অন্ধকারও আলো – DARK & LIGHT

প্রথম প্রকাশঃ SciencewithQuran.com

 

১৫:১৪ যদি আমি ওদের সামনে আকাশের কোন দরজাও খুলে দেই আর তাতে ওরা দিনভর আরোহণ ও করতে থাকে।            সূরা  হিজর

لَقَالُواْ إِنَّمَا سُكِّرَتْ أَبْصَارُنَا بَلْ نَحْنُ قَوْمٌ مَّسْحُورُونَ

১৫:১৫ তবুও ওরা একথাই বলবে যে, আমাদের দৃষ্টির বিভ্রাট ঘটানো হয়েছে না বরং আমরা যাদুগ্রস্ত হয়ে পড়েছি।

وَلَقَدْ جَعَلْنَا فِي السَّمَاء بُرُوجًا وَزَيَّنَّاهَا لِلنَّاظِرِينَ

১৫:১৬ নিশ্চয় আমি আকাশে রাশিচক্র সৃষ্টি করেছি এবং তাকে দর্শকদের জন্যে সুশোভিত করে দিয়েছি

সূধী পাঠক উপরের আয়াত ক’টিতে মহান আল্লাহ এক বিষ্ময় কর বর্ণনা দিয়েছেন, পরিস্কার বলা হয়েছে মানুষকে যদি মহাকাশে আরোহনের সুযোগ দেওয়া হয় আর সে দিন ভর আরোহন করতে থাকে তবে বিষ্ময় তাকে অবিভূত করে তুলবে। তার চোখে দৃশ্য ঘটনাগুলো তাকে মোহগ্রস্থ করে তুলবে, মনে হবে সে যাদু গ্রস্থ হয়ে পড়েছে। দৃশ্যত আয়াতগুলো মহাবিশ্বের বিশ্বয়কর সৃষ্টি লহরীর বর্ণনা যে গুলোকে মানুষ পৃথিবী থেকে পরিপূর্ণভাবে উপলব্দি করতে পারছেনা, এ সকল দৃশ্য উপলব্দি করতে হলে মানুষকে মহাকাশে আরোহন করতে হবে। প্রচলিত তরজমায় ‘দিনভর’ শব্দটি  বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। আয়াত ১৫:১৪ তে ব্যবহৃত শব্দ فَظَلُّواْ তরজমা করা হয়েছে দিনভর। প্রকৃতপক্ষে শব্দটির সাথে দিন শব্দের বিশেষ কোন ষম্পর্ক দেখা যায়না। এখানে فَ সংযোজক কারী অব্যয় যার অর্থ  এবং; ظَلُّوا একটি পূরা ঘটিত ক্রিয়া অর্থ কোন কাজ চলমান থাকা,।   আরও একটি বিষ্ময়কর ইঙ্গিত দান করা হয়েছে, وا একটি সর্বনাম, আয়াতে ‘তাহারা’। আর কাজটি হল يَعْرُجُ -আরোহন। পরবর্তী আয়াতে দৃষ্টির বিভ্রাটের কথা বলা হয়েছে। এখানে একটা বিষয় পরিস্কার যে, আয়াত গুলোতে দৃষ্টিলভ্য বস্তুর বৈচিত্রতা বুঝানো হয়েছে, যে বৈচিত্রতা বিষ্ময়কর এবং মানুষকে মোহগ্রস্থ করে তুলতে পারে।

সূধী পাঠক, আয়াতের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আমাদের প্রতিপাদ্য বিষয় নয়, আমরা এই আয়াতের মধ্যে মহাবিশ্বের আলোকীয় অবস্থার খোঁজ করছি! আধুনীক বিজ্ঞানের কাছ থেকে আমরা জানি কোন কিছুর দৃষ্টিলভ্যতার সাথে আলোকীয় অবস্থার সম্পর্ক থাকে। অর্থাৎ কোন আলোক উৎস থেকে আলো এসে সরাসরি চোখে পড়লে আমরা তাকে দেখতে পাই, আবার সেই আলোকীয় বস্তুর বিচ্ছুরিত আলো কোন তল থেকে প্রতিফলিত হয়ে যদি তা সেই বস্তুর কোন প্রতিবিম্ব তৈরী করে তবে আমরা সেই উৎসের প্রতিবিম্ব দেখতে পাই। এই দৃষ্টি লভ্যতার সাথে মাধ্যামের একটা সম্পর্ক রয়েছে। যদি মাধ্যামটি নিজেও আলোকময় হয় এবং তার উজ্জ্বলতা সেই উৎসের চেয়ে বেশী হয় তবে সেই উৎসটিকে স্বাভাবিক অবস্থায় আমরা দেখতে পাইনা। আর যদি মাধ্যামের উজ্জ্বলতা কম হয় তবে তা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। আর সে কারণেই আমরা আকাশের মিটি মিটি তারগুলোকে দিনের বেলা দেখতে পাইনা কিন্তু রাতে তারা উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠে। তখন আমরা সেই বিষ্ময়কর সৃষ্টি লহরীর কিছুটা দেখতে পাই। এই দৃষ্টি গোচরতা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে আমরা যখন পৃথিবী ছেড়ে মহাকাশের দিকে যাত্রা করি; ক্রমশঃ যেতে যেতে আমরা যখন পৃথিবীর বায়ু মণ্ডল থেকে আরও দূরে চলে যাই তখন মহাশূণ্যের আসল রূপ চোখে পরে; দেখা গেছে সেখানে চারিদিকে বিদঘুটে অন্ধকার আর সেই অন্ধকার রাজ্যে ভাসমান জ্বজ্বলে তারকারা আকাশের বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে। অথচ পৃথিবীর বুক তখন দিবালোকে উজ্ঝ্বল। বিষয়টা সম্পূর্ণই তাত্ত্বিক নয় পুরোটাই বাস্তবতা। তার প্রমাণ মহাশূণ্যচারীদের অবিজ্ঞতা ও তাদের পাঠানে ছবি।

 

 

 

 

উপরের ছবিটি মহাশূণ্য থেকে তোলা  পৃথিবীর ছবি

 

 

উপরের ছবিটি পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে চাঁদের ছবি

এখন প্রশ্ন হল, তাহলে আলো কি, আমাদের চোখের সামনে এই জ্বলজ্বলে অবস্থা বলতে কি বুঝায়? সূধী পাঠক, বিজ্ঞান বলছে, আলো হল এক প্রকার তড়িৎচুম্বক তরঙ্গ, যে কোন আলোক উৎস থেকে এই তরঙ্গ চারিদিকের মাধ্যামে ছড়িয়ে পড়ে; এই তরঙ্গকে চোখে দেখা যায়না, এই তরঙ্গের মধ্যে অতি ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ তরঙ্গ দৈর্ঘের আলোও রয়েছে। এদের কোনটাকেই চোখে দেখা যায়না; এ কারণেই মহাশূণ্যে অগণিত আলোর উৎস থাকা সত্যেও মহাশূণ্য ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিমজ্জিত; তবে কিছু সুনির্দিষ্ট তরঙ্গ দৈর্ঘের আলো ‘বিশেষ’ অবস্থায় আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। আমরা অতি আধুনীক বিজ্ঞানের কল্যানে জানতে পেরেছি যে,ঐ নির্দিষ্ট তরঙ্গ দৈর্ঘের আলো যখন আমাদের বায়ুমণ্ডলের ধূলিবালির উপর আপতিত হয় তখন তা প্রতিফলিত হয়ে দৃশ্য আলোর সৃষ্টি করে যা আমাদের গোচরীভূত হয়। মহাকাশের বিভিন্ন স্থানে যেখানে মহাজাগতিক ধূলিমেঘ রয়েছে যেখানেও বিচিত্র বর্ণালীর সৃষ্টি করে যার ফলে আমরা আকাশের বুকে ভাসমান নিহারীকা ও ধুমকেতু দেখতে পাই, আসলে তারা কোন আলোর উৎস নয়। এরাও মহাজাগতিক ধূলি মেঘ থেকে তৈরী। যেহেতু আমাদের চারিদিকে ধূলিবালিময় বায়ুমণ্ডলের উচ্চতা প্রায় ২০০ মাইল ফলে সূর্যালোকের দৃশ্য অবস্থা ঐ পর্যোন্তই বিস্তৃত; আমাদের সৌরমণ্ডলের পরিসরে এই পুরুত্বকে অতি পাতলা এক স্তরের সাথে তুলনা করা যায়। সকল মহাজাগতিক বস্তুর বেলাতেই একই নিয়ম প্রচলিত অর্থাৎ মহাজাগতিক বস্তুগুলো যেহেতু নিহারীকা বা মহাজাগতিক ধূলিমেঘ থেকে উৎপন্ন তাই তার পরিমণ্ডলে যে ধুলিমেঘের স্তর থাকে তাকেই আমরা এমন ঝল ঝল করে জ্বলতে দেখি।

বিজ্ঞান বলছে, আমাদের সৌর মণ্ডলে একমাত্র আলোর উৎস হল সূর্যো মামা, এই উৎসটি থেকে বিচ্ছুরিত তড়িৎচুম্বক তরঙ্গ একটা বিস্তৃত অঞ্চল যাকে বলা হয় সৌরমণ্ডল তাকে আলোকিত করে।উপরের আলোচনা থেকে জানাগেল যে এই পুরো সৌর মণ্ডলটাই আলোকিত হয়না, শুধুমাত্র মহাজাগতিক বস্তুগুলো তথা আমাদের এই অঞ্চলের গ্রহ-উপগ্রহ ও ধুমকেতুগুলোর পরিমণ্ডলকে আলোকিত করে এবং সৌর মণ্ডলেরই বাকি শূণ্যস্থান গুলো অন্ধকারেই থেকে যায়। এভাবে বিবেচনা করলে দেখা যায় আমাদের মহাবিশ্বের স্থানে স্থানে সজ্জিত মহাকাশীয় বস্তুগলোর পরিমণ্ডলই শুধু আলোকিত স্থান আর বাকী শূণ্য স্থানগুলো কেবলই অন্ধকারের রাজত্ব। বিজ্ঞান আরও বলছে যে সূর্যের আলোক তরঙ্গ আমাদের বায়ু মণ্ডলকে আলোকিত করছে তার নিজের বক্ষটিও অন্ধকারে নিমজ্জিত। এই তরঙ্গ সূর্যের বহিঃস্তরে মহাজাগতিক ধূলি মেঘের উপর প্রতিফলিত হয়ে উজ্জল আলোর সৃষ্টি করে ফলে তাকে আমরা এত উজ্জ্বল দেখতে পাই। আমাদের এই বিশাল আয়তনের মহাবিশ্বের তুলনায় আলোকিত স্থান নিতান্ত ণগন্য। অর্থাৎ মহান প্রভুর এই মহাসৃষ্টি এক এক অন্ধকার সাম্রাজ্য; তিঁনি তাঁর আদরের সৃষ্টি এই মানবকুলের দৃষ্টিলভ্যতার জন্যে যৎসামান্য আলোক উৎসের ব্যাবস্থা করেছেন যা তারা নয়ন ভরে দেখতে পায় আর মহান স্রষ্টার কাছে অবনত মস্তকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।

সূধী পাঠক,আমাদের এই আলোচনা থেকে একটা বিষয় পরিস্কার যে,বিজ্ঞানের ভাষায় সেই মহাবিস্ফোরন থেকে সৃষ্ট মহাবিশ্ব ছিল এক অন্ধকার সাম্রাজ্য। এই সাম্রাজ্যটি তার জন্ম বৈশিষ্ট অনুযায়ী যদি সমগ্রটা অন্ধকারেই থেকে যেত  তবে সমস্যা কোথায় ছিল; হয়তো বলবেন,তা প্রাণীকুলের প্রয়োজনেই সৃষ্টি হয়েছে। ধরে নিলাম আপনার কথাই সত্য,তাহলে একটা নতুন ভাবনার উদয় হয়, তাহল- বিজ্ঞান বলছে প্রাণী সৃষ্টি হয়েছে মহাবিশ্ব সৃষ্টির ৫-৬ শত কোটি বছর পরে; কিন্তু আলোকময় বস্তুগুলোর সৃষ্টি হয়েছে প্রাণ সৃষ্টির বহু পূর্বে। এবার হয়তো বলবেন, এটা বিবর্তনের ধারায় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে তারপরে পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে। অতি সঠিক কথা, বিবর্তনের ধারায়ই পৃথিবীতে এক সময় প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে, তারই এক পর্যায়ে মানুষ প্রজাতির অভূদ্বয় ঘটেছে যারা জ্ঞান বিজ্ঞানে উন্নত হয়ে মহাসৃষ্টির এই অপরূপ সৌন্দর্যের লহরী অবলোকন করতে পারে। আমাদের এই আলোচনাটুকু থেকে দু’টি বিষয় প্রতিভাত হয় ১.এই আলোকিত মহাজাগতিক বস্তুগুলো আলোকিত হয়েছে মানুস নামক বুদ্ধিমান প্রাণীগুলোর অবলোকন ও চিন্তাভাবনা করার জন্যে; ২.অথবা অন্য কোন লক্ষ্যে যা মানুষ আজও জানতে পারেনি, তাই যতদিননা মানুষ অন্য লক্ষ্যের কারণ খুঁজে না পাবে ততদিন অন্তত ধরে নেওয়া যায় যে এই নিরস্তর সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়েছে মানুষের চিন্তাভাবনার জন্যে। এই ধারনাটুকু যদি আমাদের মনপুতঃ হয়ে থাকে তবে নিঃসঙ্কোচে একটা কথা বলা যায় যে, এই বিবর্তন একটা সুচিন্তিত পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে হয়েছে! আর যদি তাই হয়ে থাকে তবে অবশ্যই তার একজন পরিকল্পনাকারী রয়েছে যিঁনি তাঁর মেধা ও দক্ষতা দিয়ে এই মহাসৃষ্টির পূর্বেই পরিকল্পনা করেনিয়েছেন আর সেই অনুযায়ী বিবর্তন ঘটছে,অর্থাৎ এ বিবর্তন বস্তুবাদের স্বতস্ফূর্ত বিবর্তন নয়। সম্ভবত মানুষের মনে এমনই কিছু ধারনা সৃষ্টির লক্ষ্যে মহান আল্লাহ ১৫:১৪-১৫ আয়াতের অবতারনা করেছেন।

الْحَمْدُ لِلّهِ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ وَجَعَلَ الظُّلُمَاتِ وَالنُّورَ ثُمَّ الَّذِينَ كَفَرُواْ بِرَبِّهِم يَعْدِلُونَ

৬:১ সর্ববিধ প্রশংসা আল্লাহরই জন্য যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন এবং অন্ধকার ও আলোর উদ্ভব করেছেন। তথাপি কাফেররা স্বীয় পালনকর্তার সাথে অন্যান্যকে সমতুল্য স্থির করে।     সূরা আল আন আম

সূধী পাঠক, লক্ষ্য করুন ক বিষ্ময়কর বাণীর অবতারনা করা হয়েছে উপরের আয়াতে; মহান আল্লাহ পরিস্কার ভাষায় বলছেন তিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি করেছেন আরও অভূদ্বয় ঘটিয়েছেন অন্ধকার ও আলোর। একটা সহজ বর্ণনা। বিষ্ময়ের কিছু নেই; এমনটা যে কোন জ্ঞানী লোকই দিবা রাতের দৃশ্য দেখে বলতে পারেন। কিন্তু এখানে যে বিষ্ময়টি লুকিয়ে রয়েছে তা হল শাব্দিক অবস্থান। বলা হয়েছে ‘এবং অন্ধকার ও আলোর উদ্ভব করেছেন’, সৃষ্টি করেননি; আরও লক্ষ্য করুন বলা হয়েছে নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি করা হয়েছে; আবার  প্রথমে বসেছে অন্ধকার ও পরে আলো। ভাষা সাহিত্যে এই শব্দ যখন যুগল রূপে বসে তখন সাধারনতঃ ‘আলো ও অন্ধকার’  রূপে বসে, সোহিত্যে সাধারণতঃ এই রীতিই চলে আসছে। কোরআন অভিধা এই রীতি ভেঙে উল্টো ভাবে ব্যবহার করেছেন। হয়তো বলবেন, এমন কি সমস্যা হয়েছে, ভাবধারাতো একই রয়েছে! না! সূধী পাঠক, এক নয়, এখানেই লুকিয়ে রয়েছে পবিত্র কোরআনের অলৌকিকতা। লক্ষ্য করুন, বিজ্ঞান বলছে  বিগব্যাঙ থেকে এক বিশাল অন্ধকার সাম্রাজ্যের সৃষ্টি হয়েছে, মহাশক্তির এক বিস্তার অমিয় ধারায় ছুটে চলেছে আর শুরু হয়েছে বিবর্তনের ধারা। বিস্ফোরণের বহু পড়ে শুরু হয়েছে রূপান্তরের ধারা যেখানে শক্তি থেকে পদার্থ কনার সৃষ্টি হয়েছে ধীর লয়ে। সেই পদার্থ কণা ধূঁয়ার আকারে সৃষ্টি করে  নিহারীকা, একসময় সেই নিহারীকা খণ্ড বিখণ্ড হয়ে পুঞ্জিভূত মেঘের সৃষ্টি করে আর সেই পুঞ্জিভূত মেঘমালায় জমাটবদ্ধ হয় মহাজাগতিক বস্তু নিলয়, কখনো কখনো মহাজাগতিক বস্তু নিলয় বিস্ফোরিত হয়ে তৈরী করে ক্ষুদ্রাকৃতি বস্তু আর তার পরিমণ্ডলে পুঞ্জিভূত ধূলিমেঘ। মহাজাগতিক বস্তু থেকে বিমোচিত শক্তি আলোর কণা রূপে বেরিয়ে এসে সেই ধুলি মেঘে প্রতিফলিত হয়ে সৃষ্টি করে ঝলঝলে আলোর। তাহলে দেখা গেল মহাবিশ্ব সৃষ্টির বহু পরে সৃষ্টি হয়েছে আলো। আর পবিত্র কোরআন ও এমনটাই বুঝিয়েছে তার নিয়ম বিরুদ্ধ শাব্দিক ব্যবহার দিয়ে।

সূধী পাঠক, আমাদের সূফী কোরআন গবেষকদের অনেকেই পবিত্র কোরআনে বিভিন্ন আয়াতে এই ظُلُمَاتٍ (জুলুমাতি) শব্দটি অলঙ্কারিক ব্যাবহার হিসেবে মন্তব্য করেছেন, তারা বলছেন, এই অলো অন্ধকার শব্দ দিয়ে মহান আল্লাহ পাপ পূণ্য বা ভাল মন্দ বুঝাতে চেয়েছেন। প্রকৃত আলো বা অন্ধকার বুঝাননি। অবশ্য এরূপ মন্তব্যের সুনির্দিষ্ট কারণও রয়েছে, মহান আল্লাহ অনেক ক্ষেত্রে উপমা স্বরূপ ও  ঐ শব্দটি ব্যবহার করে ভাল-মন্দ , পাপ পূণ্যি বুঝিয়েছেন; তবে তা আয়াতের বর্ণনা থেকেই মূর্ত হয়ে উঠে। লক্ষ্য করুন নীচের আয়াতটি; সূরা বাকারার এই আয়াতটিতে মহান আল্লাহ অন্ধকার বলতে ظُلُمَاتٍ (জুলুমাত) শব্দটি দ্বারা মহান আল্লাহ কিন্তু আলোর অভাবে  যে অধাঁর নেমে আসে,এখানে শব্দটির মৌলিক ব্যবহার হয়েছে কিন্তু আয়াত ৬:১ এ অর্থাৎ সূরা আনআমের প্রথম আযাতে মহান আল্লাহ অলঙ্কারিক ব্যাবহার করেছেন, আরবী ভাষা সাহিত্যে এই শব্দটি দিয়ে অন্ধকারও বুঝানো হয়ে থাকে; অভিধানিক ভাবেও শব্দটি দ্বারা অন্ধকার বুঝায়। কিন্তু যে শব্দমূল থেকে এই শব্দটি উত্থিত হয়েছে তার মৌলিক অবস্থাটি অন্যায়,অত্যাচার কে নির্দেশ করে। বিভিন্ন অয়াত পর্যোবেক্ষন করলে দেখা যায় যে,  শব্দটি পবিত্র কোরআনে মৌলিক বা আক্ষরিক এবং অলঙ্কারিক উভয় ধরনের ব্যবহারই হয়েছে। ফলে আমাদেরকে আয়াতের মর্মার্থ থেকে বুঝে নিতে হবে কোথায় কি ধরনের ব্যবহার হয়েছে। নীচের আয়াতগুলো লক্ষ্য করুন,

اللّهُ وَلِيُّ الَّذِينَ آمَنُواْ يُخْرِجُهُم مِّنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّوُرِ وَالَّذِينَ كَفَرُواْ أَوْلِيَآؤُهُمُ الطَّاغُوتُ يُخْرِجُونَهُم مِّنَ النُّورِ إِلَى الظُّلُمَاتِ أُوْلَـئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ

২:২৫৭ যারা ঈমান এনেছে, আল্লাহ তাদের অভিভাবক। তাদেরকে তিনি বের করে আনেন অন্ধকার থেকে আলোর দিকে। আর যারা কুফরী করে তাদের অভিভাবক হচ্ছে তাগুত। তারা তাদেরকে আলো থেকে বের করে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। এরাই হলো দোযখের অধিবাসী, চিরকাল তারা সেখানেই থাকবে।      -সূরা আল বাকারাহ্

ضُحَاهَا وَأَخْرَجَ لَيْلَهَا وَأَغْطَشَ

৭৯:২৯ তিনি এর রাত্রিকে করেছেন অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং এর সূর্যোলোক প্রকাশ করেছেন।

-সূরা আন নযিয়াত

وَأَغْطَشَ – তিঁনি অন্ধকারাচ্ছন্ন করে দিয়েছেন, এখানে ‘আগতাসা’ শব্দাংটি দিয়ে বলা হয়েছে ‘তিনি অন্ধকারাচ্ছন্ন করে দিয়েছেন’; আরবী ভাষা সাহিত্যের এ এক বিশেষ বৈশিষ্ট যে, কখনো কখনো একটি শব্দ বা শব্দাংশ পূর্ণ ভাব প্রকাশ করে; এই শব্দটি অন্ধকারের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত কিন্তু ‘জুলম’ শব্দমূলের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। অনুরূপ বর্ণনা দেখা যায় ضُحَاهَا  শব্দটিতে; যার সাথে ‘নুর’ শব্দের কোন সম্পর্ক নেই; বাহির করিয়া থাকেন।তাহলে আয়াতের যে ভাবধারা দাঁড়ায় তা’হল-‘তিঁনি রাত্রিকে করে দিয়েছেন অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং তা থেকে  বাহির করিয়া থাকেন আলো’। দেখুন একই ধরনের ভাবধারা রয়েছে নীচের আয়াতটিতে; এখানে একটু বাড়তি আহ্বান রয়েছে ‘নিশ্চয় এতে ঈমানদার সম্প্রদায়ের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে’। এখন প্রশ্ন হল কি সেই নিদর্শন?

أَلَمْ يَرَوْا أَنَّا جَعَلْنَا اللَّيْلَ لِيَسْكُنُوا فِيهِ وَالنَّهَارَ مُبْصِرًا إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ

২৭:৮৬ তারা কি দেখে না যে, আমি রাত্রি সৃষ্টি করেছি তাদের বিশ্রামের জন্যে এবং দিনকে করেছি আলোকময়। নিশ্চয় এতে ঈমানদার সম্প্রদায়ের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।

সূধী পাঠক, মহান আল্লাহ প্রেরিত কোন নিদর্শণই সুদৃশ্য হয়ে প্রতিভাত হয়না, তাকে খুঁজে দেখতে হয়; ভাবনা চিন্তা করে তা হৃদয়ঙ্গম করতে হয়; আলোচ্য আয়াতগুলোতেও তেমনি খুঁজে দেখতে হবে কি সেই নিদর্শণ। আমরা আগেও দেখেছি, সৃষ্টির প্রারম্ভিকায় আমাদের এই মহাবিশ্ব ছিল বিকট অন্ধকার রাজ্য; সময়ের বিশাল ব্যবধানে সেই অন্ধকার রাজ্যে কিছু মহাজাগতিক বস্তুর অভুদ্বয় ঘটে, যার আলোক বর্তীকা হয়ে মহাশূণ্যের স্থানে স্থানে ভাসতে থাকে। বিজ্ঞানের এই ধারণা থেকে আমরা সত্যরূপে বুঝতে পেরেছি যে, সর্বপ্রথম অন্ধকার রাজ্যেই আলোর অভূদ্বয় ঘটেছে। আলো বিলুপ্ত হয়ে অন্ধকার সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু আমরা প্রতি নিয়ত দেখি আমাদের মহারাজা সূর্যো দেবতার অন্তর্ধানে, আমরা অন্ধকারে ডুবে যাই। এবার কোরআনের আয়াত গুলোর দিকে লক্ষ্য করুন, প্রচলিত ধারণার বিপক্ষে বলছে যে, মহান আল্লাহ অন্ধকার থেকে আলোর উদ্ভক করেছেন, আবার কোথাও প্রচলিত ধারণাকেও পরিস্ফুটিত করেছেন এই বলে যে, তিনি রাত্রি সৃষ্টি করেছেন বিশ্রামের জন্যে’। হয়তো বলবেন, এখানেতো আলোর মধ্যে অন্ধকার সৃষ্টি করার ধারনা দেওয়া হয়েছে। সত্যি তাই! মহান আল্লাহ এখানে অন্ধকার ও আলোর মধ্যে বিবেদ দেখানোর লক্ষে এ আয়াত অবতীর্ণ করেননি। এখানে আমাদের সৌর মণ্ডলের পরিবেশে আলো অন্ধকারের কথা বলেছেন। আমরা সৌরমণ্ডলের অধিবাসী। পৃথিবী তার জন্ম থেকে এই  পরিবেশে বিবর্তীত হয়েছে, কোন এক পর্যায়ে তার আবহ পরিবেশে আলোক তরঙ্গ প্রতিফলিত হয়ে আলোতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। এই আলোক ময় পরিবেশে এক সময় সৃষ্টি হয়েছে প্রাণ তথা মানুষ। বিজ্ঞান বলছে পৃথিবীর যদি আহ্নিক গতি না থাকতো তবে পৃথিবীতে প্রাণের সঞ্চার হতনা অর্থাৎ পৃথিবীর দুই গোলার্ধ  অন্ধকার ও আলোর দুই চরমভাবাপন্ন অবস্থ তাকতো। তাইতো মহান আল্লাহ দিবারাত্র সৃষ্টি করে প্রাণ সৃষ্টির অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন; আর এই সংবাদটিই  উপরের ২৭:৮৬ অয়াতে মানুষকে জানিয়ে এই সৃষ্টির বিজ্ঞানময়তা সম্পর্কে জানার লক্ষে ভাবুকদেরকে আহ্বান করেছেন। মহাবিশ্বের অন্ধকার ও আলো সৃষ্টির বর্ণনা দেননি। কিন্তু আয়াত ৬:১ অন্ধকার ও আলো সৃষ্টির কথা জানাতে এক ভিন্ন পরিমণ্ডলেল বর্ণনা করেছেন। যেখানে অন্ধকার দিয়ে এই মহাবিশ্ব শুরু  হয়েছে আর আলো দিয়ে তা পরিস্ফূটিত করে তোলা হয়েছে যাতে দৃষ্টিলভ্য হয় তাঁর প্রাণীকুলের।

আরও কিছু আয়াত লক্ষ্য করুন,

خَلَقَكُم مِّن نَّفْسٍ وَاحِدَةٍ ثُمَّ جَعَلَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَأَنزَلَ لَكُم مِّنْ الْأَنْعَامِ ثَمَانِيَةَ أَزْوَاجٍ يَخْلُقُكُمْ فِي بُطُونِ أُمَّهَاتِكُمْ خَلْقًا مِن بَعْدِ خَلْقٍ فِي ظُلُمَاتٍ ثَلَاثٍ ذَلِكُمُ اللَّهُ رَبُّكُمْ لَهُ الْمُلْكُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ فَأَنَّى تُصْرَفُونَ

৩৯:৬ তিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে একই ব্যক্তি থেকে। অতঃপর তা থেকে তার যুগল সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি তোমাদের জন্যে আট প্রকার চতুষ্পদ জন্তু অবতীর্ণ করেছেন। তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের মাতৃগর্ভে পর্যায়ক্রমে একের পর এক ত্রিবিধ অন্ধকারে। তিনি আল্লাহ তোমাদের পালনকর্তা, সাম্রাজ্য তাঁরই। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। অতএব, তোমরা কোথায় বিভ্রান্ত হচ্ছ       সূরা আল যুমার

উপরের আয়াতটিতে স্বাভাবিকভাবেই ‘জুলুমাত’ শব্দ দিয়ে অন্ধকার বুঝিয়েছেন।

يَوْمَ تَبْيَضُّ وُجُوهٌ وَتَسْوَدُّ وُجُوهٌ فَأَمَّا الَّذِينَ اسْوَدَّتْ وُجُوهُهُمْ أَكْفَرْتُم بَعْدَ إِيمَانِكُمْ فَذُوقُواْ الْعَذَابَ بِمَا كُنْتُمْ تَكْفُرُونَ

3:106 সেদিন কোন কোন মুখ উজ্জ্বল হবে, আর কোন কোন মুখ হবে কালো। বস্তুতঃ যাদের মুখ কালো হবে, তাদের বলা হবে, তোমরা কি ঈমান আনার পর কাফের হয়ে গিয়েছিলে? এবার সে কুফরীর বিনিময়ে আযাবের আস্বাদ গ্রহণ কর।

تَسْوَدُّ  -শব্দটির অর্থ হল কাল (Prevai)( জয়ী)l    تَبْيَضُّ – Ovulate (ডিম্বাণু উত্পাদন করা) সাদা হয়ে যাওয়া; অবশ্য এখানে কালো রঙের সাথে কোন সম্পৃক্ততা নেই। এখানে ধারনা প্রদান করার জন্যে শব্দ দু’টোর অলঙ্কারিক ব্যবহার হয়েছে।

وَلَا الظُّلُمَاتُ وَلَا النُّورُ

৩৫:২০ সমান নয় অন্ধকার ও আলো। –   সূরা ফাতির

উপরে সূরা ফাতিরের এই আয়াতটির দিকে লক্ষ্য করুন, প্রচলিত তরজমায় বলা হয়েছে ‘(সমান নয় অন্ধকার ও আলো); এবার আমরা আয়াতটির শব্দে শব্দে তরজমা দেখি, وَلَا  -এবং না,   الظُّلُمَاتُ – অন্ধকার,   النُّورُ – এবং না আলো; শব্দ অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে ‘এবং না অন্ধকার না আলো); প্রচলিত তরজমায় সমান শব্দটি থাকলে  আয়াতে কোন উল্যেখ নাই।  এই অবস্থায় আয়াতটির ক্তব্য বিষয়টি পরিস্কার হয়ে উঠছেনা, এ ক্ষেত্রে আমরা পূর্বাপর আয়াতে ঘটনা প্রবাহ খুঁজে দেখি;

وَلَا الظِّلُّ وَلَا الْحَرُورُ

৩৫:২১ সমান নয় ছায়া ও তপ্তরোদ।

আয়াতটি আলো অন্ধকারের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত।

وَمَا يَسْتَوِي الْأَحْيَاء وَلَا الْأَمْوَاتُ إِنَّ اللَّهَ يُسْمِعُ مَن يَشَاء وَمَا أَنتَ بِمُسْمِعٍ مَّن فِي الْقُبُورِ

৩৫:২২ আরও সমান নয় জীবিত ও মৃত। আল্লাহ শ্রবণ করান যাকে ইচ্ছা। আপনি কবরে শায়িতদেরকে শুনাতে সক্ষম নন।

উপরের আয়াতে  يَسْتَوِي – শব্দটির শাব্দিক অর্থ অস্ত যাওয়া; আর مساو -সমান ; এ আয়াতে يَسْتَوِي শব্দটি সম জাতীয় বুঝাতে বসেছে; ফলে আয়াতের তরজমা দাঁড়ায় ‘জীবিত ও মৃত এক নয়, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা শ্রবন করান, আপনি কবরবাসীদেরকে কিছু শোনাতে পারেননা। এমনি করে ‘সমজাতীয় বা একই’ শব্দটি না থাকলেও উপরের এই আয়াতের সাথে মিল রেখে  ৩৫: ২০-২১ আয়াত দুটিতে ‘একই’ ধারনাটি তরজমায় ব্যাবহৃত হয়েচে; এই ভাবে ধারনা করা যায় যে, মহান আল্লাহ সম্ভবত ২০ নং আয়াতে বলতে চেয়েছেন যে অন্ধকার ও আলো এক নয় (আল্লাহই ভাল জানেন)।

 

সূরা আস শামস্ আয়াত ১-৫;

وَالشَّمْسِ وَضُحَاهَا

91:1 শপথ সূর্যের ও তার কিরণের,

وَالْقَمَرِ إِذَا تَلَاهَا

91:2 শপথ চন্দ্রের যখন তা সূর্যের পশ্চাতে আসে,

وَالنَّهَارِ إِذَا جَلَّاهَا

91:3 শপথ দিবসের যখন সে সূর্যকে প্রখরভাবে প্রকাশ করে

وَاللَّيْلِ إِذَا يَغْشَاهَا

91:4 শপথ রাত্রির যখন সে সূর্যকে আচ্ছাদিত করে

وَالسَّمَاء وَمَا بَنَاهَا

91:5 শপথ আকাশের এবং যিনি তা নির্মাণ করেছেন, তাঁর।

সূধী পাঠক, উপরের আয়াতগুলোর দিকে ভাল তাকান তার পর ভাবুন, দেখুন কি বিষ্ময়কর তথ্যের সন্ধান দিয়েছে পবিত্র কোরআন! ৯১:৩ আয়াতটির দিকে লক্ষ্য করুন, এখানে বলা হয়েছে ‘শপথ দিবসের যখন সে সূর্যকে প্রখরভাবে প্রকাশ করে’। আমরা জানি সূর্যের আলোকে দিবস প্রকাশিত হয়। সূর্যের আলো চলে গেলে রাত্রির আগমন ঘটে। কিন্তু উক্ত আয়াত বলছে উল্টো কথা অর্থাৎ দিবস সূর্যের পরিচয় তুলে ধরে। তাহলে বলা যায় সুরুয দিবসের নিয়ামক নয়। ঠিক পরের  অর্থাৎ ৯১:৪  আয়াতটির দিকে লক্ষ্য করুন, এখানে বলা হয়েছে,‘শপথ রাত্রির যখন সে সূর্যকে আচ্ছাদিত করে’ অর্থাৎ রাত্রি যা অন্ধকার তা সর্যোকে গ্রাস করে। এবার আরেকটি আয়াত লক্ষ্য করুন,

وَآيَةٌ لَّهُمْ اللَّيْلُ نَسْلَخُ مِنْهُ النَّهَارَ فَإِذَا هُم مُّظْلِمُونَ

৩৬:৩৭ তাদের জন্যে এক নিদর্শন রাত্রি, আমি তা থেকে দিনকে অপসারিত করি, তখনই তারা অন্ধকারে থেকে যায়।

এখানে  শব্দটির ইংরেজি অনুবাদ হল ‘withdraw’ বাংলায় বলাচলে উঠিয়ে নেওয়া বা সরিয়ে দেওয়া, এই শব্দটির ইংরেজী তরজমা হল Then behold!, অর্থাত দেখতে পায়; তাহলে উপরিউক্ত তরজমা দাঁড়ায় ‘তাদের জন্যে এক নিদর্শন রাত্রি, আমি তা থেকে দিনকে উঠিয়ে নেই, তখনই তারা অন্ধকার দেখতেপায়।’

এই সূত্রে একটা বিশেষ প্রশ্নের  সৃষ্টি হয়,তা হল আলোর রং কি? এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের ধারনা মতে বলা যায় যে আলোর কোন রং নেই; এটি চারটি মৌলিক তরঙ্গের মিশ্রনে রং বিহীন একটা তরঙ্গ; তাই সাধারন অবস্থায় আমরা আলো দেখতে পাইনা; চলার পথে এটি যখন কোন বস্তু বা বস্তু কণা থেকে প্রতি ফলিত হয় তখনই আমরা তাকে দেখতে পাই। সূর্যের সাদা আলোকে তখনই দেখা যায় যখন সে আমাদের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে। বিজ্ঞান বলছে সূর্যের আলো অদৃশ্য বিকিরণ রূপে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে,বিশাল পথ পাড়ি দিয়ে যখন আমাদের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে তখন গ্যাস ও ধূলিকণা থেকে প্রতিফলিত হয়ে যখন আদের চোখে পড়ে তখনই আমরা প্রদীপ্ত সূর্যোকে দেখতে পাই। তাহলে বলা চলে আমাদের বায়ুমন্ডলই সূর্যের বিকিরণকে আলোতে রূপান্তর করে। আর সর্যোরশ্নির এই বৈশিষ্টের কারণে আমরা বিভিন্ন প্রকারের রঙিন বস্তুকে চিনতে পারি।

উপরের এই তিনটি আয়াতকে সমন্বয় করলে পরিস্কার ভাবে বুঝা যায় যে, মহাকাশে দিন বলে কিছু নেই, স্বল্প সময়ের আলোকীয় অবস্থা। আর এই আলোকীয় অবস্থার সৃষ্টি হয় কোন আলোক উৎসের উপস্থিতিতে। সেই আলোক উৎস থেকে আপতিত আলোক তরঙ্গ তার প্রতিবেশীর আবহমণ্ডলে বস্তুকণাণায় প্রতিফলিত হয়ে আলোকীয় অবস্থার সৃষ্টি করে দিবস তৈরী করে, আর সেই আলোর অবর্তমানে অন্ধকারে ফিরে আসে। অর্থাৎ একমাত্র আলোক উৎস ব্যতিত মহাকাশের সকল বস্তুই নিকষ কালো অন্ধকারে নিমজ্জিত। এবার উৎসগুলোকে নিয়ে ভেবে দেখুন সেখানে কোন দিবস রাত্রির ব্যবস্থা নেই। তারা বিরামহীনভাবে বিকিরণ ছড়িয়ে যাচ্ছে। তাদের নিজ্স্ব পরিমণ্ডলে গ্যাস ও মহাজাগতিক ধূলিবালিতে সেই বিকিরণ প্রতিফলিত হয়ে দৃশ্য আলোক সৃষ্টি করছে ফলে আমরা তাদেরকে উজ্জল রূপে দেখতে পাই। মহান আল্লাহ সম্ভবত এ বিষয়টিকেই পরিস্ফূটিত করে তুলে ধরেছেন উপরের আয়াতগুলোতে।

يَهْدِي بِهِ اللّهُ مَنِ اتَّبَعَ رِضْوَانَهُ سُبُلَ السَّلاَمِ وَيُخْرِجُهُم مِّنِ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ بِإِذْنِهِ وَيَهْدِيهِمْ إِلَى صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ

৫:১৬ এর দ্বারা আল্লাহ যারা তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে, তাদেরকে নিরাপত্তার পথ প্রদর্শন করেন এবং তাদেরকে স্বীয় নির্দেশ দ্বারা অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে আনয়ন করেন এবং সরল পথে পরিচালনা করেন।      সূরা আল মায়েদাহ্

أَوْ كَظُلُمَاتٍ فِي بَحْرٍ لُّجِّيٍّ يَغْشَاهُ مَوْجٌ مِّن فَوْقِهِ مَوْجٌ مِّن فَوْقِهِ سَحَابٌ ظُلُمَاتٌ بَعْضُهَا فَوْقَ بَعْضٍ إِذَا أَخْرَجَ يَدَهُ لَمْ يَكَدْ يَرَاهَا وَمَن لَّمْ يَجْعَلِ اللَّهُ لَهُ نُورًا فَمَا لَهُ مِن نُّورٍ

২৪:৪০ অথবা (তাদের কর্ম) প্রমত্ত সমুদ্রের বুকে গভীর অন্ধকারের ন্যায়, যাকে উদ্বেলিত করে তরঙ্গের উপর তরঙ্গ, যার উপরে ঘন কালো মেঘ আছে। একের উপর এক অন্ধকার। যখন সে তার হাত বের করে, তখন তাকে একেবারেই দেখতে পায় না। আল্লাহ যাকে জ্যোতি দেন না, তার কোন জ্যোতিই নেই।     সূরা আন নূর

هُوَ الَّذِي يُصَلِّي عَلَيْكُمْ وَمَلَائِكَتُهُ لِيُخْرِجَكُم مِّنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ وَكَانَ بِالْمُؤْمِنِينَ رَحِيمًا

৩৩:৪৩ তিনিই তোমাদের প্রতি রহমত করেন এবং তাঁর ফেরেশতাগণও রহমতের দোয়া করেন-অন্ধকার থেকে তোমাদেরকে আলোকে বের করার জন্য। তিনি মুমিনদের প্রতি পরম দয়ালু।      সূরা আল আহযাব

رَّسُولًا يَتْلُو عَلَيْكُمْ آيَاتِ اللَّهِ مُبَيِّنَاتٍ لِّيُخْرِجَ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ وَمَن يُؤْمِن بِاللَّهِ وَيَعْمَلْ صَالِحًا يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا قَدْ أَحْسَنَ اللَّهُ لَهُ رِزْقًا

৬৫:১১ একজন রসূল, যিনি তোমাদের কাছে আল্লাহর সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ পাঠ করেন, যাতে বিশ্বাসী ও সৎকর্মপরায়ণদের অন্ধকার থেকে আলোতে আনয়ন করেন। যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম সম্পাদন করে, তিনি তাকে দাখিল করবেন জান্নাতে, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত, তথায় তারা চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তাকে উত্তম রিযিক দেবেন।    -সূরা আত্ব তালাক

وَخَسَفَ الْقَمَرُ

৭৫:৮ চন্দ্র জ্যোতিহীন হয়ে যাবে    -সূরা আল ক্বেয়ামাহ

قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ

১১৩:১ বলুন, আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি প্রভাতের পালনকর্তার,        সূরা ফালাক্ব

وَمِن شَرِّ غَاسِقٍ إِذَا وَقَبَ

১১৩:৩ অন্ধকার রাত্রির অনিষ্ট থেকে, যখন তা সমাগত হয়,

 

সূধী পাঠক, উপরের আলোচনায় যৎসামান্য যে টুকু আমরা বুঝতে পারলাম, তাতে মনে হয় পবিত্র কোরআন রহস্যের এক বিশাল ভাণ্ডার, যার অভ্যান্তরে স্তরে স্তরে সজ্জিত হয়ে আছে মানুষের ভাবনা চিন্তার অগণিত বিষয়বস্তু। তাদেরই অতি সামান্য একটা বিষয় এই অন্ধকার ও আলোর জগৎ। চিরকালীন এই অন্ধকার জগতে আলো দিয়েছে দৃষ্টিলভ্যতা, উপহার দিয়েছে অপরূপ এই প্রকৃতি যেখানে জন্মেছে হাজারও প্রাণ। এই প্রাণীকুল বেঁচে থাকার জন্যে আলো যেমন দরকার তেমনি অন্ধকারও প্রয়োজনীয়, তাই মহান আল্লাহ আলোকীয় পরিবেশে তাঁর সৃষ্ট প্রাণীকুল যেন অন্ধকার পায় সে ব্যবস্থাও করেছেন মহাজাগতিক বস্তু সমুহের ঘূর্ণন ব্যবস্থার মধ্যে। তবে এমনটা ভাবা যুক্তিযুক্ত নয় যে, শুধু আলো-অন্ধকারের প্রয়োজনেই মহাজাগতিক বস্তুসমুহের মধ্যে এই ঘূর্ণন ব্যবস্থা বিধিত করেছেন। ঘূর্ণন ব্যবস্থা বিধিত হয়েছে নানাবিধ প্রয়োজনে গাণিতিক সমন্বয়ের মধ্যদিয়ে; মহাজাগতিক বস্তুসমুহে আলো-অন্ধকার সৃষ্টি একটি প্রয়োজন। অন্ধকার হল মহাবিশ্বের সহজাত পরিবেশ এটি মহাবিশ্বে আলাদা কোন সৃষ্টি নয়; মহান আল্লাহ ৬:১ আয়াতে  جَعَلَ (জায়ালা) শব্দটি দিয়ে পরিস্কার করে দিয়েছেন;  জায়ালা শব্দের অর্থ হল কোন কিছু ব্যবস্থিত করা। অক্ষ্য করুন পবিত্র কোরআনের শব্দ চয়ন, কোথাও এতটুকু ভুলের সুযোগ নেই। মহান আল্লাহ আজকের মানুষের বুদ্ধিমত্তার দিকে লক্ষ্য রেখেই এই জায়ালা শব্দটি ব্যবহার করেছেন; শুধু আয়াতের ভাবধারা রক্ষার্থে এ শব্দটির জরুরী প্রয়োজন ছিলনা; লক্ষ্য করুন আয়াতাংম ৬:১;

(الْحَمْدُ لِلّهِ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ وَ الظُّلُمَاتِ وَالنُّورَ)  যার তরজমা দাঁড়ায় ‘সর্ববিধ প্রশংসা আল্লাহরই জন্য যিনি সৃষ্টি করেছেন নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল এবং অন্ধকার ও আলো’ এখানে ‘জায়ালা’ শব্দটি অনুপুস্থিত।

সূধী পাঠক ভুল বলার কোন উপায় রয়েছে। তার পড়েও মহান আল্লাহ এই ‘জায়ালা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন শতভাগ নির্ভুলতার জন্যে, যাতে আজকের যুগের কোন তার্কিক ভূল ধরতে না পারেন। তার পরেও কি বলার সুযোগ রয়েছে যে, এই কোরআন নবী মোহাম্মদ (সাঃ) তার নিজ মেধা ও পারিপার্শিক অভিঞ্জতা থেকে লিখেছেন। যদি কেউ এমনটা দাবী করেও বসেন তবে ধরে নিতে হবে তা সম্পূর্ণই মনের খেয়াল ও পবিত্র কোরআনের বিরোধীতা করা । সত্য জানার জন্যে চাই নিরপেক্ষ মানসিকতা।সেই নিরপেক্ষ মনে এ সকল খুটিনাটি বিষয়ের উপর যখন চোখ পড়ে তখন আমাদের মস্তিস্ক তার আপন চিন্তাভাবনা দিয়েই প্রকৃত সত্যকে খুঁজে বের করে। মহান আল্লাহ আমাদের সকলের মনে ও মস্তিস্কে এই সুযোগ তৈরী করে দিন এটাই আমাদের কামনা।

 

প্রথম প্রকাশঃ

SciencewithQuran.com

fecebook:

http://www.facebook.com/sciencewithquran

Level 0

আমি হৃদয় খন্দকার। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 10 বছর 10 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 35 টি টিউন ও 60 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস

Thanks for share

মানুষ কি বিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছিল? এই পোষ্টটি যেহতু ধর্মের মাধ্যমে বোঝান হয়েছে। তো আমার প্রশ্ন আল্লাহ পাক হযরত আদম (আঃ) কে কি প্রথমে বানর বানিয়ে পাঠিয়েছিলেন? তার পর আস্তে আস্তে আমরা বানর থেকে বর্তমান রূপ পেয়েছি। কোরআনে এমন কোন উক্তি যদি থাকে দয়াকরে লিখুন।
বিবর্তনবাদের সূত্র কে দিয়েছিলেন? আমি জানি, আপনি পরিস্কার করুন।