ঢেঁড়স – ছাদ বাগানে চাষের উপযুক্ত সবজি ফসল

ঢেঁড়স (Lady’s finger/Okra) ছাদ বাগানে টবে চাষ উপযোগী একটি জনপ্রিয় ও সহজলভ্য সবজি। এতে ভিটামিন এ, সি, ক্যালসিয়াম, আয়রনসহ নানা পুষ্টি উপাদান রয়েছে যা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ঢেঁড়স গ্রীষ্মকালীন সবজি হলেও বর্তমানে সারা বছরইেএটি পাওয়া যায়। বর্তমানে শহরে বসবাসকারী অনেক মানুষ ছাদ বাগানের মাধ্যমে নিজেদের সবজি চাহিদা পূরণ করছেন। ছাদে জৈব পদ্ধতিতে খুব সহজে ঢেঁড়স চাষ করা এবং কম খরচে অধিক ফলন পাওয়া যায়। ছাদ বাগানে ফুল, ফল ও অন্যান্য সবজির সাথে ঢেঁড়সও একটি অন্যতম উপযুক্ত সবজি। ছাদ বাগানে ঢেঁড়স চাষ করলে একদিকে পরিবারের পুষ্টি চাহিদা পূরণ হবে, অন্যদিকে বাজার থেকে বিষমুক্ত সবজি কেনার চিন্তা থেকেও মুক্তি পাওয়া যাবে।

ঢেঁড়সের পুষ্টিগুণ

ঢেঁড়স শুধু সুস্বাদুই নয়, বরং এটি নানা পুষ্টিগুণে ভরপুর।

  • এতে রয়েছে ভিটামিন এ, বি-কমপ্লেক্স, সি, কে।
  • ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম ও আয়রন সমৃদ্ধ।
  • আঁশ জাতীয় উপাদান থাকায় এটি হজমে সহায়ক এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
  • শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
  • রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে।

ছাদ বাগানে ঢেঁড়স চাষের সুবিধা

ছাদে ঢেঁড়স চাষ করার কিছু বিশেষ সুবিধা রয়েছেঃ

  • সহজ চাষযোগ্যতাঃ ঢেঁড়স খুবই সহজে জন্মে, বিশেষ যত্নের প্রয়োজন পড়ে না।
  • দীর্ঘসময় ফল দেয়ঃ একবার ফুল ও ফল আসা শুরু হলে নিয়মিত কয়েক মাস পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়।
  • টবে ভালো জন্মেঃ ১২-১৫ ইঞ্চি গভীর টবে ঢেঁড়স চাষ করা যায়।
  • পুষ্টি নিশ্চিতকরণঃ বাজারের রাসায়নিকযুক্ত সবজি বাদ দিয়ে পরিবারকে নিরাপদ ও পুষ্টিকর সবজি সরবরাহ করা যায়।
  • ছাদের সৌন্দর্য বৃদ্ধিঃ সবুজ ঢেঁড়স গাছ ছাদকে করে তোলে সবুজ ও মনোরম।

মাটি প্রস্তুতি

ঢেঁড়স চাষে মাটির মান খুব গুরুত্বপূর্ণ।

  • টব বা ড্রামে ভালোভাবে ঝুরঝুরে মাটি ব্যবহার করতে হবে।
  • এক ভাগ বাগানের মাটি, এক ভাগ গোবর সার/কম্টিউন, এবং অল্প পরিমাণ বালু মিশিয়ে নিতে হবে।
  • মাটিতে ৫০-৬০ গ্রাম টিএসপি, ৩০-৪০ গ্রাম এমওপি ও ৫০-৬০ গ্রাম ইউরিয়া সার মিশিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
  • মাটির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য জৈবসার ও কেঁচো সার ব্যবহার করলে গাছ সুস্থ ও ফলন বেশি হবে।

বীজ বপন

  • সাধারণত মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর মাস ঢেঁড়স চাষের উপযুক্ত সময়।
  • প্রতিটি টবে ৩-৪টি বীজ ২-৩ সেন্টিমিটার গভীরে বপন করতে হবে।
  • বীজ অংকুরোদগম হার বাড়াতে বীজ এক রাত পানিতে ভিজিয়ে রাখা যেতে পারে।
  • প্রতিটি টবে একটি বা দুটি স্বাস্থ্যকর চারা রেখে বাকিগুলো তুলে ফেলা ভালো।

গাছের পরিচর্যা

ছাদে ঢেঁড়স চাষে কিছু নিয়মিত পরিচর্যা জরুরিঃ

  • সেচঃ ঢেঁড়স গাছ শুষ্কতা সহ্য করতে পারে না। তাই টবের মাটি শুকিয়ে গেলে হালকা পানি দিতে হবে। তবে পানি যেন জমে না থাকে।
  • আগাছা নির্মূলঃ নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
  • সার প্রয়োগঃ গাছ বড় হওয়ার পর প্রতি ১৫-২০ দিন পর পর তরল জৈবসার বা ইউরিয়া সামান্য পরিমাণে দিতে হবে।
  • ছাঁটাইঃ শুকনো ও রোগাক্রান্ত পাতা ছেঁটে ফেলা দরকার। এতে গাছ সতেজ থাকবে।
  • পোকামাকড় দমনঃ এফিড, ফলছিদ্রকারী পোকা ইত্যাদি ঢেঁড়সের শত্রু। জৈব কীটনাশক যেমন নিম তেল ব্যবহার করা যেতে পারে।

ফুল ও ফল ধরা

সাধারণত ৪০-৪৫ দিন পর গাছে ফুল আসে এবং কয়েকদিনের মধ্যেই ছোট ঢেঁড়স ধরা শুরু হয়।

  • প্রতিদিন বা একদিন অন্তর অন্তর নরম অবস্থায় ঢেঁড়স তুলতে হবে।
  • দেরি করলে ঢেঁড়স শক্ত হয়ে খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে যায়।
  • নিয়মিত তোলা হলে গাছে দীর্ঘসময় নতুন ফল আসতে থাকে।

ছাদ বাগানে ঢেঁড়সের ফলন

একটি টব থেকে গড়ে ৫০-৬০টি ঢেঁড়স পাওয়া যায়। যদি ১০-১২টি টবেও ঢেঁড়স লাগানো হয় তবে পরিবারের দৈনন্দিন চাহিদার বড় অংশ পূরণ হয়ে যাবে।

রোগবালাই ও প্রতিকার

ঢেঁড়স গাছে কিছু সাধারণ রোগবালাই দেখা যায়, যেমনঃ

  • পাতা মোড়ানো রোগঃ ভাইরাসজনিত। আক্রান্ত পাতা তুলে ফেলতে হবে।
  • পাতা দাগ রোগঃ ছত্রাকজনিত। বর্ডার মিশ্রণ বা জৈব ছত্রাকনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে।
  • পোকামাকড়ঃ ফল ছিদ্রকারী পোকা, এফিড ইত্যাদি দমন করতে নিম তেল বা সাবান পানি ছিটানো কার্যকর।

ঢেঁড়স চাষে সতর্কতা

  • টব বা ড্রামের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ঠিক রাখতে হবে।
  • অতিরিক্ত সার প্রয়োগ এড়িয়ে চলতে হবে।
  • নিয়মিত দেখাশুনা ও ফল তোলার অভ্যাস করতে হবে।
  • রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার না করাই ভালো, প্রয়োজনে জৈব কীটনাশক ব্যবহার করা উচিত।

অর্থনৈতিক গুরুত্ব

ছাদে ঢেঁড়স চাষ শুধু শখ নয়, বরং অর্থনৈতিক দিক থেকেও উপকারীঃ

  • বাজার থেকে ঢেঁড়স কিনতে হয় না, ফলে মাসিক খরচ কমে যায়।
  • ছাদ বাগান বড় করলে অতিরিক্ত ঢেঁড়স প্রতিবেশীদের মাঝে বিতরণ করা সম্ভব।
  • নগর কৃষির মাধ্যমে সবজি উৎপাদন বাড়ানো যায়, যা জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখে।

ঢেঁড়স দিয়ে তৈরি খাবার

ঢেঁড়স নানা উপায়ে খাওয়া যায়। যেমনঃ

  • ভাজি
  • ডাল বা মাছের সঙ্গে ঝোল
  • ঢেঁড়স ভর্তা

ছাদে উৎপাদিত তাজা ঢেঁড়স রান্না করলে স্বাদ ও পুষ্টি দুটোই বেশি পাওয়া যায়।

ঢেঁড়স চাষে পরিবেশগত প্রভাব

ছাদ বাগানে ঢেঁড়স চাষের মাধ্যমে পরিবেশও উপকৃত হয়ঃ

  • ছাদের তাপমাত্রা কমে, ফলে ঘর ঠাণ্ডা থাকে।
  • অক্সিজেনের পরিমান বাড়ে।
  • ছাদে সবুজ পরিবেশ গড়ে ওঠে যা মানসিক প্রশান্তি আনে।

একটি সহজ, সাশ্রয়ী এবং স্বাস্থ্যসম্মত উদ্যোগ

ছাদ বাগানে ঢেঁড়স চাষ একটি সহজ, সাশ্রয়ী এবং স্বাস্থ্যসম্মত উদ্যোগ। এটি যেমন পরিবারের পুষ্টি ঘাটতি পূরণ করে, তেমনি আর্থিকভাবে লাভবান করে তোলে। নিয়মিত পরিচর্যা ও কিছুটা শ্রম দিলেই ছাদে টব বা ড্রামে প্রচুর ঢেঁড়স ফলানো সম্ভব। নিরাপদ ও বিষমুক্ত সবজি পেতে চাইলে ঢেঁড়স হতে পারে প্রথম পছন্দ। তাই শহরের প্রতিটি পরিবার যদি ছাদে কিছু টবে ঢেঁড়স চাষ শুরু করে, তবে একদিকে নিজেদের চাহিদা পূরণ করবে, অন্যদিকে নগর কৃষি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

Level 1

আমি ওবায়দুর রহমান। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 2 মাস 2 সপ্তাহ যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 10 টি টিউন ও 0 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।

আমি একজন ডেভেলপমেন্ট প্রফেশনাল, ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন সরকারি ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার সাথে কাজ করছি। ক্লাইমেট চেঞ্জ, অ্যাডাপ্টেশন, মিটিগেশন ও রেজিলিয়েন্স বিষয়ে আমি বিশেষজ্ঞ। পিএইচডি ডিগ্রিধারী হিসেবে গবেষণা, স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানিং, নলেজ ম্যানেজমেন্ট এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে আমার বিশেষ দক্ষতা রয়েছে।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস