কার্বন ক্যাপচারিং মাইক্রোব: প্রকৃতির নিঃশব্দ জলদস্যু
বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়ন একটি অন্যতম গুরুতর সংকট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO₂) সহ অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাসের অতিরিক্ত নিঃসরণ। শিল্পায়ন, বন উজাড়, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার এবং কৃষিকাজসহ নানাবিধ মানবীয় কার্যকলাপ থেকে এই গ্যাসগুলো বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। এই সমস্যার সমাধানে বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে কাজ করে চলেছেন, এবং এই ধারাবাহিকতায় একদল নিঃশব্দ নায়ক — কার্বন ক্যাপচারিং মাইক্রোব — আজ আলোচনার কেন্দ্রে।
কার্বন ক্যাপচারিং মাইক্রোব কী?
কার্বন ক্যাপচারিং মাইক্রোব হলো এমন কিছু অণুজীব (microorganisms) যারা বাতাস বা পরিবেশ থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে নিজেদের বেঁচে থাকার জন্য ব্যবহার করে এবং সেই সঙ্গে প্রাকৃতিকভাবে কার্বন হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই অণুজীবগুলোর মধ্যে ব্যাকটেরিয়া, অ্যালগি, আর্কিয়া প্রজাতির মাইক্রোব এবং কিছু ছত্রাকও অন্তর্ভুক্ত।
এদের কাজের ধরন
প্রকৃতিতে কিছু অণুজীবের রয়েছে বিশেষ ধরনের জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে তারা বাতাসের CO₂ কে শোষণ করে তাকে রূপান্তরিত করে বিভিন্ন জৈব যৌগে। এই প্রক্রিয়াটি পরিচিত বায়োলজিকাল কার্বন ফিক্সেশন নামে। উদ্ভিদের ক্লোরোফিল যেমন সূর্যের আলো ব্যবহার করে ফটোসিন্থেসিসের মাধ্যমে CO₂ গ্রহণ করে গ্লুকোজ তৈরি করে, তেমনি কিছু মাইক্রোব সূর্যালোক বা রাসায়নিক শক্তি ব্যবহার করে CO₂ শোষণ করে নিজেদের খাদ্য তৈরি করে।
১. অটোট্রফিক ব্যাকটেরিয়া
এই ব্যাকটেরিয়ারা নিজেদের খাদ্য নিজেরাই তৈরি করে, এবং তারা CO₂ শোষণ করে জৈব পদার্থ তৈরি করে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু নাইট্রোজেন ফিক্সিং ব্যাকটেরিয়া যেমন Azotobacter বা Nitrosomonas এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে।
২. সায়ানোব্যাকটেরিয়া
সায়ানোব্যাকটেরিয়া হল প্রাচীনতম ফটোসিন্থেটিক অণুজীব যারা সৌর শক্তি ব্যবহার করে কার্বন শোষণ করতে সক্ষম। এগুলো পৃথিবীর প্রাচীনতম অক্সিজেন-উৎপাদনকারী জীব হিসেবেও পরিচিত।
৩. মাইক্রোঅ্যালগি
মাইক্রোঅ্যালগি যেমন Chlorella, Spirulina বা Nannochloropsis সূর্যালোক ও CO₂ ব্যবহার করে দ্রুত বায়োমাস তৈরি করতে পারে। এদের বিশেষভাবে বায়োরিঅ্যাক্টরে ব্যবহার করা হয় বায়োফুয়েল উৎপাদনের জন্যও।
৪. মিথানোজেনিক আর্কিয়া
এদের কিছু প্রজাতি মিথেন উৎপাদনের পাশাপাশি CO₂ হ্রাসেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে যেসব স্থান অক্সিজেনবিহীন (anaerobic) যেমন ভূগর্ভস্থ পলি বা গবাদি পশুর পাকস্থলী — সেখানে এদের গুরুত্ব অপরিসীম।
-
কার্বন হ্রাসে ভূমিকা :
এই অণুজীবগুলো যেভাবে কাজ করে তা শুধুমাত্র কার্বন শোষণ করেই থেমে থাকে না। এরা কার্বনকে এমনভাবে সংরক্ষণ করে যার ফলে তা পরিবেশে পুনরায় ফিরে আসে না, বরং স্থায়ীভাবে মৃত্তিকায় বা সমুদ্রে জমা হয়ে থাকে। কিছু ক্ষেত্রে এই মাইক্রোবরা মৃত্তিকার উর্বরতা বাড়ায় এবং একই সঙ্গে গ্রীনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমায়।
কৃষি ও শিল্পে ব্যবহার
বর্তমানে বিজ্ঞানীরা এই মাইক্রোবগুলোর ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে। নিচে কিছু ব্যবহার তুলে ধরা হলো:
বায়োরিঅ্যাক্টরে CO₂ ক্যাপচার
শিল্পকারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়ায় থাকা CO₂ শোষণ করতে এই অণুজীবগুলোকে বিশেষভাবে বায়োরিঅ্যাক্টরে ব্যবহার করা হয়। এতে বায়ুদূষণ যেমন কমে, তেমনি প্রাকৃতিকভাবে কার্বন হ্রাস সম্ভব হয়।
জৈব সার ও মাটি উন্নয়ন
এদের ব্যবহার করে মৃত্তিকায় মাইক্রোবায়াল অ্যাক্টিভিটি বাড়িয়ে জৈব সার তৈরি করা হয় যা রসায়নভিত্তিক সার ব্যবহারের চেয়ে পরিবেশবান্ধব।
বায়োফুয়েল উৎপাদন
মাইক্রোঅ্যালগি ব্যবহার করে CO₂ কে পরিণত করা হয় তরল জ্বালানিতে (বায়োডিজেল), যা পরিবেশবান্ধব জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
সারাংশে পুনঃকার্বনীকরণ
কিছু ব্যাকটেরিয়া মৃত্তিকার মধ্যে কার্বন ধরে রাখতে সাহায্য করে যা দীর্ঘমেয়াদে কার্বন স্টোরেজ হিসেবে কাজ করে।
-
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যত সম্ভাবনা :
যদিও কার্বন ক্যাপচারিং মাইক্রোব নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে, তবুও এর বাস্তব প্রয়োগে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে:
মাইক্রোবের নিয়ন্ত্রণ: সব পরিবেশে এদের বৃদ্ধি সমান হয় না। তাই কৃত্রিম পরিবেশ তৈরি করা ব্যয়বহুল।
বায়োরিঅ্যাক্টরের খরচ: বড় পরিসরে মাইক্রোব দিয়ে কার্বন ক্যাপচার করতে গেলে অনেক প্রযুক্তি ও অর্থের প্রয়োজন।
জীববৈচিত্র্যের প্রভাব: পরিবেশে অণুজীবের কৃত্রিম হস্তক্ষেপে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে যদি সেটা সতর্কভাবে না করা হয়।
তবে প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে, ততই এই সমস্যাগুলোর সমাধানও খোঁজা হচ্ছে। বিশেষ করে সিনথেটিক বায়োলজি এবং জিন প্রকৌশল (genetic engineering) এর মাধ্যমে নতুন ধরনের ‘সুপার মাইক্রোব’ তৈরি করার চেষ্টা চলছে, যারা অধিক কার্যকরভাবে CO₂ শোষণ করতে সক্ষম হবে।
-
উপসংহার:
কার্বন ক্যাপচারিং মাইক্রোব হচ্ছে এক অভাবনীয় প্রাকৃতিক উপহার যা মানবজাতিকে জলবায়ু সংকট থেকে রক্ষা করতে পারে। এদের নিঃশব্দ কাজের মাধ্যমে আমরা প্রকৃতির সঙ্গে মিল রেখে টেকসই ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারি। তবে একে একমাত্র সমাধান হিসেবে ভাবার আগে আমাদের প্রয়োজন সম্মিলিত পদক্ষেপ — যেমন বন সংরক্ষণ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার এবং সচেতন জীবনযাপন।
এই অণুজীবরা আমাদের সহযোগী হতে পারে, যদি আমরা প্রকৃতিকে সহমর্মিতার চোখে দেখি।
আমি মোঃ সজীব ইসতিয়াক। 02, বিয়াম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বগুড়া, বগুড়া। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 2 সপ্তাহ 3 দিন যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 11 টি টিউন ও 0 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 2 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 1 টিউনারকে ফলো করি।