আইজ্যাক নিউটন ইতিহাসের অন্যতম প্রভাবশালী বিজ্ঞানী। তার কাজের পরিধি জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, গণিত, দর্শন ইত্যাদি শাস্ত্রকে একসঙ্গে ছুঁয়েছে। নিউটনের গবেষণাই আধুনিক বিজ্ঞানকে গাণিতিক ভিত্তি এবং নিয়মের কাঠামোতে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
১) গাণিতিক গবেষণা ও ক্যালকুলাসের উদ্ভাবন
নিউটনের অন্যতম অবদান হলো ক্যালকুলাসের (Calculus) সূত্রপাত। একই সময়ে লেইবনিজও ক্যালকুলাসের বিকাশ ঘটিয়েছিলেন, তবে নিউটন স্বাধীনভাবে ‘ফ্লাক্সিওনস (fluxions)’ নামে পদ্ধতি তৈরি করেন। ক্যালকুলাসই গতিবিদ্যা, পদার্থবিজ্ঞান ও প্রকৌশলে জটিল পরিবর্তনশীল বিষয় বোঝার মূল হাতিয়ার।
ক্যালকুলাসের মাধ্যমে তিনি বেগ, ত্বরণ এবং পরিবর্তনের হার বোঝার গণিতীয় ভাষা তৈরি করেছিলেন, যা পরবর্তীতে সমগ্র বিজ্ঞানের ভিত্তি হয়ে ওঠে। যদিও সেই সময় তিনি তার ক্যালকুলাস তেমন প্রকাশ করেননি, তার নোটবুক ও পরবর্তী প্রকাশিত কাজ থেকে তা পরিষ্কার বোঝা যায়।
২) পদার্থবিজ্ঞানে ‘প্রাকৃতিক দর্শন’-এর নতুন সংজ্ঞা
নিউটনের সবচেয়ে বড় বৈপ্লবিক কাজ হলো ১৬৮৭ সালে প্রকাশিত “Philosophiæ Naturalis Principia Mathematica” (সংক্ষেপে Principia) গ্রন্থে। এই বইতে তিনি গতি সম্পর্কিত তিনটি সূত্র (Newton’s Laws of Motion) এবং সার্বজনীন মহাকর্ষের সূত্র (Law of Universal Gravitation) দেন।
প্রথম সূত্র: বস্তু স্থির বা সমরেখ গতিতে চলতে থাকবে যতক্ষণ না বাহ্যিক বল তার উপর কাজ করে।
দ্বিতীয় সূত্র: বস্তুর উপর বল প্রয়োগ হলে তার ভর ও ত্বরণের গুণফল সেই বলের সমান হয়। অর্থাৎ
F=ma।
তৃতীয় সূত্র: প্রতিটি ক্রিয়ার সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে।
এই সূত্রগুলোই প্রথমবারের মতো বস্তুগত জগতে চলমান বস্তুর গতি এবং পরিবর্তন বোঝার নির্ভরযোগ্য নিয়ম দেয়। এর মাধ্যমে মানুষের ধারণা সম্পূর্ণ বদলে যায়: পৃথিবীর বস্তু ও মহাজাগতিক পিণ্ড একই নিয়মে চলে – এটি ছিল রেনেসাঁস যুগের বিজ্ঞানকে একীভূত করার এক যুগান্তকারী প্রমাণ।
৩) সার্বজনীন মহাকর্ষের সূত্র
নিউটনের মহাকর্ষের সূত্র বলেছে, দুটি বস্তু একে অপরকে এমন এক আকর্ষণ বলের মাধ্যমে টানে, যা তাদের ভরের গুণফলের সাথে সমানুপাতিক এবং তাদের কেন্দ্রের মধ্যে দূরত্বের বর্গের বিপরীতানুপাতিক:
F=(G×M1×M2)/d²
এখানে, G হলো মহাকর্ষীয় ধ্রুবক। এই সূত্রেই বোঝা যায় কেন পৃথিবী চাঁদকে টেনে রাখে, বা কেন ফল গাছ থেকে মাটিতে পড়ে — কারণ উভয়ই একই মহাকর্ষীয় নিয়মের অধীনে কাজ করছে। এর মাধ্যমে কেবল পৃথিবীর ঘটনাই নয়, সূর্য-গ্রহের গতি, জোয়ার-ভাটা, ধূমকেতুর পথ — সবকিছু ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়।
৪) আলোকবিজ্ঞান
নিউটন আলোকবিজ্ঞানেও বিপ্লব ঘটিয়েছেন। তিনি প্রমাণ করেন যে সাদা আলো আসলে রঙের মিশ্রণ। প্রিজম দিয়ে সূর্যের আলো ভেঙে রঙিন স্পেকট্রাম দেখিয়ে তিনি বোঝান, আলো রঙিন কণার সমষ্টি নয়, বরং ভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের (বা ভিন্ন রঙের) আলোর সংমিশ্রণ।
তিনি প্রতিসরনের (refraction) মাধ্যমে ক্রোম্যাটিক এবেরেশন সমস্যার সমাধান খুঁজতে গিয়ে প্রতিসরক নয়, প্রতিফলক টেলিস্কোপ (Reflecting telescope) আবিষ্কার করেন, যা নিউটনিয়ান টেলিস্কোপ নামে পরিচিত। এ ধরনের টেলিস্কোপে আয়না ব্যবহারে রঙের বিকৃতি কমে যায়, যা জ্যোতির্বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় বড় ভূমিকা রাখে।
৫) জ্যোতির্বিজ্ঞান
নিউটনের মহাকর্ষের সূত্র দিয়েই প্রথম কেপলার প্রদত্ত গ্রহের গতির নিয়মগুলোর গাণিতিক ভিত্তি তৈরি হয়। নিউটনের কাজেই বোঝা যায় কেন গ্রহগুলি সূর্যের চারপাশে উপবৃত্তাকার পথে চলে এবং কিভাবে মহাকর্ষ সেই গতি নিয়ন্ত্রণ করে। এর ফলে জ্যোতির্বিদ্যা একটি পরীক্ষিত, গাণিতিক বিজ্ঞানে পরিণত হয়।
৬) রসায়ন ও অন্যান্য অবদান
নিউটন অ্যালকেমি (জ্যোর্তিসাধন) নিয়েও আগ্রহী ছিলেন। যদিও সেই সময়ে রসায়ন অনেকটাই প্রাচীন বিশ্বাস-রীতিতে আবদ্ধ ছিল, নিউটনের কাজ ভবিষ্যতের রসায়নবিজ্ঞানীদের গবেষণায় প্রভাবিত করেছে। তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকে ধর্মতত্ত্ব পর্যন্ত নানা বিষয়ে গভীর আগ্রহী ছিলেন।
৭) দর্শন ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি
নিউটনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবের একটি হলো বিজ্ঞানের পদ্ধতিগত দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন। তিনি বলেন, “hypotheses non fingo” — অর্থাৎ, অনুমান নয়, পরীক্ষালব্ধ সত্য ও গণিতের মাধ্যমে প্রকৃতিকে বোঝা উচিত। এই মনোভাবই আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ভিত্তি স্থাপন করেছে।
৮) উত্তরাধিকার ও গুরুত্ব
নিউটনের গবেষণা বিজ্ঞানের অনেক শাখায় এক যুগান্তকারী ভিত্তি তৈরি করেছে। আইনস্টাইন তার সাপেক্ষিক তত্ত্বে নিউটনের মহাকর্ষের সীমাবদ্ধতা দেখালেও নিউটনের সূত্র এখনো জ্যোতির্বিজ্ঞান, প্রকৌশল, বস্তুর গতিবিদ্যা ইত্যাদি কাজে অপরিহার্য। তার প্রিন্সিপিয়া গ্রন্থের মতো প্রভাবশালী বই বিজ্ঞানের ইতিহাসে হাতে গোনা।
নিউটনের কাজ প্রমাণ করে যে প্রকৃতিতে শৃঙ্খলা ও নিয়ম রয়েছে, যা গণিতের মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়। এজন্য তাকে “মডার্ন ফিজিক্সের পিতা” বলা হয়। তার কাজের উপর ভিত্তি করেই ১৭-১৮ শতকে “বৈজ্ঞানিক বিপ্লব” (Scientific Revolution) পূর্ণতা পায়।
আমি তানবীন শুভ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 2 সপ্তাহ 6 দিন যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 15 টি টিউন ও 0 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।