প্রাচীনকালের পর্যায়
বিদ্যুতের ধারণা মানুষের কাছে একেবারে নতুন নয়। প্রায় ২৬০০ বছর আগে, প্রাচীন গ্রিসের থেলস অব মিলেটাস প্রথম লক্ষ্য করেন যে, অ্যাম্বার (এক ধরনের ফসিলাইজড রেজিন) পশমের সাথে ঘষলে ছোট ছোট কণাগুলি আকর্ষণ করে। এই পর্যায়ে মানুষ কেবল স্থির বিদ্যুৎ (স্ট্যাটিক ইলেক্ট্রিসিটি) দেখতে পেত, কিন্তু কীভাবে বা কেন এমন হয়, তা বোঝার ক্ষমতা ছিল না।
প্রাচীন মিশর, ভারত ও চীনেও বিদ্যুৎ সম্পর্কিত কিছু প্রাকৃতিক ঘটনার উল্লেখ আছে, যেমন বজ্রপাত, কিন্তু বিজ্ঞান হিসেবে বিদ্যুতের ব্যাখ্যা তখনো দূরের বিষয় ছিল।
১৬-১৭শ শতকের অগ্রগতি
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিদ্যুৎ রহস্যই রয়ে গিয়েছিল। ১৬০০ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী উইলিয়াম গিলবার্ট তার বই De Magnete প্রকাশ করেন। তিনি প্রথম “ইলেকট্রিক” শব্দটি প্রবর্তন করেন (গ্রিক শব্দ ‘ইলেক্ট্রন’ থেকে, যার অর্থ অ্যাম্বার)। গিলবার্টই বিদ্যুতকে চুম্বকত্ব থেকে আলাদা করে দেখান।
১৬৬০ সালে ওটো ভন গেরিকে প্রথম স্ট্যাটিক ইলেক্ট্রিসিটি উৎপাদনের জন্য যন্ত্র তৈরি করেন, যা রোটেটিং সালফার গ্লোব নামে পরিচিত। এই যন্ত্রের সাহায্যে স্পার্ক তৈরি করা যেত।
১৮শ শতকের বিপ্লব
১৮শ শতকে বিদ্যুতের রহস্যময় জগতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটে। ১৭৪৫-৪৬ সালে লেইডেন জার (Leiden jar) উদ্ভাবিত হয়, যা বিদ্যুৎ সংরক্ষণ করতে পারত — এটি ছিল প্রথম ক্যাপাসিটার। এটি দিয়ে মানুষ প্রথম “সংরক্ষিত বিদ্যুৎ” নিয়ে পরীক্ষা করতে পারে।
১৭৫২ সালে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের বিখ্যাত ঘুড়ির পরীক্ষা বিদ্যুতবিজ্ঞানে যুগান্তকারী মুহূর্ত হিসেবে বিবেচিত হয়। তিনি প্রমাণ করেন যে বজ্রপাতও এক ধরনের বৈদ্যুতিক নির্গমন।
১৯শ শতকের আবিষ্কার ও ব্যবহারিক প্রয়োগ
১৯শ শতককে বলা হয় বিদ্যুতের স্বর্ণযুগ। ১৮০০ সালে আলেসান্দ্রো ভোল্টা প্রথম কার্যকর ব্যাটারি “ভোল্টাইক পাইল” তৈরি করেন, যা ধারা বৈদ্যুতিক শক্তির উৎস সরবরাহ করতে পারত। তার নাম অনুসারে ভোল্টেজের একক “ভোল্ট” নামকরণ করা হয়।
১৮২০ সালে হান্স ক্রিশ্চিয়ান ওয়ারস্টেড দেখান যে বিদ্যুৎ ও চুম্বকত্বের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। এই পর্যবেক্ষণ থেকে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজমের ভিত্তি স্থাপিত হয়। এরপর আন্দ্রে-মারি অ্যাম্পিয়ার বৈজ্ঞানিকভাবে এই সম্পর্কের ব্যাখ্যা দেন, এবং তাঁর নামেই “অ্যাম্পিয়ার” ধারা বৈদ্যুতিক প্রবাহের একক।
মাইকেল ফ্যারাডে ১৮৩১ সালে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইনডাকশন আবিষ্কার করেন, যা আধুনিক জেনারেটর ও ট্রান্সফর্মারের ভিত্তি। ফ্যারাডের আবিষ্কার বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন এবং ব্যবহারকে বিপ্লবী পরিবর্তন এনে দেয়।
জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল ১৮৬০-এর দশকে ফ্যারাডে ও অন্যান্যদের কাজকে গাণিতিকভাবে সংহত করে তার “ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ” তৈরি করেন, যা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজমের পূর্ণ তাত্ত্বিক ভিত্তি গড়ে তোলে।
বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু
টমাস এডিসন ১৮৭৯ সালে বাল্বের ব্যবহারিক সংস্করণ তৈরি করেন, যা বিদ্যুৎকে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে নিয়ে আসে। তিনি ১৮৮২ সালে নিউইয়র্কে প্রথম বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা চালু করেন।
একই সময়ে, নিকোলা টেসলা ও জর্জ ওয়েস্টিংহাউস বিকল্প প্রবাহ (AC) পদ্ধতিকে উন্নত করেন। এডিসন সরাসরি প্রবাহ (DC) ব্যবস্থার পক্ষে ছিলেন, কিন্তু টেসলার AC সিস্টেম দূরত্বে শক্তি পরিবহণের জন্য বেশি কার্যকর প্রমাণিত হয়। এই বিতর্ক “কারেন্টের যুদ্ধ” (War of Currents) নামে ইতিহাসে পরিচিত। শেষ পর্যন্ত টেসলার AC পদ্ধতি বিশ্বব্যাপী বিদ্যুৎ বিতরণের মানদণ্ড হয়ে দাঁড়ায়।
২০শ শতক ও আধুনিক যুগ
২০শ শতকে বিদ্যুতের ব্যবহার বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা, জলবিদ্যুৎ, পারমাণবিক শক্তি ও পরে নবায়নযোগ্য শক্তির (সৌর, বায়ু) সংযোজন ঘটে।
১৯৫০-এর দশকে মাইক্রোইলেক্ট্রনিক্স ও ট্রানজিস্টরের আবিষ্কার ইলেক্ট্রনিক্স বিপ্লবের সূচনা করে। বিদ্যুত শুধু আলো বা শক্তির জন্য নয়, তথ্য প্রযুক্তি ও যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে ওঠে।
কম্পিউটার, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, রোবোটিকস ইত্যাদি বিদ্যুতনির্ভর প্রযুক্তির বিকাশ বিদ্যুতের প্রয়োগকে বৈপ্লবিক পর্যায়ে নিয়ে গেছে। বর্তমানে বিশ্বের ৮০%-এর বেশি মানুষ বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে, যা আধুনিক সভ্যতার মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করছে।
বিদ্যুতের সমাজ ও অর্থনীতিতে প্রভাব
বিদ্যুৎ শিল্প, কৃষি, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, পরিবহনসহ প্রায় প্রতিটি খাতে অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বিদ্যুৎ ছাড়া আধুনিক জীবন কল্পনাই করা যায় না।
উপসংহার
বিদ্যুৎ মানবসভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলির একটি। প্রাচীন যুগের স্ট্যাটিক ইলেক্ট্রিসিটির পর্যবেক্ষণ থেকে শুরু করে আজকের জটিল পাওয়ার গ্রিড ও মাইক্রোইলেক্ট্রনিক্স পর্যন্ত বিদ্যুতের ইতিহাস মানব চিন্তার এক অনন্য অভিযাত্রা।
ভবিষ্যতে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, শক্তি সঞ্চয়ের উন্নত প্রযুক্তি, স্মার্ট গ্রিড, এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রিক পরিবহন ব্যবস্থার বিকাশ বিদ্যুতের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে, যা আমাদের পৃথিবী
কে আরও পরিবেশবান্ধব ও টেকসই করতে সাহায্য করবে।
আমি তানবীন শুভ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 1 সপ্তাহ 5 দিন যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 15 টি টিউন ও 0 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।