থার্মোমিটার হলো একটি যন্ত্র যা তাপমাত্রা পরিমাপের জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি বিজ্ঞানের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে বৈজ্ঞানিক গবেষণা, চিকিৎসা, শিল্প, আবহাওয়া বিদ্যা এবং অনেক ক্ষেত্রেই অপরিহার্য।
থার্মোমিটারের ইতিহাস ও আবিষ্কার
থার্মোমিটারের আবিষ্কারের পেছনে মানুষের তাপমাত্রা পরিমাপের প্রয়োজনীয়তা ছিল মূল চালিকা শক্তি। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ তাপমাত্রার পরিবর্তন বুঝতে পারতো, তবে তাপমাত্রাকে নির্দিষ্ট মাত্রায় পরিমাপ করার কোনো পদ্ধতি ছিল না।
প্রাচীন যুগে গ্রীক দার্শনিক এবং বিজ্ঞানীরা তাপ ও শীতলতার ধারণা নিয়ে কাজ করতেন। প্রথম আধুনিক থার্মোমিটার আবিষ্কার করেন ইতালির বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলেই (Galileo Galilei) ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দের প্রথমার্ধে। তিনি “থার্মোস্কোপ” নামে একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন যা তাপমাত্রার পরিবর্তন বুঝাত, তবে এটি কোনো নির্দিষ্ট স্কেলে তাপমাত্রা পরিমাপ করতে পারত না।
১৬৩০-১৬৫০ সালের মধ্যে গ্যালিলিওর থার্মোস্কোপ আরও উন্নত হয় এবং তরলের পরিবর্তে বায়ু বা অন্যান্য গ্যাসের চাপ পরিবর্তনের মাধ্যমে কাজ করত। তবে এটি আসলে একটি থার্মোমিটার ছিল না, বরং একটি তাপমাত্রা পরিবর্তনের সূচক ছিল।
প্রথম তরল থার্মোমিটার
থার্মোমিটারের উন্নতির বড় ধাপ আসে ১৬৩৮ সালে যখন ফ্রান্সের বৈজ্ঞানিক ফারাদাই নামে পরিচিত গ্যাব্রিয়েল ফারেনহাইট (Gabriel Fahrenheit) প্রথম তরল-ভিত্তিক থার্মোমিটার আবিষ্কার করেন। ফারেনহাইট মূলত পারদ (মার্কারি) ব্যবহার করে একটি স্কেল তৈরি করেন, যা এখনও ব্যবহৃত হয়। তার স্কেল অনুযায়ী, বরফ গলে যাওয়া বিন্দু ৩২ ডিগ্রী ফারেনহাইট এবং মানব শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯৮.৬ ডিগ্রী ফারেনহাইট ধরা হয়।
এছাড়া, ১৮০০ সালে আন্দ্রেয়াস সেলসিয়াস (Anders Celsius) একটি স্কেল তৈরি করেন যা আমাদের বর্তমানে সেলসিয়াস স্কেল নামে পরিচিত। তিনি ০ ডিগ্রী বরফ গলনের তাপমাত্রা এবং ১০০ ডিগ্রী জল সিদ্ধ হওয়ার তাপমাত্রা নির্ধারণ করেন। সেলসিয়াস স্কেল ব্যবহার করে থার্মোমিটার নির্মাণ আরও সহজ এবং জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
থার্মোমিটারের কাজের প্রক্রিয়া
থার্মোমিটার সাধারণত তরল ভিত্তিক হয়। মারকিউরি বা রঙিন অ্যালকোহল জাতীয় তরল গ্লাসের একটি পাতলা নলিকায় রাখা হয়। তাপমাত্রা বাড়লে তরল প্রসারিত হয় এবং নলিকায় উপরে ওঠে, আর তাপমাত্রা কমলে সঙ্কুচিত হয়ে নলিকার নিচে নামে যায়। নলিকার পাশে একটি স্কেল থাকে, যা তরলের অবস্থান দেখে তাপমাত্রা নির্ণয় করা হয়।
আধুনিক থার্মোমিটারগুলো অনেক ধরনের হতে পারে, যেমন ডিজিটাল থার্মোমিটার, ইনফ্রারেড থার্মোমিটার, থার্মোকাপল, ইত্যাদি। এগুলো প্রাচীন তরল ভিত্তিক থার্মোমিটারের থেকে অনেক বেশি নির্ভুল এবং দ্রুত কাজ করে।
থার্মোমিটারের গুরুত্ব
চিকিৎসায়: রোগীর শরীরের তাপমাত্রা পরিমাপ করা, যা জ্বর বা সংক্রমণ নির্ণয়ে সাহায্য করে।
বৈজ্ঞানিক গবেষণায়: বিভিন্ন রসায়নিক ও পদার্থবিদ্যা পরীক্ষায় সঠিক তাপমাত্রা জানাটা অপরিহার্য।
আবহাওয়া বিজ্ঞানে: বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা পরিমাপ করে আবহাওয়া পূর্বাভাস তৈরি করা হয়।
শিল্পে: শিল্প কারখানায় তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন যেমন খাদ্য সংরক্ষণ, ধাতু গলন, প্লাস্টিক শিল্প ইত্যাদি।
দৈনন্দিন জীবনে: ঘর, গাড়ি, ফ্রিজ, এয়ার কন্ডিশনার ইত্যাদিতে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য থার্মোমিটার ব্যবহার হয়।
উপসংহার
থার্মোমিটার আবিষ্কার বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক বিশাল অর্জন। এটি তাপমাত্রার ধারণাকে মাপা এবং বুঝতে সাহায্য করে। গ্যালিলিওর থার্মোস্কোপ থেকে শুরু করে ফারেনহাইট ও সেলসিয়াসের স্কেল পর্যন্ত এর বিবর্তন আমাদের জীবনকে অনেক ক্ষেত্রে সহজতর করেছে। আধুনিক যুগে থার্মোমিটার আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। এটি স্বাস্থ্য রক্ষা, পরিবেশ পর্যবেক্ষণ এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নে অপরিহার্য একটি যন্ত্র। তাই বলা যায়, থার্মোমিটার আবিষ্কার মানুষের বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার অন্যতম মাইলফলক।
আমি তানবীন শুভ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 2 সপ্তাহ 6 দিন যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 15 টি টিউন ও 0 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।