হেনরি লুইস লা-শাতেলিয়ার: আধুনিক রসায়নের পথপ্রদর্শক
রসায়নবিদ্যা এমন এক শাখা, যেখানে কিছু নীতি ও সূত্র যুগ যুগ ধরে বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে মৌলিক ভূমিকা রেখে আসছে। তেমনি একজন কিংবদন্তি বিজ্ঞানী ছিলেন হেনরি লুইস লা-শাতেলিয়ার (Henri Louis Le Chatelier), যিনি তার অমর “লা-শাতেলিয়ার নীতি”-র মাধ্যমে বিশ্ব রসায়নে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে দিয়েছিলেন।
জীবন ও প্রাথমিক শিক্ষা
হেনরি লুইস লা-শাতেলিয়ার জন্মগ্রহণ করেন ১৮৫০ সালের ৮ই অক্টোবর ফ্রান্সের প্যারিসে। তার পিতা লুইস লা-শাতেলিয়ার ছিলেন একজন বিশিষ্ট প্রকৌশলী, যিনি তাকে ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জগতে উৎসাহিত করেছিলেন। হেনরি প্রথমে École Polytechnique-এ এবং পরে École des Mines-এ অধ্যয়ন করেন। পড়াশোনার শুরুতে প্রকৌশলবিদ্যার প্রতি তার ঝোঁক থাকলেও ধীরে ধীরে রসায়নেই তিনি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করেন।
পেশাগত জীবন ও গবেষণা
লা-শাতেলিয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে ফ্রান্সের খনি শিল্পে কাজ করতেন। সেখানে কাজের সূত্রে তিনি ধাতব পদার্থের রাসায়নিক প্রক্রিয়া, উঁচু তাপমাত্রায় রাসায়নিক বিক্রিয়ার চরিত্র ইত্যাদি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। এখান থেকেই তার মূল অবদান রসায়নে প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৮৮৮ সালে তিনি সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নের অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পান এবং পরবর্তী কয়েক দশক ধরে রসায়নের বিভিন্ন শাখায় গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা চালিয়ে যান। তিনি উচ্চ তাপমাত্রায় পদার্থের রাসায়নিক পরিবর্তন এবং শিল্প উৎপাদনে এই প্রক্রিয়ার ব্যবহার নিয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন।
লা-শাতেলিয়ার নীতি
তার সবচেয়ে বড় অবদান হলো লা-শাতেলিয়ার নীতি (Le Chatelier’s Principle), যা ১৮৮৪ সালে প্রকাশিত হয়। এই নীতি অনুযায়ী,
“যদি কোনো সমীকরণে ভারসাম্য স্থিতির ওপর বাহ্যিক পরিবর্তন (যেমন চাপ, তাপমাত্রা, ঘনত্ব) প্রয়োগ করা হয়, তবে সমীকরণ সেই পরিবর্তনের প্রভাবকে প্রতিহত করার মতো দিকে সরে যাবে। ”
অর্থাৎ, বিক্রিয়া এমনভাবে পরিবর্তিত হবে যাতে প্রয়োগকৃত চাপ বা পরিবর্তনের বিরোধিতা হয় এবং পুনরায় ভারসাম্য স্থাপন হয়।
উদাহরণস্বরূপ,
যদি একটি গ্যাসীয় সমীকরণে চাপ বাড়ানো হয়, তবে বিক্রিয়া এমন দিকে যাবে যেখানে গ্যাসের অণুর সংখ্যা কমে।
তাপমাত্রা বাড়ালে বিক্রিয়া এমন দিকে যাবে যা সেই বাড়তি তাপ শোষণ করে (এন্ডোথারমিক)।
বিপরীতে, তাপমাত্রা কমালে বিক্রিয়া এক্সোথারমিক দিকে অগ্রসর হয়।
শিল্পে লা-শাতেলিয়ার নীতির প্রয়োগ
লা-শাতেলিয়ার নীতির সবচেয়ে কার্যকর প্রয়োগ দেখা যায় অ্যামোনিয়া উৎপাদনের হাবার প্রক্রিয়ায়, যেখানে নাইট্রোজেন ও হাইড্রোজেনের বিক্রিয়া থেকে অ্যামোনিয়া তৈরি হয়। বিক্রিয়াটি উচ্চ চাপ ও কম তাপমাত্রায় অ্যামোনিয়ার উৎপাদন বাড়ায়—এটি লা-শাতেলিয়ার নীতির সরাসরি প্রয়োগ।
এছাড়াও সালফিউরিক অ্যাসিড, নাইট্রিক অ্যাসিড উৎপাদন প্রভৃতি শিল্পপ্রক্রিয়ায়ও এই নীতি অপরিহার্য। রসায়নশিল্প ছাড়াও, ধাতুবিদ্যা, সিমেন্ট শিল্প, সিরামিক, এবং বিভিন্ন জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় এই নীতি কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
অন্যান্য অবদান
লা-শাতেলিয়ার শুধুমাত্র থিওরিটিক্যাল রসায়নেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, তিনি শিল্পের কার্যকর উন্নতিতেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন।
তিনি উচ্চ তাপমাত্রার পাইরোমেট্রি (উচ্চ তাপমাত্রা মাপার যন্ত্র) উন্নত করেন।
খনিজ ও ধাতু প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রক্রিয়াগুলি আরও দক্ষ করার বিভিন্ন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন।
থার্মোকেমিস্ট্রি, গ্যাসের দ্রাব্যতা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও তিনি মৌলিক গবেষণা করেন।
সমাজে প্রভাব ও সম্মাননা
লা-শাতেলিয়ার তার সময়ের অন্যতম প্রভাবশালী বিজ্ঞানী ছিলেন। তিনি ফরাসি একাডেমি অফ সায়েন্সের সদস্য নির্বাচিত হন এবং ফরাসি সরকার থেকে সম্মানসূচক পুরস্কার লাভ করেন। তার গবেষণার কারণে ফ্রান্সের রাসায়নিক শিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে, যা দেশটির অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।
ব্যক্তিগত জীবন ও মৃত্যুবরণ
লা-শাতেলিয়ার ছিলেন সাদাসিধে জীবনযাপনের একজন মানুষ। বিজ্ঞান ও শিল্প নিয়ে গভীর মনোযোগের পাশাপাশি তিনি শিক্ষাদানকেও গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। ১৯৩৬ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পরও তার নীতি ও গবেষণার প্রভাব এখনো রসায়নশাস্ত্রে অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে।
উপসংহার
হেনরি লুইস লা-শাতেলিয়ারের অবদান শুধু তাত্ত্বিক রসায়নে নয়, শিল্প ও প্রযুক্তির উন্নতিতেও অসামান্য। তার “লা-শাতেলিয়ার নীতি” রসায়নশাস্ত্রের অন্যতম মৌলিক ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। বিভিন্ন শিল্পপ্রক্রিয়ায় প্রতিদিন এই নীতির ব্যবহার প্রমাণ করে যে, বিজ্ঞানের প্রকৃত সেবা কখনো সময়ের সাথে পুরানো হয় না।
লা-শাতেলিয়ারের কাজ আমাদের শেখায় যে প্রকৃতি সবসময় ভারসাম্য রক্ষা করতে চায়, আর এই নীতি বোঝার মাধ্যমে মানুষও প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তি ও শিল্পকে আরও উন্নত করতে পারে। তাই হেনরি লুইস লা-শাতেলিয়ার কেবল একজন বিজ্ঞানী ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন রসায়নের ইতিহাসে এক অনন্য পথপ্রদর্শক।
আমি তানবীন শুভ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 1 সপ্তাহ 5 দিন যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 15 টি টিউন ও 0 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।