প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষা
সভাল্টে অগাস্ট আরহেনিয়াস ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৮৫৯ সালে সুইডেনের উপসালা শহরের কাছে বিক (Vik) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই তার গণিত ও বিজ্ঞানের প্রতি গভীর আগ্রহ ছিল। আরহেনিয়াসের প্রতিভা এতটাই প্রকট ছিল যে তিনি মাত্র তিন বছর বয়সেই নিজের নাম লেখতে এবং জটিল সংখ্যা গাণিতিক হিসাব করতে পারতেন। ১৮৭৬ সালে তিনি উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন।
বৈজ্ঞানিক অবদান
আরহেনিয়াস রসায়নের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তার প্রধান আবিষ্কারগুলির মধ্যে রয়েছে আয়নিক বিচ্ছিন্নতা তত্ত্ব (Ionic Dissociation Theory)। ১৮৮৪ সালে প্রকাশিত তার পিএইচডি থিসিসে তিনি প্রথম প্রমাণ দেন যে লবণ, অ্যাসিড বা ক্ষার পানিতে দ্রবীভূত হলে তারা আয়ন আকারে বিচ্ছিন্ন হয়, যা বৈদ্যুতিক পরিবাহিতা সৃষ্টি করে। এই তত্ত্বের মাধ্যমে তিনি ইলেক্ট্রোলাইটিক দ্রবণের আচরণ ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হন, যা পরে রসায়নে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে।
প্রাথমিকভাবে আরহেনিয়াসের এই তত্ত্ব উপেক্ষিত হয়েছিল। উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষকরা তার কাজকে "অতিরিক্ত ধারণাপ্রধান" হিসেবে খারিজ করতে চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত জুরির চাপে তাকে পাস করানো হলেও তাকে সর্বনিম্ন গ্রেড দেওয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে জার্মান রসায়নবিদ ভিলহেলম অস্টওয়াল্ড ও ইয়াকব ভ্যান’ট হফ তার তত্ত্বের মুল্য উপলব্ধি করেন এবং এর যথাযথ স্বীকৃতি দেন।
আরহেনিয়াস সমীকরণ
আরেকটি যুগান্তকারী অবদান হলো আরহেনিয়াস সমীকরণ (Arrhenius Equation)। ১৮৮৯ সালে প্রকাশিত এই সমীকরণে তিনি দেখান যে রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতি (reaction rate) তাপমাত্রার উপর নির্ভরশীল এবং তা একটি সূচকীয় সম্পর্কের মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়:
k=Ae−EaRT
k=Ae−RTEa
এখানে,
k
k হলো বিক্রিয়ার গতির ধ্রুবক,
A
A হলো প্রাক-গুণক (frequency factor),
E
a
E
a
হলো সক্রিয়করণ শক্তি (activation energy),
R
R হলো গ্যাস ধ্রুবক,
T
T হলো কেলভিন তাপমাত্রা।
এই সমীকরণ রাসায়নিক কাইনেটিক্সের ভিত্তি স্থাপন করেছে এবং আধুনিক রসায়নে তা অমোঘ নিয়ম হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
পরিবেশবিজ্ঞান ও গ্লোবাল ওয়ার্মিং
আরহেনিয়াস বিজ্ঞানের আরেকটি শাখায়, পরিবেশবিজ্ঞানে, অগ্রণী ছিলেন। ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত তার গবেষণায় তিনি প্রথম দেখিয়েছিলেন যে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO₂)-এর ঘনত্ব বৃদ্ধি করলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বাড়তে পারে — যা বর্তমান বৈশ্বিক উষ্ণায়নের (global warming) ধারণার প্রথম বৈজ্ঞানিক ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। এই কাজের জন্য অনেকেই তাকে “গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের জনক” বলে আখ্যায়িত করেন।
নোবেল পুরস্কার ও অন্যান্য স্বীকৃতি
রসায়নে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সভাল্টে আরহেনিয়াস ১৯০৩ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। এই নোবেল পুরস্কার ছিল তার আয়নিক বিচ্ছিন্নতা তত্ত্বের জন্য। এছাড়াও তিনি রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অফ সায়েন্সেসের সদস্য, লন্ডন রয়্যাল সোসাইটির ফেলো এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানের সম্মানিত সদস্য ছিলেন।
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড
আরহেনিয়াস সুইডেনের প্রথম নোবেল ইনস্টিটিউটের (Nobel Institute for Physical Chemistry) প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন। তিনি নোবেল কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবেও কাজ করেছেন এবং নোবেল পুরস্কার প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এছাড়াও তিনি বহু বিজ্ঞানপত্র ও বই রচনা করেছেন, যা জনসাধারণের কাছে বিজ্ঞানকে সহজভাবে বোঝাতে সহায়ক হয়েছে। তার লেখা “Worlds in the Making” বইতে তিনি কসমোলজি ও জীবন উৎপত্তি নিয়ে ধারণা দেন, যা বিজ্ঞানমনস্ক সাধারণ পাঠকদের মধ্যেও বেশ জনপ্রিয় হয়।
ব্যক্তিগত জীবন
আরহেনিয়াসের ব্যক্তিগত জীবনেও বৈচিত্র্য ছিল। তিনি দুইবার বিবাহিত হন এবং তার দুই সন্তান ছিল। আরহেনিয়াস ছিলেন অসাধারণ সামাজিক; বিজ্ঞান প্রচার ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধিতে তিনি সক্রিয় ছিলেন। তিনি বিশ্বশান্তি আন্দোলনেও সমর্থন জানিয়েছিলেন, কারণ বিজ্ঞানকে তিনি মানবকল্যাণের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে বিশ্বাস করতেন।
মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
সভাল্টে আরহেনিয়াস ১৯ অক্টোবর, ১৯২৭ সালে সুইডেনের স্টকহোমে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি প্রায় ৬৮ বছর বয়স পর্যন্ত বিজ্ঞান সাধনায় নিয়োজিত ছিলেন। মৃত্যুর পরেও তার অবদান বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং পরিবেশবিজ্ঞান অঙ্গনে অমর হয়ে আছে। আজকের আধুনিক রসায়ন, পরিবেশ বিজ্ঞান ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে গবেষণার ভিত্তি স্থাপন করেছেন তিনি।
উপসংহার
সভাল্টে অগাস্ট আরহেনিয়াস ছিলেন বিজ্ঞান জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যার অবদান আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। আয়নিক তত্ত্ব থেকে শুরু করে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ধারণা পর্যন্ত তার উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা বিজ্ঞানের অনেক শাখায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। তার মতো বিজ্ঞানীর কারণে মানব সভ্যতা বিজ্ঞানের মাধ্যমে প্রকৃতিকে আরও ভালোভাবে বুঝতে শিখেছে।
আমি তানবীন শুভ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 1 সপ্তাহ 5 দিন যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 15 টি টিউন ও 0 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।