কোয়ান্টাম চিপ "উইলো"
কোয়ান্টাম চিপ "উইলো": ভবিষ্যতের কম্পিউটিংয়ের দ্বারপ্রান্তে এক যুগান্তকরী বিজ্ঞানের বিস্ময়কর অগ্রযাত্রার এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের হাত ধরে। দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত সিলিকন-ভিত্তিক চিপের সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে এখন বিজ্ঞানীরা চোখ রেখেছেন এমন এক প্রযুক্তির দিকে, যেখানে বিটের বদলে কাজ করছে কিউবিট—আর সেই বিপ্লবের সামনের সারিতে অবস্থান করছে "উইলো", আইবিএম (IBM) দ্বারা তৈরি একটি কোয়ান্টাম চিপ, যা ২০২৫ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর প্রযুক্তি ও গবেষণা মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।
এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব উইলো চিপের প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্য, এর কাঠামো, কার্যক্ষমতা, এবং এটি কীভাবে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ধারাকে আমূল পরিবর্তন করতে পারে।
-
কোয়ান্টাম কম্পিউটিং: এক ঝলক
সাধারণ কম্পিউটার যেখানে বিট (bit)-এর উপর ভিত্তি করে কাজ করে—যা হয় ০ অথবা ১—কোয়ান্টাম কম্পিউটার সেখানে কিউবিট (qubit) ব্যবহার করে, যা একই সাথে ০ এবং ১ অবস্থায় থাকতে পারে, কোয়ান্টাম সুপারপজিশনের কারণে। এছাড়া, কিউবিটদের মধ্যে এনট্যাঙ্গলমেন্ট (entanglement) নামক এক জটিল কিন্তু শক্তিশালী সম্পর্ক তৈরি করা যায়, যার ফলে অসংখ্য ক্যালকুলেশন একই সাথে করার ক্ষমতা তৈরি হয়।
-
উইলো: IBM-এর ২০২৫ সালের উদ্ভাবন
উইলো (IBM Quantum Willow) চিপটি ২০২৫ সালে IBM তার কোয়ান্টাম হার্ডওয়্যার প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে উন্মোচন করে। এটি ১০০ কিউবিটের একটি চিপ, যার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো মডুলার ডিজাইন, স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি, এবং স্কেলেবল আর্কিটেকচার। উইলো চিপটি IBM-এর 'Heron-class' আর্কিটেকচারের উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে, যা এর আগের কোয়ান্টাম চিপগুলো থেকে অনেক বেশি উন্নত ও নির্ভরযোগ্য।
-
উইলো চিপের মূল বৈশিষ্ট্য:
১. ১০০-কিউবিট মডেল:
উইলো চিপটি ১০০টি কার্যকর কিউবিট নিয়ে গঠিত, যা পরীক্ষামূলক এবং ছোট স্কেল প্রোগ্রাম ছাড়িয়ে বাস্তব অ্যাপ্লিকেশন চালানোর উপযোগী।
২. Heron আর্কিটেকচার:
উইলো চিপ IBM Heron প্ল্যাটফর্মের অংশ, যেখানে কিউবিট গুলোর মধ্যে কন্ট্রোল এবং সংযোগ আরও উন্নত। এতে gate fidelity উন্নত করা হয়েছে, যা error rates কমিয়ে আনে।
3. নিম্ন ত্রুটি হার (Low Error Rate):
কোয়ান্টাম কম্পিউটারে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে error correction। উইলো-তে এমন উপাদান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, যা gate error কে পূর্বের তুলনায় ১০ গুণ পর্যন্ত কমিয়ে আনতে পারে।
4. Quantum Volume বৃদ্ধি:
উইলো চিপে কোয়ান্টাম ভলিউম বা কার্যক্ষমতার পরিমাপ অনেক বেশি। Quantum volume মানে একটি কোয়ান্টাম চিপ কতটা কার্যকরভাবে কোয়ান্টাম অ্যালগরিদম চালাতে পারে।
5. Superconducting কিউবিট প্রযুক্তি:
IBM-এর উইলো চিপে superconducting qubit ব্যবহার করা হয়েছে, যা cryogenic তাপমাত্রায় চলমান এবং তুলনামূলকভাবে শিল্পায়নের উপযোগী।
-
উইলো চিপ কীভাবে পার্থক্য তৈরি করছে?
সাধারণভাবে বলা যায়, কোয়ান্টাম কম্পিউটারগুলো এখনো গবেষণাগারে সীমাবদ্ধ। কিন্তু উইলো চিপ সেই সীমানা পেরিয়ে বাস্তব জীবনের সমস্যার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এর মাধ্যমে নিচের কিছু ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসতে পারে—
1. রসায়ন ও ফার্মাসিউটিক্যাল গবেষণা:
কোয়ান্টাম চিপ দ্বারা মলিকিউলার গঠন ও আচরণ পূর্বাভাস করা অনেক বেশি বাস্তবসম্মত ও কার্যকর হবে। এটি নতুন ওষুধ আবিষ্কারের পথে বিপ্লব ঘটাতে পারে।
2. ক্রিপ্টোগ্রাফি:
কোয়ান্টাম চিপ প্রচলিত এনক্রিপশন ভেঙে ফেলতে পারে, আবার নতুন ধরনের কোয়ান্টাম-সুরক্ষা এনক্রিপশনও তৈরি করতে সাহায্য করবে।
3. Optimization Problems:
ট্রান্সপোর্টেশন, ফাইনান্স, এনার্জি ব্যবস্থাপনার মতো ক্ষেত্রগুলোতে জটিল অপটিমাইজেশন সমস্যাগুলো কোয়ান্টাম চিপের সাহায্যে দ্রুত সমাধান করা সম্ভব।
4. মেশিন লার্নিং ও এআই:
কোয়ান্টাম মেশিন লার্নিং (QML) ও কোয়ান্টাম নিউরাল নেটওয়ার্ক উন্নয়নের মাধ্যমে, ভবিষ্যতের AI অনেক বেশি শক্তিশালী হতে পারে।
-
IBM-এর পরিকল্পনা: উইলো তারকাবিন্দু নয়, শুরু
IBM ঘোষণা করেছে যে উইলো চিপ তাদের কোয়ান্টাম উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলেও এটি চূড়ান্ত নয়। উইলো-র পরে আসবে "IBM Condor", যা ১১২১ কিউবিট চিপ—2025 সালের শেষ দিকে তার আত্মপ্রকাশ ঘটবে বলে আশা করা হচ্ছে। এছাড়া ২০২৯ সালের মধ্যে IBM এমন কোয়ান্টাম চিপ তৈরি করতে চায়, যা এক মিলিয়ন কিউবিট পরিচালনা করতে পারবে।
-
চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা
যদিও উইলো চিপ একটি অভাবনীয় অগ্রগতি, তারপরও কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের চ্যালেঞ্জ এখনো বিদ্যমান। যেমন—
ডিকোহেরেন্স: কিউবিট দীর্ঘ সময় ধরে স্থিতিশীল রাখা এখনো একটি চ্যালেঞ্জ।
Quantum Error Correction: সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত কোয়ান্টাম ক্যালকুলেশন এখনো বাস্তবায়নযোগ্য নয়।
Cryogenic পরিবেশের প্রয়োজন: কিউবিটগুলোকে কাজ করতে হয় অত্যন্ত নিম্ন তাপমাত্রায় (প্রায় -২৭৩°C), যা পরিচালনা ব্যয়বহুল ও জটিল।
-
উপসংহার :
IBM-এর উইলো চিপ আধুনিক প্রযুক্তির ইতিহাসে এক যুগান্তকারী সংযোজন। এটি কোয়ান্টাম কম্পিউটিংকে গবেষণার গণ্ডি থেকে তুলে এনে বাস্তব জীবনের সমস্যার সমাধানের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে। যদিও এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ আছে, তবে উইলো দেখিয়ে দিয়েছে যে ভবিষ্যৎ শুধু আর দূর কল্পনা নয়—তা এখন দরজার কড়ায় কড়ায় এসে
দাঁড়িয়েছে।
উইলো একটি প্রতীক—অগ্রগতির, উদ্ভাবনের, এবং এক নতুন ভবিষ্যতের সূচনার।
আমি মোঃ সজীব ইসতিয়াক। 02, বিয়াম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বগুড়া, বগুড়া। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 2 সপ্তাহ 3 দিন যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 11 টি টিউন ও 0 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 2 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 1 টিউনারকে ফলো করি।