বিজ্ঞানী নিকোলাউস কোপার্নিকাসের (Nicolaus Copernicus) অবদান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
নিকোলাউস কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩) ছিলেন রেনেসাঁ যুগের একজন পোলিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী, গণিতবিদ, ধর্মযাজক ও বহুমুখী জ্ঞানী, যিনি মানব ইতিহাসের অন্যতম বৈপ্লবিক ধারণা – সূর্যকেন্দ্রিক (হেলিওসেন্ট্রিক) মহাবিশ্ব মডেল – প্রবর্তনের জন্য বিখ্যাত। কোপার্নিকাসের অবদান শুধু জ্যোতির্বিজ্ঞানের দিকেই সীমাবদ্ধ নয়; তার কাজ বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের (Scientific Revolution) সূচনা করে, যা আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তি গড়ে তোলে।
পটভূমি ও প্রাথমিক জীবন
কোপার্নিকাস পোল্যান্ডের তৎকালীন রয়েল প্রুশিয়ার টরুন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি গণিত, চিকিৎসা, আইন, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব ও অর্থনীতিতে শিক্ষালাভ করেন। তিনি পাদ্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। জীবদ্দশায় তার মূল পেশা ছিল চার্চ প্রশাসন ও আইনকাজ দেখা, কিন্তু তার শখ ও গবেষণার প্রধান ক্ষেত্র ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞান।
প্রাক-কোপার্নিকাস যুগের মহাবিশ্বের ধারণা
কোপার্নিকাসের আগে টলেমি প্রবর্তিত ভূপৃষ্ঠকেন্দ্রিক (জিওসেন্ট্রিক) মডেলই ছিল প্রচলিত। টলেমির মডেল অনুসারে, পৃথিবী ছিল মহাবিশ্বের কেন্দ্র, এবং সূর্য, চাঁদ ও সব গ্রহ পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে। এই ধারণা প্রায় ১৪০০ বছর ধরে ইউরোপ ও ইসলামী বিশ্বে প্রচলিত ছিল এবং ক্যাথলিক চার্চও এটিকে অনুমোদন করেছিল।
তবে টলেমি মডেল জটিল ও অদ্ভুত সব উপাদান নিয়ে গঠিত ছিল, যেমন “এপিসাইকেল” ও “ডিফারেন্ট” – এগুলো বিভিন্ন গ্রহের অনিয়মিত গতিকে বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হত। তবু এই মডেল প্রকৃত পর্যবেক্ষণকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পারছিল না, এবং গ্রহগুলোর গতিবিধির ক্ষেত্রে ক্রমশ অনেক অমিল দেখা যাচ্ছিল।
কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক মডেল
কোপার্নিকাস ১৫১০ সালের দিকে তার গবেষণা শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে একটি বিপরীতধর্মী ধারণা দাঁড় করান। তিনি বলেন:
মহাবিশ্বের কেন্দ্রে পৃথিবী নয়, বরং সূর্য অবস্থান করছে।
পৃথিবী সহ অন্যান্য গ্রহ সূর্যের চারপাশে নির্দিষ্ট কক্ষে ঘোরে।
পৃথিবী নিজ অক্ষে আবর্তিত হয়, ফলে দিনের ও রাতের পরিবর্তন ঘটে।
পৃথিবীর কক্ষপথে সূর্যের চারপাশে ঘূর্ণনের কারণে ঋতুর পরিবর্তন ঘটে।
তার প্রধান কাজ “De revolutionibus orbium coelestium” (On the Revolutions of the Heavenly Spheres) নামক বই, যা ১৫৪৩ সালে, তার মৃত্যুর ঠিক আগে প্রকাশিত হয়। এই বইতেই তিনি হেলিওসেন্ট্রিক তত্ত্বের পূর্ণ ব্যাখ্যা ও গণিতসম্মত বিশ্লেষণ দেন। তিনি গ্রহের গতি ব্যাখ্যার জন্য বৃত্তাকার কক্ষপথ ব্যবহার করেছিলেন, যা পরবর্তীতে জোহান কেপলার উপবৃত্তাকার কক্ষপথ দিয়ে সংশোধন করেন।
কোপার্নিকাসের তত্ত্বের বৈপ্লবিক দিক
১) মানবকেন্দ্রিক ধারণার অবসান: কোপার্নিকাস দেখালেন যে পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয়; এতে মানুষের মহাবিশ্বে ‘বিশেষ’ অবস্থানের ধারণা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।
২) বিজ্ঞানের প্রগতি ত্বরান্বিত করা: তার মডেল জ্যোতির্বিজ্ঞানের জটিলতা অনেকাংশে দূর করে পর্যবেক্ষণ ও গণনায় সামঞ্জস্য আনে, যা পরবর্তী বিজ্ঞানীদের কাজের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
৩) পর্যবেক্ষণ ও যুক্তির সমন্বয়: তিনি পর্যবেক্ষণ এবং গণিত ব্যবহার করে নিখুঁতভাবে তার মডেল ব্যাখ্যা করেন, যা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির (scientific method) বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।
কোপার্নিকাসের কাজের প্রভাব
কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্ব তখনকার সমাজ ও চার্চের কাছে সহজে গ্রহণযোগ্য ছিল না। প্রথম দিকে খুব সীমিত সংখ্যক পণ্ডিতই তার ধারণার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে গ্যালিলিও গ্যালিলি, টাইকো ব্রাহে, জোহান কেপলার এবং স্যার আইজ্যাক নিউটন কোপার্নিকাসের মডেলকে ভিত্তি করে জ্যোতির্বিজ্ঞানকে এগিয়ে নেন।
গ্যালিলিও গ্যালিলি দূরবীক্ষণ (telescope) ব্যবহার করে পর্যবেক্ষণিক প্রমাণ হাজির করেন যা সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্বের পক্ষে যায়, যেমন বৃহস্পতির উপগ্রহগুলোর আবিষ্কার, যা দেখায় সব কিছু পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে না।
জোহান কেপলার কোপার্নিকাসের মডেলের উন্নতি করে গ্রহের কক্ষপথ যে উপবৃত্তাকার, তা প্রমাণ করেন।
আইজ্যাক নিউটন মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব দিয়ে কোপার্নিকাস-কেপলার মডেলের কারণগত ব্যাখ্যা দেন, যা আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি গড়ে তোলে।
অন্যান্য অবদান
কোপার্নিকাস অর্থনীতি নিয়েও গবেষণা করেছেন। তিনি “Gresham’s Law”-এর পূর্বাভাস দেন, যেখানে খারাপ মুদ্রা ভালো মুদ্রাকে বাজার থেকে বের করে দেয় (bad money drives out good)।
তিনি ক্যালেন্ডার সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও মত প্রকাশ করেন, যা পরে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার রূপে বাস্তবায়িত হয়।
প্রশাসনিক দক্ষতা ও আইনজ্ঞ হিসেবে তার অবদান পোল্যান্ডের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
কোপার্নিকাস ও চার্চের সম্পর্ক
মজার বিষয় হলো, জীবদ্দশায় কোপার্নিকাসকে সরাসরি খুব বেশি বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয়নি। মৃত্যুর পরে যখন গ্যালিলিও তার ধারণার পক্ষে শক্তিশালী প্রমাণ হাজির করেন, তখন চার্চ তা হুমকি হিসেবে দেখতে শুরু করে। ১৬১৬ সালে কোপার্নিকাসের বইকে “সংশোধন” না হওয়া পর্যন্ত নিষিদ্ধ তালিকায় রাখা হয়, কিন্তু এই বই এবং ধারণা ততদিনে ইউরোপের শিক্ষিত সমাজে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে।
উপসংহার
কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক মডেল মানবজাতির জ্ঞানের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী মাইলফলক। তার ধারণা আমাদের স্থান ও মহাবিশ্বের প্রকৃতি সম্পর্কে প্রাচীন ভুল ধারণা ভেঙে দেয়, মানুষের চিন্তাধারার আমূল পরিবর্তন ঘটায় এবং বিজ্ঞানের পদ্ধতিগত ভিত্তি স্থাপন করে। তার কাজই ছিল বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের প্রথম স্ফুলিঙ্গ, যা পরবর্তীতে পুরো ইউরোপ এবং মানব সভ্যতার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে দেয়। এজন্যই কোপার্নিকাসকে বলা হয় – “The father of modern astronomy”।
আমি তানবীন শুভ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 1 সপ্তাহ 5 দিন যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 15 টি টিউন ও 0 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।