দিমিত্রি ইভানোভিচ মেন্ডেলিফ ও পর্যায় সারণির বিকাশ

রাশিয়ার বিজ্ঞানী দিমিত্রি ইভানোভিচ মেন্ডেলিফ (Dmitri Ivanovich Mendeleev) ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান রসায়নবিদ, যিনি আধুনিক পর্যায় সারণির (Periodic Table) পিতা হিসেবে সর্বাধিক খ্যাত। তার যুগান্তকারী কাজ রসায়নের বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে লুকিয়ে থাকা নিয়মিততা প্রকাশ করেছে এবং রসায়নকে একটি বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে নিয়মিত, বৈজ্ঞানিক ভিত্তি এনে দেয়।

 

পর্যায় সারণি তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা

১৮ শতকের শেষে ও ১৯ শতকের শুরুর দিকে বিভিন্ন মৌল একে একে আবিষ্কৃত হতে থাকে। কিন্তু তাদের কোনো সুশৃঙ্খল বিন্যাস ছিল না, ফলে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারছিলেন না, উপাদানগুলোর মধ্যে কোনো সম্পর্ক বা পুনরাবৃত্তি ধারা (periodicity) আছে কিনা। কেবল পরমাণু ভর বা মৌলিক বৈশিষ্ট্য দিয়ে উপাদানগুলোকে সাজানোর চেষ্টা চলছিল।

 

এ সময় জোহান ডোবেরেইনার (Johann Döbereiner) "ট্রায়াড নিয়ম", জন নিউল্যান্ডস (John Newlands) "অষ্টক নিয়ম" প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু এগুলো সীমিত মৌলেই কার্যকর ছিল এবং নতুন উপাদানগুলোর জন্য প্রযোজ্য হতো না। ফলে একটি পূর্ণাঙ্গ, বৈজ্ঞানিক ভিত্তিক বিন্যাসের প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

 

মেন্ডেলিফের পর্যায় সারণির নির্মাণ

মেন্ডেলিফ উপাদানগুলোর বিভিন্ন রাসায়নিক ও ভৌত বৈশিষ্ট্য গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন এবং তাদের পরমাণু ভরের ক্রম অনুযায়ী সাজিয়ে এক ধরনের "কার্ড" তৈরি করেন। তিনি প্রতিটি উপাদানের বৈশিষ্ট্য সংক্রান্ত তথ্য কার্ডে লিখে এগুলো টেবিলে ফেলে প্রতিটি উপাদানের বৈশিষ্ট্যের সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে বসান। এর মাধ্যমে এক অবিশ্বাস্য পুনরাবৃত্তি ধারা তার নজরে আসে — নির্দিষ্ট বিরতিতে উপাদানগুলোর বৈশিষ্ট্য পুনরাবৃত্তি ঘটছে।

 

১৮৬৯ সালে তিনি তার প্রথম পর্যায় সারণি প্রকাশ করেন, যেখানে উপাদানগুলোকে ক্রমবর্ধমান পরমাণু ভরের ভিত্তিতে সাজানো হয়েছিল এবং একই ধরনের রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের উপাদানগুলোকে এক কলামে রাখা হয়েছিল। এই পর্যায় সারণিই ছিল আধুনিক পর্যায় সারণির মূল ভিত্তি।

 

দূরদৃষ্টি ও ভবিষ্যদ্বাণী

মেন্ডেলিফের পর্যায় সারণির সবচেয়ে অসাধারণ দিক ছিল তার দূরদৃষ্টি। তিনি যেখানে উপাদানের ঘাটতি অনুভব করেছেন, সেখানে ফাঁকা জায়গা রেখেছিলেন এবং ভবিষ্যতে এই উপাদানগুলো আবিষ্কৃত হবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। যেমন:

 

একটি অজানা উপাদানের জন্য "এক-অ্যালুমিনিয়াম" (eka-aluminium) নাম দিয়ে তার ভৌত ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য অনুমান করেছিলেন, যা পরবর্তীতে গ্যালিয়াম হিসেবে আবিষ্কৃত হয় এবং মেন্ডেলিফের পূর্বাভাসের সাথে প্রায় মিলে যায়।

 

একইভাবে "এক-সিলিকন" (eka-silicon) নামে অনুমান করেছিলেন, যা পরে জার্মেনিয়াম হিসেবে আবিষ্কৃত হয় এবং মেন্ডেলিফের দেওয়া ঘনত্ব, রাসায়নিক আচরণ প্রায় হুবহু মিলে যায়।

 

এগুলো প্রমাণ করে যে মেন্ডেলিফের পর্যায় সারণি ছিল নিছক উপাদান সাজানোর কাজ নয়, বরং একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, যা প্রকৃতির গভীর নিয়মকে প্রকাশ করে।

 

পর্যায় সারণির বৈশিষ্ট্য

মেন্ডেলিফের প্রস্তাবিত সারণির মূল বৈশিষ্ট্য ছিল:

 

উপাদানগুলোকে ক্রমবর্ধমান পরমাণু ভরের ভিত্তিতে সাজানো।

 

একই ধরনের রাসায়নিক ও ভৌত বৈশিষ্ট্যের উপাদানগুলো এক কলামে রাখা।

 

নতুন উপাদানের জন্য ফাঁকা জায়গা রাখা এবং তাদের বৈশিষ্ট্য পূর্বাভাস করা।

 

কিছু উপাদানের অবস্থান ও পরমাণু ভর নিয়ে বিদ্যমান তথ্য ভুল হতে পারে বুঝে তাদের সংশোধনের প্রস্তাব।

 

মেন্ডেলিফের অবদান ও গুরুত্ব

১) রসায়নে নিয়মতিতা প্রতিষ্ঠা: তারপর্যায় সারণি উপাদানগুলোর বৈশিষ্ট্যের পুনরাবৃত্তি ধারা স্পষ্ট করেছে, যা রসায়নকে বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে নিয়মিত ও যৌক্তিক ধারায় উন্নীত করেছে।

 

২) উপাদান আবিষ্কারে পথপ্রদর্শক: মেন্ডেলিফের পূর্বাভাস অনুসারে নতুন উপাদান আবিষ্কৃত হয়েছিল, যা তার সারণির নির্ভুলতা প্রমাণ করে এবং উপাদান খোঁজার গবেষণাকে গতিশীল করে।

 

৩) রসায়নের শিক্ষায় যুগান্তকারী প্রভাব: রসায়ন শিক্ষার জন্য মেন্ডেলিফের পর্যায় সারণি অপরিহার্য হয়ে ওঠে, কারণ এটি মৌলিক ধারণা বোঝায় সহজ করে।

 

৪) পরমাণু গঠন ও ইলেকট্রন বিন্যাস বোঝায় ভিত্তি স্থাপন: পরবর্তীতে হেনরি মোসলে পরমাণু ক্রমসংখ্যা (atomic number) নির্ধারণ করেন এবং দেখা যায়, প্রকৃতপক্ষে উপাদানগুলোর বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত হয় পরমাণু ক্রমসংখ্যা দ্বারা, যা মেন্ডেলিফের সারণির সাথে আরও শক্ত ভিত্তি যোগ করে। এতে মেন্ডেলিফের পর্যায় সারণি হয়ে ওঠে আধুনিক পর্যায় সারণির পূর্বসূরি।

 

মেন্ডেলিফের সারণির সীমাবদ্ধতা

যদিও মেন্ডেলিফের কাজ ছিল বিপ্লবী, তবুও কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল:

 

হাইড্রোজেনের অবস্থান ঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারেননি।

 

ল্যান্থানাইড ও অ্যাক্টিনাইড উপাদানগুলোর জন্য পর্যাপ্ত জায়গা তৈরি করতে পারেননি।

 

কিছু ক্ষেত্রে পরমাণু ভরের ক্রম ঠিক রাখতে গিয়ে বৈশিষ্ট্য মেলাতে হেরফের করতে হয়েছে, যেমন আর্গন-পটাসিয়ামের ক্রমবিন্যাস।

 

তবে এগুলোকে পরবর্তীতে পরমাণু ক্রমসংখ্যার ভিত্তিতে আধুনিক পর্যায় সারণিতে ঠিক করা হয়।

 

উপসংহার

মেন্ডেলিফের পর্যায় সারণি ছিল রসায়নে এক যুগান্তকারী আবিষ্কার, যা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে উপাদানগুলোর মধ্যে সম্পর্ক স্পষ্ট করেছে। তার দূরদৃষ্টি, সুক্ষ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও বৈজ্ঞানিক যুক্তি রসায়নকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। মেন্ডেলিফ আমাদের দেখিয়েছেন প্রকৃতি নির্দিষ্ট নিয়মে চলে, আর সেই নিয়ম আবিষ্কার করাই বিজ্ঞানের প্রধান উদ্দেশ্য। আজকের আধুনিক পর্যায় সারণি তারই উত্তরসুরি, যা বিজ্ঞানের অন্যতম শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

Level 1

আমি তানবীন শুভ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 1 সপ্তাহ 5 দিন যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 15 টি টিউন ও 0 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস