সম্প্রতি তুরস্ক সিরিয়ায় ঘটে গেছে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প। ৭.৮ মাত্রার সেই ভূমিকম্পে আহত নিহত হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। হাজার হাজার ঘরবাড়ি ও অবকাঠামো মুহূর্তে ধূলিসাৎ সাথে হয়ে গেছে। যে ভবনগুলো একসময় আকাশের দিকে মাথা উঁচু করে সগৌরবে দাঁড়িয়েছিল। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে সেগুলো মাটিতে মিশে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। একটু আগেও যেখানে ছিল প্রাণের স্পন্দন কত শত মানুষের স্বপ্নের আনাগোনা সেখানে এখন মৃত্যুর হাহাকার, শিশুর কান্না, মায়ের আহাজারি, নারীর আত্মচিৎকার, পুরুষের অসহায় বোবা কান্না। শোকেরর মাধ্যমে ভারী হয়ে গেছে নীল আকাশ।
আচ্ছা এর আগেও কি এমন ভূমিকম্প হয়েছিল? নাকি এটাই প্রথম? চলুন জেনে নেই-
২০০৪ সালে ইন্দোনেশিয়া ৯.৩ মাত্রার ভূমিকম্পের কারণে কেঁপে উঠেছিল জাপান ভারত শ্রীলংকা থেকে শুরু করে আফ্রিকার উপকূল পর্যন্ত। সারা পৃথিবীটাই নাকি এক সেন্টিমিটার কেঁপে উঠেছিল। এর কেন্দ্রবিন্দু ছিল ইন্দোনেশিয়ার কাছেই সমুদ্রের ভিতরে ৩০ কিলোমিটার গভীরে। এই ভয়ানক ভূমিকম্প থেকে তৈরি ৩০ কিলোমিটার উঁচু সুনামি ভেবে সেদিন মারা গিয়েছিল দুই লাখেরও বেশি মানুষ। রাখতেই শুরু করার পরে সব ভূমিকম্প গুলোর মধ্যে ছিল এটি তৃতীয় শক্তিশালী এই ভূমিকম্প প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো মধ্যে সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক। জানতে চান ঠিক কতটা ধ্বংসাত্মক? ১৯৯৮ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত এমপি বছরের বিশ্বকাপে মারা গিয়েছে সাড়ে সাত লাখ মানুষ। যা একই সময়ে ঘটা সবগুলো প্রাকৃতিক দুর্যোগে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় অর্ধেকেরও বেশি। সম্পত্তির বিশাল ক্ষয়ক্ষত আছেই। এছাড়া সাড়ে বারো কোটি মানুষ এতে আহত এবং স্থানচুতও হয়।
পৃথিবীর এমন কোন মহাদেশ নেই সেখানে ভূমিকম্প ঘটে না। তবে তুলনামূলকভাবে কিছু অঞ্চলে মারাত্মক ভূমিকম্প গুলো বেশি হয়।
আচ্ছা আপনি কি এটা জানেন যে, কেন সে সব জায়গায় ভূমিকম্পের এত প্রকোপ? ঠিক কেন ভূমিকম্পগুলো ঘটে? ভূমিকম্প হলে কি ঘটে এবং ভূমিকম্প বিষয়ে আমাদের করণীয় কি?
শুরুতেই আসি-ভুমিকম্প কি? ভূমিকম্প হলো ভূমির কাঁপন। আমাদের পায়ের নিচের ভূমি সারাক্ষণই কম বেশি কাঁপছে। রেল লাইনে ট্রেন যাওয়ার সময় বা ভাড়ি কিছু জিনিস উঁচু থেকে পড়ার সময় মাটি কাপে। আক্ষরিক অর্থে মাটির কাপন হলেও এরা কিন্তু ভূমিকম্প নয়। ভূমিকম্প হলো বিশেষ কিছু প্রাকৃতিক কারণে ঘটা ভূমির তীব্র কাঁপন। যা বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে অনুভূত হয়। গ্রহাণু এবং ফুলকোপিন্ডের আঘাতেও ভূমিকম্প ঘটতে পারে। তবে সবচেয়ে তীব্র ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্পগুলোর কারণ ভূপাতের পাত সঞ্চালন বা প্লেট টেকটনিক।
ভূত্বকের সবচেয়ে উপরে যে লিথোস্ফিয়ার বা অশ্বমন্ডল আছে তা বেশ কয়েকটা টুকরোয় অর্থাৎ পাত বা প্লেটে বিভক্ত। আর হ্যাঁ আমাদের পায়ের নিচের আপাতো কঠিন এই মাটি বা পাতগুলো অনবরতই সরছে। বা বলতে পারেন পাত সঞ্চালনের কারণে সঞ্চালিত হচ্ছে খুব ধীরে ধীরে আমাদের আঙ্গুলের নখ যে গতিতে বাড়ে ঠিক সেই গতিতে আর সেই কারণেই আমরা সাধারণত তা বুঝতে পারি না।
এরকম দুটো পাতের মধ্যকার সীমানা বা discontinuity.কে বলা হয় ফাটল লেখা বা fault line. মোটামুটিভাবে এ লাইন বা রেখা ধরেই অনেকগুলো কম বেশি লম্বা ফাটল থাকে। পাত সঞ্চালনের কারণে পাতগুলোর ফাটলে লেখা বরাবর কোথাও কোথাও একটা আর একটা উপর উঠে যাওয়ার জন্য চাপে থাকে। আবার কোথাও আনুভূমিকভাবে পিছলে সরে যাওয়ার জন্য চাপে থাকে। শিলার ঘর্ষণ এবং ভাঙ্গন প্রতিরোধ ক্ষমতা আছে বলেই কিন্তু এই চাপের সৃষ্টি হয়। পাতের এই সঞ্চালন যেহেতু বিড়ামহীন ভাবে চলে তাই ধীরে হলেও এই চাপ ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকে। ফলে তা একসময় তা শিলার প্রতিরোধ ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। আর তখনই ভেঙ্গে যায় শিরা গুলো উঠে যায় একটা পাত আরেকটার উপর। বা পিছলে সরে যায় আনুভূমিকভাবে। আমাদের পায়ের নিচে বিশাল সব শিলাখণ্ডের এই হঠাৎ স্থান ছুটি থেকে মুক্তি পায় অনেকদিনের জমে থাকা বিশাল পরিমাণ এনার্জি বা শক্তি। ফলে কেঁপে ওঠে মাটি। ঘটে ভূমিকম্প।
এ কারণেই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি এবং বড় ভূমিকম্পগুলো ঘটে ভূত্বকের পাতগুলোর ফাটল রেখা ধরে। মিড আটলান্টিক ভূ-শিরা, আলপাইড বেল্ট বা সারকাম প্যাসিফিক বেল্ট বরাবর। সেই কারণেই আমরা আইসল্যান্ড, নেপাল, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, চিলি, আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে বড় বড় ভূমিকম্প গুলো ঘটতে দেখি। এই মুক্তিপ্রাপ্ত শক্তির উপরেই নির্ভর করে এই ভূমিকম্পটা কতটুকু গুরুতর হবে। শিলার ভাঙ্গন এবং পিছলে চাওয়াটা যতটুকু লম্বা এবং চওড়া জায়গা জুড়ে ঘটবে এবং যত বড় হবে স্থানচূতি। ততই বেশি হবে এই মুক্তিপ্রাপ্ত শক্তি। আর ততই বেশি মাত্রার এবং সুদূর প্রসারিত হবে ভূমিকম্পটি।
এখন পর্যন্ত আমাদের জানামতে ১৯৬০ সালে ঘটে সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প চিলিতে। এবং তার ভাঙ্গন ছিল ১৬০০ কিলোমিটার লম্বা আর ২৪০ কিলোমিটার চওড়া। কল্পনা করে দেখুন তো কি বিশাল পরিমাণে শক্তি মুক্তি পেতে পারে এ থেকে! তবে ভূমিকম্পের ফলে ঠিক কতটুকু ক্ষতি হবে তা তার মাত্রার উপরেই নির্ভর করে না । চিলির ভয়ানক এই ৯.৫ মাত্রার ভূমিকম্পে মারা গিয়েছিল আনুমানিক ১৬৫০ জন। অথচ ২০১৫ সালের নেপালে ঘটা ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্পে মারা গিয়েছিল প্রায় ৯০০০ মানুষ। আবার দিকে ১৯৬৪ সালে আলাস্কার ৯.২ মাত্রার ভূমিকম্পে বিশাল এক এলাকা জুড়ে ক্ষতি হলেও তত বেশি মানুষ মারা যায়নি। ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি নির্ভর করে ওই এলাকা জুড়ে জনগোষ্ঠী কতখানি প্রধানত তার ওপর।
এখন তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে ভূমিকম্প যেখানে সৃষ্টি হয় সেই epicenter বা কেন্দ্রবিন্দু থেকে কঠিন মাটি ভেদ করে সে ছড়িয়ে পড়ে কিভাবে?
একটা ফাটল রেখায় ভূমিকম্পের উৎপত্তির সঙ্গে সঙ্গে মুক্তি পাওয়া শক্তি ভূত্বকের শিলার মাধ্যমে চারদিকে ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। হ্যাঁ পানিতে একটা ঢিল করার মতই অনেকটা। তবে পানিতে এক ধরনের ঢেউই হয় যা পানিকে উঠানামা করায়। কিন্তু ভূমিতে ছড়ায় চার ধরনের ঢেউ। প্রথমটি হলো পি-ওয়েভ এই ঢেউটি শিলাকে ঝাকায় সে যে দিক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সেই বরাবর। এবং ছড়ায় সবচেয়ে দ্রুত গতীতে। দ্বিতীয় টি হল এস-ওয়েভ এখানে ডিউটি যেদিক দিয়ে এগোচ্ছে তার আড়াআড়িভাবে শীলাকে ঝাকায়। এবং তার গতি পি-ওয়েভ এর থেকে বেশ খানিকটা কম। পি এবং এস-ওয়েভ দুটোই ভূত্বকের গভীর অংশ দিয়ে ছড়ায় এবং পৌঁছায় অনেক দূর পর্যন্ত। কি এমন কি পৃথিবীর কেন্দ্রের মধ্য দিয়েও এগোতে পারে। তিন নাম্বার ওয়েভটি হলো লাভ ওয়েভ। না ভালোবাসার ঢেউ নয়। ভূমিকম্প কখনও ভালবাসার ঢেউ ছড়ায় না। অবশ্য ছড়ালেও মন্দ হতো না।
যাইহোক ঢেউটির নাম দেয়া হয়েছে ব্রিটিশ গণিতবিদ A.E.H Love এর নামে। যিনি একে প্রথম গাণিতিকভাবে প্রকাশ করেছিলেন। এই ভিডিওটি এসওএম এর মত ছড়ায় তবে মূলত ভূপৃষ্ঠেই সীমাবদ্ধ থাকে। আর চার নম্বর ঢেউটি হলো rayleigh-wave। ভূপৃষ্ঠকে দোলায় ঠিক পানির ঢেউয়ের মতো করে। ভূপৃষ্ঠকে আঁকড়ে থাকা শেষের এই দু রকমের ঢেউগুলো তুলনামূলকভাবে ধীরগতিতে ছড়ায় এবং বেশি দূর ছড়াতেও পারে না। তবে দোলনের ব্যাপ্তি অপেক্ষাকৃত বড় এবং সেজন্য এরাই সাধারণত সবচেয়ে বেশি ধ্বংস ঘটায়।
কোন একটা বড় ঘটনা ঘটলে একইরকম অন্যান্য খানিক ছোট ঘটনাও আমাদের নজরে আসতে থাকে। সিরিয়া তুরস্কের এই ভয়াবহ ভূমিকম্পের মতই খবর আসে নিউজিল্যান্ডের ভূমিকম্পের কথা। একই সঙ্গে নজর কেড়ে নেয় ইন্দোনেশিয়ার ভূমিকম্পের হতাহতার খবরও। একই সঙ্গে বাংলাদেশের কতটা ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে এ নিয়েও আছে উদ্বেগ উতকণ্ঠা। আর এসব থেকেই যেন Google trend এ উঠে আসে ভূমিকম্প শব্দটি। বিশেষ করে সবচেয়ে বেশি সার্চ হতে থাকে যে ভূমিকম্পে সুরক্ষিত থাকার উপায় কি? ভূমিকম্প হল এমন একটি দুর্যোগ যেটা আগে থেকে অনুমান করার উপায় নেই। তাই একমাত্র প্রস্তুতি এবং সতর্কতাই একমাত্র বড় হাতিয়ার।
ভূমিকম্পের সময় কি করনীয়? আমরা তা নিয়েই এখন কথা বলব।
ভূমিকম্প হচ্ছে এমনটা টের পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফাঁকা স্থানে আশ্রয় নিতে হবে। ধির স্থির ও শান্ত থাকতে হবে। বাড়ির বাহিরে থাকলে ঘরে না ঢোকাই ভালো। একতলা ভবন হলে দৌড়ে বাহিরে বেরিয়ে আসতে হবে। বহুতল ভবনের ভেতরে থাকলে টেবিল বা খাটের নিচে চলে যেতে হবে। একই জায়গায় অনেক মানুষ একসাথে না থেকে ভাগ হয়ে আশ্রয় নিতে হবে। কাচের জিনিস থেকে দূরে থাকতে হবে। ভূমিকম্পের সময় বহুতল ভবন থেকে নামার ক্ষেত্রে লিফট ব্যবহার করা যাবে না। উঁচু ভবনের জানালা বা ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নামার চেষ্টাও করা যাবে না। ভূমি ধসে পড়ার আশঙ্কা আছে এমন উঁচু জায়গা থেকে দূরে থাকতে হবে। ভূমিকম্পের সময় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন রাখতে হবে। মুঠোফোনে ফায়ার সার্ভিস ও প্রয়োজনীয় মোবাইল নম্বরগুলো আগে থেকেই সংগ্রহ রাখতে হবে। ভূমিকম্পের সময় সম্ভব হলে মাথার ওপর শক্ত করে বালিশ অথবা অন্য কোন শক্ত বস্তু যেমন কাঠবোর্ড, নরম কাপড় চোপড়ের কুণ্ডলী ধরে রাখতে হবে। ভূমিকম্পের সময় গাড়িতে থাকলে ফাঁকা কোন স্থানে চলে যেতে হয়। একবার ভূমিকম্পের পরপরই আরো ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়ে থাকে যাকে আফটার শক বলা হয়। তাই পরের কয়েক ঘন্টা সতর্ক থাকতে হবে ও নিরাপদে স্থান বেচে নিতে হবে।
written by:Md.Laisur Rahman Raz.
আমি এল আর রাজ। , Rangpur। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 1 বছর 3 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 1 টি টিউন ও 0 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 1 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 1 টিউনারকে ফলো করি।
"My name is Md.Laisur Rahman Raz and I am a junior writer for Techtunes. I am an accomplished writer, and I love to write about any subject . Currently I am studying in class VII of Cantonment Public School and College, Rangpur."