বিজ্ঞানী আর্কিমিডিস আয়না ব্যবহার করে যেভাবে যুদ্ধজাহাজে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন

আর্কিমিডিসের এই বিখ্যাত “আর্কিমিডিসের তাপ রশ্মি” বা “আর্কিমিডিসের মৃত্যু-আয়না” সংক্রান্ত কাহিনী ইতিহাস, বিজ্ঞানের ধারণা, এবং কিংবদন্তির মিশ্রণ — যা আজও মানুষের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু। নিচে এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ, এবং এর সত্যতা নিয়ে বিতর্কসহ বিস্তারিত আলোচনা করা হলোঃ

 

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দীতে গ্রিক বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও প্রকৌশলী আর্কিমিডিস সিরাকিউজ শহরে (বর্তমানে সিসিলি দ্বীপ, ইতালি) বাস করতেন। সে সময় সিরাকিউজ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দরনগরী এবং কার্থেজ বা রোমানদের আক্রমণের ঝুঁকিতে থাকত। ইতিহাসের নানা লেখায় উল্লেখ আছে, রোমানরা যখন সমুদ্রপথে সিরাকিউজ আক্রমণ করে, তখন শহর রক্ষার জন্য আর্কিমিডিস অজস্র রণকৌশল উদ্ভাবন করেন — তার মধ্যে অন্যতম ছিল “গোলীয় আয়নার সাহায্যে শত্রু যুদ্ধজাহাজে আগুন ধরানো”।

 

প্রাচীন ঐতিহাসিক লুইকিয়ান, গালেন এবং পরে বাইজান্টাইন ইতিহাসবিদ জোহানেস জোনিয়াস উল্লেখ করেছেন, আর্কিমিডিস অনেক আয়না একসাথে সাজিয়ে সূর্যের আলোকে একটি বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত করতেন। এই কেন্দ্রীভূত তীব্র তাপরশ্মি শত্রু জাহাজের কাঠের কাঠামোতে ফোকাস করলে আগুন ধরে যেত।

 

বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ

আর্কিমিডিস কীভাবে এই “গোলীয় আয়না” বা “মৃত্যু-আয়না” ব্যবহার করেছিলেন, তা বোঝার জন্য কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট করা দরকার:

 

১. গোলীয় আয়না কী?

একটি অবতল বা গোলীয় আয়না হলো এমন একটি আয়না যা ভিতরের দিকে বাঁকানো। সূর্যের সমান্তরাল রশ্মি এই আয়নায় পড়লে সব রশ্মি প্রতিসরিত হয়ে ফোকাস পয়েন্টে এসে মিলে যায়। ফলে সেই ফোকাস পয়েন্টে অত্যন্ত উচ্চ তাপমাত্রা তৈরি হয়।

 

২. কতটা তাপ উৎপন্ন হতে পারে?

যদি আর্কিমিডিস অনেক আয়না একসাথে ব্যবহার করেন, যেমন শতাধিক ব্রোঞ্জ বা পালিশ করা ধাতব আয়না, সেগুলো ঠিকমতো এক পয়েন্টে সূর্যের আলো কেন্দ্রীভূত করলে কয়েকশ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপ তৈরি হতে পারে — যা শুষ্ক কাঠ বা পিচে মোড়ানো জাহাজের কাঠামো সহজেই জ্বালিয়ে দিতে সক্ষম।

 

৩. প্রয়োগের জটিলতা

 

শতাধিক সৈনিককে একসাথে আয়না ধরে নির্দিষ্ট পয়েন্টে ফোকাস করতে হত।

 

সূর্যের তীব্র আলো নির্দিষ্ট কোণে প্রয়োজন, তাই সময়-কাল নির্দিষ্ট (স্পষ্ট দিনের দুপুরে)।

 

শত্রু জাহাজও স্থির থাকতে হবে, যা বাস্তব যুদ্ধে প্রায় অসম্ভব।

 

বাতাস বা ঢেউয়ের কারণে নৌকা দুললে ফোকাস দ্রুত বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।

 

আধুনিক পরীক্ষায় কী দেখা গেছে?

কিংবদন্তির সত্যতা যাচাই করতে বিভিন্ন সময়ে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা চালিয়েছেন:

 

১৯৭৩ সালে গ্রিক বিজ্ঞানী ইওয়ানিস সাকারিয়াডিস ও MIT (Massachusetts Institute of Technology) এর এক দল শিক্ষার্থী ৭০টি আয়না ব্যবহার করে একটি কাঠের জাহাজের অংশে সূর্যের আলো ফোকাস করে সফলভাবে আগুন ধরান। তবে তারা এটাও জানান, এর জন্য স্থির জাহাজ, পরিষ্কার আবহাওয়া ও সময়সাপেক্ষ প্রচেষ্টা প্রয়োজন — যা বাস্তব যুদ্ধে কার্যকর নাও হতে পারে।

 

২০০৫ সালে MythBusters টিভি শোতেও এ নিয়ে পরীক্ষা হয়; তারা শতাধিক আয়না ব্যবহার করে, তবে নড়াচড়া করা টার্গেটে আগুন ধরাতে ব্যর্থ হন। ফলস্বরূপ তারা আর্কিমিডিসের “মৃত্যু-আয়না”কে “মিথ” আখ্যা দেন। তবে কিছু বিজ্ঞানী যুক্তি দেন, MythBustersের শর্তে সূর্যের কোণ ও আয়নার মান যথেষ্ট ছিল না।

 

এই প্রযুক্তির কার্যকারিতা নিয়ে বিতর্ক

পক্ষে যুক্তি:

 

আর্কিমিডিস ছিলেন জ্যামিতি, আলোকবিদ্যা ও প্রতিসরণ তত্ত্বে পারদর্শী।

 

তার সময়ে পালিশ করা ব্রোঞ্জ আয়না তৈরি করা সম্ভব ছিল।

 

শত্রু সৈন্যদের আতঙ্কিত করতে এবং মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করতে এর প্রয়োগ কার্যকর হতে পারত, এমনকি জাহাজ না জ্বললেও তারা বিভ্রান্ত হতে পারত।

 

বিপক্ষে যুক্তি:

 

জাহাজ স্থির না থাকায় ফোকাস করা কঠিন।

 

তৎকালীন প্রযুক্তিতে আয়নার পৃষ্ঠ যথেষ্ট মসৃণ ও সমতল করা সম্ভব কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ।

 

দিনের নির্দিষ্ট সময় ও আবহাওয়া-নির্ভর — যা যুদ্ধক্ষেত্রে অনিশ্চিত।

 

এর তাৎপর্য ও আজকের শিক্ষা

কিংবদন্তি সত্য হোক বা না হোক, আর্কিমিডিসের “গোলীয় আয়না” ধারণা মানব ইতিহাসে প্রমাণ করে, প্রাচীন বিজ্ঞানীরা কীভাবে প্রকৃতির শক্তিকে যুদ্ধ বা প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে ব্যবহার করার চিন্তা করেছিলেন। এ থেকে আজকের লেন্স, সৌর কুকার বা সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রযুক্তির বিকাশে অনুপ্রেরণা পাওয়া যায় — যেখানে সূর্যের আলো ফোকাস করে কার্যকর তাপ বা শক্তি উৎপাদন করা হয়।

 

উপসংহার

আর্কিমিডিসের “মৃত্যু-আয়না” নিয়ে গল্প হয়তো সম্পূর্ণরূপে ঐতিহাসিক সত্য নয়, তবে তার বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি অস্বীকার করা যায় না। এই কিংবদন্তি প্রমাণ করে মানুষ কত প্রাচীনকাল থেকে আলোর প্রতিসরণ, প্রতিফলন ও ফোকাস নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করেছে। এ ধারণা আধুনিক প্রযুক্তির ভিত্তি স্থাপনেও ভূমিকা রেখেছে, এবং আর্কিমিডিসের মতো বিজ্ঞানীর সৃষ্টিশীলতা আজও বিশ্বকে বিস্মিত করে।

Level 1

আমি তানবীন শুভ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 1 সপ্তাহ 5 দিন যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 15 টি টিউন ও 0 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস