চাষে এগিয়ে আসছেন। এর একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার কৃষক মোঃ রেজাউল করিম, যিনি বারোমাসী পেয়ারা চাষ করে নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের পাশাপাশি এলাকার অন্যান্য কৃষকদের জন্যও এক অনন্য প্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছেন।

প্রশিক্ষণ ও উদ্যোগের সূচনা

রেজাউল করিম ছিলেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, ফটিকছড়ির “স্মলহোল্ডার এগ্রিকালচারাল কম্পিটিটিভনেস (এসএসিপি) প্রকল্প” এর আওতাভুক্ত একজন কৃষক। জুন ২০২২ সালে তিনি প্রকল্পের উদ্যোগে পেয়ারা চাষ বিষয়ে একটি প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণে তিনি আধুনিক ফল চাষ পদ্ধতি, বাগান ব্যবস্থাপনা, জৈব সার ব্যবহার, রোগবালাই দমন ও বাজারজাতকরণ কৌশল সম্পর্কে হাতে-কলমে শিক্ষা লাভ করেন।

প্রশিক্ষণ শেষে তিনি নিজের জমির ৫০ শতাংশ অংশে একটি বারোমাসী পেয়ারা প্রদর্শনী বাগান স্থাপন করেন। এ কাজে তার মোট খরচ হয় প্রায় ৭০ হাজার টাকা। এ যেন ছিল তার জীবনের এক সাহসী বিনিয়োগ, যা পরবর্তীতে তার জীবনকে আমূল বদলে দেয়।

প্রথম বছরের সাফল্য

চারা রোপণের মাত্র তিন মাসের মাথায় রেজাউল পেয়ারা বাগান থেকে ফল সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। এ যেন তার জন্য ছিল এক অপ্রত্যাশিত আনন্দ। সাধারণত ফলজ বৃক্ষ থেকে ফল পেতে কয়েক বছর সময় লাগে, কিন্তু বারোমাসী পেয়ারার বৈশিষ্ট্যের কারণে তিনি খুব অল্প সময়ে ফল সংগ্রহ শুরু করেন।

প্রথম বছরে তার বাগান থেকে তিনি প্রায় ১৫০০ কেজি পেয়ারা সংগ্রহ করেন। পাইকারি বাজারে এর দাম ছিল কেজি প্রতি ৭০ টাকা। ফলে তার মোট আয় দাঁড়ায় ১ লাখ ৫ হাজার টাকা। ব্যয় বাদ দিয়ে তার নিট লাভ হয় ৩৫ হাজার টাকা। কৃষিজীবনের অভিজ্ঞতায় এটি ছিল তার জন্য বড় একটি সাফল্য।

দ্বিতীয় বছরে দ্বিগুণ সম্ভাবনা

এক বছরের ব্যবধানে তার বাগানের গাছগুলো বড় হয়ে ওঠে, ডালপালা ছড়িয়ে পড়ে এবং গাছগুলোতে আগের তুলনায় অনেক বেশি ফল ধরে। এ বছর তিনি আশা করছেন তার বাগান থেকে প্রায় ৩ হাজার কেজি পেয়ারা সংগ্রহ করতে পারবেন। যদি বাজারে দাম আগের মতো থাকে, তবে তিনি প্রায় ২ লাখ টাকা আয় করবেন। অর্থাৎ প্রথম বছরের তুলনায় তার আয়ের অংক দাঁড়াবে প্রায় দ্বিগুণ।

কৃষিবিদদের মতে, পেয়ারা গাছ থেকে টানা ৭-৮ বছর পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। তাই রেজাউল অন্তত আগামী কয়েক বছর ধরে এই বাগান থেকে নিয়মিত আয় করতে পারবেন। এটি তারপরিবারের আর্থিক অবস্থাকে আরও স্থিতিশীল করবে।

জৈব চাষের সাফল্য

বর্তমানে ভোক্তাদের মধ্যে বিষমুক্ত ও নিরাপদ খাদ্যের চাহিদা বাড়ছে। রেজাউল করিম এ বিষয়টি মাথায় রেখে তার পেয়ারা বাগানে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সার ব্যবহার করছেন। তিনি মূলত ভার্মিকম্টিউন ও গোবর সার ব্যবহার করেন। পোকামাকড় দমনের ক্ষেত্রেও তিনি জৈব পদ্ধতি অনুসরণ করেন।

ফলস্বরূপ তার উৎপাদিত পেয়ারা শুধু সুস্বাদুই নয়, বরং সম্পূর্ণ বিষমুক্ত। বাজারে এ ধরনের পেয়ারার চাহিদা ও মূল্য সাধারণ পেয়ারার তুলনায় অনেক বেশি। এতে করে তিনি আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি ভোক্তাদের জন্যও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করছেন।

স্থানীয় কৃষকদের অনুপ্রেরণা

রেজাউলের সাফল্যের গল্প দ্রুত চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। তার বাগান দেখে এলাকার অনেক কৃষক অনুপ্রাণিত হয়েছেন। অনেকে নিজের জমিতেও পেয়ারা বাগান শুরু করেছেন। কেউ কেউ সরাসরি রেজাউলের কাছে চারা সংগ্রহ করছেন, আবার কেউ তার কাছ থেকে চাষাবাদের কৌশল শিখছেন।

এভাবে রেজাউলের উদ্যোগ স্থানীয় কৃষিতে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে শুরু করেছে। কৃষকরা বুঝতে পারছেন, শুধু ধান বা সবজি নয়, ফল চাষ করেও ভালো আয় করা সম্ভব। বিশেষ করে বারোমাসী পেয়ারার মতো ফল, যা সারা বছর পাওয়া যায় এবং বাজারে যার চাহিদা সর্বদা বিদ্যমান।

পেয়ারার পুষ্টিগুণ ও বাজার সম্ভাবনা

পেয়ারা একটি সহজপাচ্য, রুচিবর্ধক এবং পুষ্টিকর ফল। এতে ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও আয়রনসহ নানা পুষ্টি উপাদান রয়েছে। বিশেষ করে ভিটামিন সি এর আধিক্যের কারণে পেয়ারা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

বাংলাদেশের প্রতিটি জেলাই পেয়ারা চাষের জন্য উপযোগী। তাই দেশের যে কোনো প্রান্তের কৃষক চাইলে রেজাউলের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বারোমাসী পেয়ারা চাষ করতে পারেন। বর্তমানে পেয়ারা শুধু গ্রামীণ বাজারেই নয়, শহরের সুপারশপ, রেস্তোরাঁ এবং অতিথি আপ্যায়নেও ব্যবহৃত হচ্ছে। অনেকে আপেলের বিকল্প হিসেবেও পেয়ারা ব্যবহার করছেন। ফলে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে, কারণ আমদানি করা আপেলের পরিবর্তে দেশীয় পেয়ারা চাহিদা পূরণ করছে।

অর্থনৈতিক ও সামাজিক গুরুত্ব

রেজাউলের এই উদ্যোগ শুধু তার ব্যক্তিগত সাফল্যের গল্প নয়, বরং এটি দেশের কৃষি খাতের সামগ্রিক উন্নয়নের প্রতীক। যদি দেশের হাজার হাজার কৃষক এভাবে বারোমাসী পেয়ারা চাষে এগিয়ে আসেন, তবে একদিকে কৃষকের আয় বাড়বে, অন্যদিকে দেশে নিরাপদ ফলের উৎপাদন বাড়বে। একই সঙ্গে দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন সম্ভব হবে।

রেজাউল করিমের সাফল্যের শিক্ষা

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির কৃষক মোঃ রেজাউল করিমের সাফল্য আমাদের শিখিয়ে দেয় যে সাহস, পরিশ্রম ও সঠিক দিকনির্দেশনা থাকলে কৃষি খাতে অল্প পুঁজি বিনিয়োগ করেও বড় ধরনের সাফল্য অর্জন করা যায়। তার বারোমাসী পেয়ারা বাগান শুধু একটি প্রদর্শনী ক্ষেত্র নয়, বরং এটি কৃষকের স্বপ্ন, পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের প্রতীক।

বাংলাদেশের সব কৃষক যদি আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি গ্রহণ করে এভাবে উদ্যোগী হন, তবে কৃষি খাত হবে আরও শক্তিশালী এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত হবে।

Level 1

আমি ওবায়দুর রহমান। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 2 মাস 2 সপ্তাহ যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 10 টি টিউন ও 0 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।

আমি একজন ডেভেলপমেন্ট প্রফেশনাল, ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন সরকারি ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার সাথে কাজ করছি। ক্লাইমেট চেঞ্জ, অ্যাডাপ্টেশন, মিটিগেশন ও রেজিলিয়েন্স বিষয়ে আমি বিশেষজ্ঞ। পিএইচডি ডিগ্রিধারী হিসেবে গবেষণা, স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানিং, নলেজ ম্যানেজমেন্ট এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে আমার বিশেষ দক্ষতা রয়েছে।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস