সৃষ্টির আদি লগ্ন থেকেই মানুষ রাতের আকাশে তারার দিকে তাকিয়ে থেকেছে। চন্দ্র-সূর্য ও তারকারাজি আমাদের মনে জন্ম দিয়েছে নানান সব প্রশ্নের। বিশ্ব মন্ডল সম্পর্কে জানার আগ্রহ আমাদের আজন্ম কৌতূহলের প্রধান বৈশিষ্ট্য বলা চলে। আর সে ভাবনা থেকেই মানুষ পৃথিবী থেকে চলে গিয়েছে মহাকাশে।
বর্তমানে আমরা মহাকাশ সম্পর্কে ভাবলেই আমাদের মাথায় আসে রকেটে চড়ে নভোচারীদের রোমাঞ্চকর এক যাত্রা। কিন্তু মানবজাতির মহাকাশ জয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল মনুষ্যবিহীন কিছু ছোট ছোট যন্ত্র মহাকাশে প্রেরণ করার মধ্য দিয়ে। মহাকাশে পাঠানো এসব যন্ত্র গুলোকেই স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ বলা হয়।
স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ ছাড়া আধুনিক পৃথিবী কল্পনাই করা যায় না। প্রতিদিন প্রায় হাজার হাজার স্যাটেলাইট পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে আমাদেরকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও সেবা প্রদান করছে। বন্ধুরা আজকের এই টিউনর মাধ্যমে আমরা জানবো যে, কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইট সম্পর্ক। তবে টিউনটি শুরু করার আগে আমি আপনাকে অনুরোধ করবো, আপনি যদি আমার এই টিউনে নতুন হয়ে থাকেন, তাহলে আমাকে ফলো করে রাখবেন।
আমরা আমাদের নিজেদের অজান্তেই স্যাটেলাইট এর উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। কৃত্রিম উপগ্রহ আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণ করছে। বিভিন্ন ধরনের স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতেই আমরা আমাদের জীবনকে এমনভাবে উন্নত করতে পেরেছি, যা অতীতের কোনো মানবসভ্যতা কল্পনাও করতে পারেনি। তাই, নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এই মুহূর্তে আপনি কোন না কোনভাবে স্যাটেলাইট এর আওতায় রয়েছেন।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনের টেলিভিশন দেখা থেকে শুরু করে, স্মার্টফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার সবই চলছে স্যাটেলাইট এর উপর ভিত্তি করে। আমরা দৈনন্দিন জীবনের স্যাটেলাইট এর ওপর নির্ভর করলেও এটি নিয়মিত করতে এমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। কেননা আমরা তখন ভাবি না যে, আমরা মূলত কিসের মাধ্যমে সেই সেবাটি পাচ্ছি। কিন্তু তবুও তো আমাদেরকে প্রতিদিনই কৃত্রিম উপগ্রহের ওপর নির্ভরতা করতেই হয়।
কোন একটি বস্তু আর একটি বস্তুকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করলে তাকে স্যাটেলাইট বলা হয়। যেমন চাঁদ আমাদের পৃথিবীকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করে, তাই চাঁদ হলো আমাদের পৃথিবীর প্রাকৃতিক স্যাটেলাইট বা উপগ্রহ। গণিত ও পদার্থবিদ্যার উৎকর্ষতা কে কাজে লাগিয়ে মানুষ কৃত্রিম ভাবে এমন কিছু উপগ্রহ তৈরি করে মহাকাশে প্রেরণ করেছে, যা চাঁদের মতই নিরবচ্ছিন্ন-ভাবে আমাদের পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে। যেহেতু মহাকাশে কোন বাতাস নেই, তাই কৃত্রিম উপগ্রহ বাধাহীনভাবে মহাকাশে পরিক্রমণ করতে পারে।
পৃথিবীকে কেন্দ্র করে প্রায় কয়েক হাজার স্যাটেলাইট ঘুরতে থাকলেও এদেরকে খালি চোখে দেখা যায় না। স্যাটেলাইটের বহুবিধ ব্যবহারের মধ্যে অন্যতম কাজ হল পৃথিবীতে পর্যবেক্ষণ করা। মহাকাশ থেকে কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে পৃথিবীর প্রতিটি ইঞ্চি পরিমাণ জায়গা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হয়। আর এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে দিন-রাত ২৪ ঘন্টা।
মহাকাশে সোভিয়েত ইউনিয়ন সর্ব প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ প্রেরণ করে। ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর স্পুটনিক-১ নামের কৃত্রিম উপগ্রহ টি মহাকাশে প্রেরিত মনুষ্য নির্মিত প্রথম কোন বস্তু। স্পুটনিক-১ উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে মানবজাতির মহাকাশ যাত্রা শুরু হয়েছিল। স্পুটনিক-১ কৃত্রিম উপগ্রহটির নকশা করেছিলেন ইউক্রেনের বিজ্ঞানী সের্গেই করোলেভ। একই বছর সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাকাশে দ্বিতীয় কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক-২ উৎক্ষেপণ করে।
স্পুটনিক-২ Laika নামের একটি কুকুরকে বহন করে প্রথমবারের মতো পৃথিবীর কোন প্রাণীকে পৃথিবীর বাইরে নিয়ে যায়। যদিও সে যাত্রায় যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে কুকুর টি মারা যায়। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৫ সাল থেকে মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠানোর পরিকল্পনা করলেও তাদের পরিকল্পনা সফল হয় ১৯৫৮ সালে। জুনো-১ নামের একটি রকেট এর মাধ্যমে ১৯৫৮ সালের ৩১ জানুয়ারি আমেরিকানরা মহাকাশে পাঠায় এক্সপ্লোরার-১ নামের কৃত্রিম উপগ্রহ। এরপর থেকে বহু দেশ প্রতিনিয়ত মহাকাশের এই যাত্রায় নিজেদের নাম লিখিয়ে যাচ্ছে।
ভারত ১৯৮০ সালে রোহিনী নামের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ প্রেরণ করে। আমাদের দেশ বাংলাদেশ ও ২০১৮ সালে Bangabandhu-1 নামে নিজেদের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে পাঠিয়েছে।
কৃত্রিম উপগ্রহ গুলো আমাদের পৃথিবীর মতো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যেমন আমরা নিজেদেরকে দেখি, ঠিক তেমনিভাবে কৃত্রিম উপগ্রহ আমাদের পৃথিবীর সম্পর্কে অতি নিখুঁত বর্ণনা প্রদান করে। গঠন কাজের ধরন ও অবস্থান অনুযায়ী স্যাটেলাইট বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। পৃথিবী থেকে স্যাটেলাইটের অবস্থান এর দূরত্বের বিচারে স্যাটেলাইট তিন ধরনের হয়ে থাকে। যেমন LEO বা Low Earth Orbit, MEO বা Medium Earth Orbit এবং GEO বা Geostationary Earth Orbit।
LEO বা Low Earth Orbit থাকা স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবীর খুব কাছে অবস্থান করে এবং মাত্র দেড় ঘণ্টায় পুরো পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে পারে। MEO বা Medium Earth Orbit থাকা স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবী থেকে বেশ খানিকটা দূরে থাকে এবং একবার পুরো পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে সময় নেয় দুই থেকে আট ঘণ্টা।
পৃথিবী থেকে সবচেয়ে দূরের স্যাটেলাইট স্তর হলো GEO বা Geostationary Earth Orbit। এই স্তরে থাকা কৃত্রিম উপগ্রহ পৃথিবীর সাথে সাথে ঘুরতে থাকে এবং এদের ঘূর্ণন গতি পৃথিবীর ঘূর্ণন গতির সমান। অর্থাৎ, এরা ২৪ ঘন্টায় পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করে। একটি স্যাটেলাইট পৃথিবীর যে পরিমাণ অংশে তার তথ্য আদান-প্রদান করতে পারে, তাকে সেই স্যাটেলাইটের ফুটপৃন্ট বলা হয়।
GEO বা Geostationary Earth Orbit স্টেশনারি স্যাটেলাইট এর ফুটপৃন্ট সবচেয়ে বেশি। এসব স্যাটেলাইট সাধারণত পৃথিবীর আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ এবং টেলিভিশন সম্প্রচার এর কাজে ব্যবহৃত হয়। ১৯৬০ সালে Tiros-1 নামের স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সর্বপ্রথম টেলিভিশনে পৃথিবীর আবহাওয়ার চিত্র প্রকাশ করা হয়।
স্যাটেলাইট পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে এবং এসব তথ্য পৃথিবীতে থাকা সুপার কম্পিউটারের সাহায্যে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্যে পৃথিবীকে সব সময় প্রদক্ষিণ করার উদ্দেশ্য শুধু আগামীকালের আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া নয়, এই সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ এর ফলে পৃথিবী সহ সমগ্র মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমরা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন তথ্য পাচ্ছি।
এর মধ্যে স্যাটেলাইট ভিত্তিক গুরুত্বপূর্ণ একটি সেবা হল জিপিএস বা গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম। যেখানে আজকাল আমাদের সবার স্মার্টফোনেই জিপিএস ব্যবস্থা রয়েছে, এবং এর সাহায্যে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে থাকা কাঙ্ক্ষিত স্থানের যথাযথ অবস্থান নির্ণয় করা যায়। স্যাটেলাইট ব্যবহার করার মাধ্যমে জিপিএসের সাহায্যে বিমান এবং সমুদ্রগামী জাহাজ গুলো তাদের গতিপথ নির্ণয় করা হয়।
কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে পৃথিবীর চাষাবাদ ও পর্যবেক্ষণ করা যায় অত্যন্ত নিখুঁতভাবে। স্যাটেলাইট এর সাহায্যে কোন অঞ্চলের মাটির শুষ্ক আর কোন অঞ্চলের মাটির আর্দ্র, সেটি খুব সহজেই বোঝা যায়। এমনকি কোন অঞ্চলে চাষাবাদ করতে কি ধরনের সার ব্যবহার করতে হবে এবং কখন ফসল ঘরে তোলার উপযোগী হবে, আজ কাল তাও জানা যাচ্ছে কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্যে। স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ব্যবহার করে চাষাবাদের এই পদ্ধতিকে বলা হচ্ছে, নির্ভুল কৃষি ব্যবস্থা।
পৃথিবীর জীব-বৈচিত্র্য, বনাঞ্চল ও মেরু অঞ্চলের বরফ পর্যবেক্ষণ করার কাজেও কৃত্রিম উপগ্রহ ব্যবহৃত হচ্ছে। এ সমস্ত প্রাকৃতিক অঞ্চল আমাদের পৃথিবীর আবহাওয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তাই আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ এর সাথে সাথে বিশ্ব উষ্ণায়নের উপর নজরদারি করাও স্যাটেলাইটের নিয়মিত কাজ।
এছাড়া বিভিন্ন দেশের সরকারি গোয়েন্দা কাজের জন্য নিয়োজিত রয়েছে বেশকিছু স্যাটেলাইট। বর্তমানে পৃথিবীতে কেন্দ্র করে প্রায় ৫০০০ স্যাটেলাইট ঘুরছে। তবে সেসবের মধ্যে কার্যকর রয়েছে মাত্র ২০০০ এর ও কম স্যাটেলাইট। বাকি স্যাটেলাইটগুলো তাদের কার্যকারিতা হারিয়ে মহাকাশ বর্জ্য হিসেবে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে। আর দিন দিন মহাকাশে এসব অকার্য স্যাটেলাইটের বর্জ্য বেড়েই চলেছে।
মহাকাশে আমাদের পৃথিবীতে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকা আর একটি বিশেষ ধরনের কৃত্রিম উপগ্রহ হল আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন। এটিই একমাত্র কৃত্রিম উপগ্রহ যেখানে বিগত দুই দশক ধরে নিয়মিত ভাবে মানুষ বসবাস করে আসছে। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন নিয়ে আমার পূর্বের একটি টিউন রয়েছে। পৃথিবীর বাইরে মনুষ্যনির্মিত সবচেয়ে বড় স্থাপনা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে আমার পূর্বের এই টিউনটি দেখুন। আর আপনি যদি আমার এই টিউনে নতুন হয়ে থাকেন, তবে আমাদের অন্যান্য টিউন গুলো দেখতে পারেন।
কৃত্রিম উপগ্রহ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মানকে অনেকাংশেই পরিবর্তন করেছে। যেখানে মানুষ নিজের অবস্থান জানা থেকে শুরু করে আবহাওয়ার তথ্য পাচ্ছে নিমিষের মধ্যেই। তো বন্ধুরা, আজ এই পর্যন্ত বলেই শেষ করছি। আসসালামু আলাইকুম।
আমি মো আতিকুর ইসলাম। কন্টেন্ট রাইটার, টেল টেক আইটি, গাইবান্ধা। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 3 বছর 11 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 379 টি টিউন ও 93 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 62 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 3 টিউনারকে ফলো করি।
“আল্লাহর ভয়ে তুমি যা কিছু ছেড়ে দিবে, আল্লাহ্ তোমাকে তার চেয়ে উত্তম কিছু অবশ্যই দান করবেন।” —হযরত মোহাম্মদ (সঃ)