পরমাণু তত্ত্ব বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ধাপ। আধুনিক রসায়নের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন ইংরেজ বিজ্ঞানী জন ডাল্টন (John Dalton, 1766–1844)। তার প্রস্তাবিত পরমাণু তত্ত্ব পদার্থবিজ্ঞানের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে, যা রাসায়নিক বিক্রিয়ার ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হয়েছিল। ১৮০৩ সালে ডাল্টন যখন এই তত্ত্ব প্রকাশ করেন, তখন রসায়ন জগতে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা ছিল না যে পদার্থের ক্ষুদ্রতম একক কেমন হতে পারে।
ডাল্টনের মূল অবদান ছিল ধারণা করা যে প্রতিটি মৌলিক পদার্থ ক্ষুদ্র, অদৃশ্য কণিকা বা "অ্যাটম"-এর (atom) দ্বারা তৈরি এবং এই কণিকাগুলি প্রতিটি মৌলের জন্য নির্দিষ্ট ভর এবং আকারের হয়। তার তত্ত্বকে প্রধানত ৫টি মূল ধারায় ভাগ করা যায়:
১) প্রতিটি মৌলিক পদার্থ ক্ষুদ্র পরমাণুর সমষ্টি।
২) একই মৌলের সব পরমাণুর ভর এবং গুণাবলী অভিন্ন।
৩) ভিন্ন মৌলের পরমাণুর ভর ও বৈশিষ্ট্য এক নয়।
৪) রাসায়নিক বিক্রিয়ার সময় পরমাণু তৈরি হয় না বা নষ্ট হয় না, কেবল পুনর্বিন্যাস হয়।
৫) যৌগ (compound) গঠিত হয় দুই বা ততোধিক মৌলের পরমাণু একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে যুক্ত হলে।
এই ধারণাগুলি সেই সময়ের রসায়নকে বিপ্লবের মুখোমুখি দাঁড় করায়। কারণ এটি সহজভাবে ব্যাখ্যা করেছিল কেন রাসায়নিক বিক্রিয়ায় কিছু পদার্থ নির্দিষ্ট অনুপাত মেনে বিক্রিয়া করে এবং কেন ভর সংরক্ষিত থাকে। উদাহরণ হিসেবে, জল (H₂O) তৈরি হয় নির্দিষ্ট হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের অনুপাতে—যা ডাল্টনের তত্ত্ব দারুণভাবে ব্যাখ্যা করে।
ডাল্টনকে “আধুনিক পরমাণু তত্ত্বের জনক” বলা হয়। তার গবেষণার মাধ্যমে মেঘের বাষ্পচাপ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি প্রথম এই ধারণায় পৌঁছান যে গ্যাসগুলোর মিশ্রণকে ভিন্ন ভিন্ন গ্যাসের কণার দ্বারা বোঝা যায়। এখান থেকেই পরমাণু ধারণার আরও বিজ্ঞানসম্মত রূপ পায়।
ডাল্টনের সাফল্যের দিকগুলো
১) পরমাণুর ধারণা প্রতিষ্ঠা
ডাল্টনের আগে গ্রিক দার্শনিকদের পরমাণু ধারণা থাকলেও তা ছিল দার্শনিক পর্যায়ে, বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছাড়া। ডাল্টনই প্রথম একে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন, পরীক্ষালব্ধ তথ্য দিয়ে সমর্থন করেন এবং গাণিতিকভাবে ব্যাখ্যা করেন।
২) রাসায়নিক বিক্রিয়ার ব্যাখ্যা
তার তত্ত্বে ব্যাখ্যা করা হয়েছে কেন কিছু মৌল নির্দিষ্ট অনুপাতে যুক্ত হয়। উদাহরণস্বরূপ, কার্বন মনোক্সাইড (CO) এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO₂) দুইটিতেই কার্বন ও অক্সিজেন রয়েছে, কিন্তু তাদের ভিন্ন অনুপাতের কারণে দুটি ভিন্ন যৌগ তৈরি হয়। ডাল্টনের তত্ত্ব এ ধরনের সমস্যার সহজ ব্যাখ্যা দেয়।
৩) পরমাণু ভর নির্ণয়ের সূচনা
ডাল্টন প্রথম পরমাণু ভর নির্ণয়ের চেষ্টা করেন এবং আনুমানিক একটি টেবিল প্রকাশ করেন। যদিও অনেক স্থানে ভুল ছিল, এটি আধুনিক পারমাণবিক ভরের ধারণার ভিত্তি স্থাপন করেছিল।
৪) রাসায়নিক সূত্র লেখার নিয়ম
ডাল্টন বিভিন্ন মৌলের জন্য প্রতীক এবং যৌগের জন্য সূত্র প্রবর্তন করেন, যা রসায়নের ভাষা গঠনে প্রথম পদক্ষেপ।
৫) গুণিতক অনুপাতের সূত্র
ডাল্টনের তত্ত্ব থেকে “ল’ অফ মাল্টিপল প্রোপোরশনস” (Law of Multiple Proportions) বা গুণিতক অনুপাত সূত্র বের হয়। যেমন—একই দুটি মৌল ভিন্ন অনুপাত মেনে একাধিক যৌগ তৈরি করতে পারে, তবে সেই ভিন্ন অনুপাতও পরমাণু তত্ত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
৬) গ্যাসের আচরণ বোঝা সহজ হয়
ডাল্টনের কাজ গ্যাসের আচরণ বোঝায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। তার “Partial Pressure” ধারণা, অর্থাৎ মিশ্র গ্যাসে প্রতিটি গ্যাস তার নিজস্ব চাপ প্রয়োগ করে, পরবর্তীকালে থার্মোডাইনামিক্স ও পদার্থবিদ্যার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ হয়।
সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও অবদান
ডাল্টনের তত্ত্ব নিখুঁত ছিল না—যেমন তিনি ধারণা করেছিলেন যে সব পরমাণু কঠিন গোলকাকৃতি এবং পরমাণু অভিন্ন আকার ও আয়তনসম্পন্ন। কিন্তু আধুনিক কণিকাতত্ত্ব (Particle Physics) ও কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলছে পরমাণুর ভেতরে ইলেকট্রন, নিউক্লিয়াস ইত্যাদি রয়েছে, এবং সব পরমাণু একই আকারের নয়। তবুও, তার তত্ত্ব ছাড়া রাসায়নিক বিক্রিয়া, যৌগের গঠন এবং মৌলের প্রকৃতি বোঝা সম্ভব ছিল না।
ডাল্টনের প্রভাব
ডাল্টনের তত্ত্ব বিজ্ঞানীদের মৌলিক পদার্থ ও যৌগের গঠন নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা করতে সাহায্য করে। তার ধারনা থেকে রাসায়নিক সূত্র এবং বিক্রিয়া সমীকরণ লেখার পদ্ধতি তৈরি হয়। ডাল্টনের সাফল্যের কারণেই পরবর্তীতে মেন্ডেলিফ পর্যায় সারণি তৈরি করতে পেরেছিলেন, যা রসায়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলোর একটি।
তাছাড়া, তার পরমাণু তত্ত্ব রসায়ন শিক্ষার ভিত্তি হিসেবে আজও কাজ করছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন শেখার প্রাথমিক ধাপেই ডাল্টনের তত্ত্বের ওপর নির্ভর করতে হয়। শুধু একাডেমিক পর্যায়েই নয়, শিল্প-কারখানা, ওষুধ প্রস্তুত, পরিবেশ বিজ্ঞানে রাসায়নিক বিক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণে তার তত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ।
উপসংহার
পরমাণু তত্ত্বে জন ডাল্টনের অবদান আধুনিক রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি তৈরি করেছে। যদিও পরবর্তীতে থমসন, রাদারফোর্ড, বোর প্রমুখ বিজ্ঞানীর কাজ পরমাণুর কাঠামো নিয়ে আরও বিস্তারিত ধারণা দিয়েছে, কিন্তু ডাল্টনের মৌলিক ধারণা না থাকলে এসব অগ্রগতি সম্ভব হতো না। ডাল্টন রসায়ন জগতে স্থায়ী ছাপ রেখে গেছেন, যা বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক স্মরণীয় সাফল্য।
আমি তানবীন শুভ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 1 সপ্তাহ 5 দিন যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 15 টি টিউন ও 0 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।