CRISPR ভিত্তিক জিন থেরাপি: জিনগত রোগ নিরাময়ের এক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ
ভূমিকা :
মানবদেহে অসংখ্য জিন রয়েছে, যেগুলোর সমন্বিত কাজ আমাদের শারীরিক গঠন, আচরণ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং অন্যান্য জৈবিক কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণ করে। তবে, যখন এই জিনগুলোতে কোনোরকম ত্রুটি দেখা যায়, তখন অনেক সময়ই তা মারাত্মক জিনগত রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আধুনিক জৈবপ্রযুক্তির অন্যতম বিস্ময়কর আবিষ্কার CRISPR-Cas9 প্রযুক্তি, যা চিকিৎসাবিজ্ঞানে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এই প্রযুক্তির সাহায্যে জিনের কাঠামোকে সুনির্দিষ্টভাবে সম্পাদনা (edit) করে বিভিন্ন জিনগত রোগ নিরাময় সম্ভব হচ্ছে, যা পরিচিত জিন থেরাপি নামে।
-
CRISPR প্রযুক্তি কী?
CRISPR-এর পূর্ণরূপ হলো Clustered Regularly Interspaced Short Palindromic Repeats। এটি একটি জিন-সম্পাদনার প্রাকৃতিক প্রযুক্তি, যা প্রথম আবিষ্কৃত হয় ব্যাকটেরিয়ার ইমিউন সিস্টেমে। ব্যাকটেরিয়া যখন ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়, তখন তারা ওই ভাইরাসের ডিএনএ-র কিছু অংশ সংরক্ষণ করে রাখে এবং ভবিষ্যতে ভাইরাস আক্রমণ করলে তা চিনে নিয়ে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে Cas9 নামের একটি এনজাইম, যেটি একটি ধারে তলোয়ারের মতো ডিএনএ-এর নির্দিষ্ট অংশ কেটে ফেলতে পারে।
বিজ্ঞানীরা এই প্রাকৃতিক ব্যবস্থাটিকে উন্নত করে এখন মানুষের জিন সম্পাদনায় ব্যবহার করছেন। গাইড আরএনএ (guide RNA বা gRNA) ব্যবহার করে Cas9 এনজাইমকে টার্গেট জিনের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়, এবং সেখানে সুনির্দিষ্ট কাটাকাটি করে ত্রুটিপূর্ণ অংশ মুছে ফেলা বা নতুন সঠিক অংশ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।
-
CRISPR ভিত্তিক জিন থেরাপির কার্যপদ্ধতি :
CRISPR প্রযুক্তিকে সফলভাবে জিন থেরাপিতে প্রয়োগ করার জন্য নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করা হয়:
1. রোগ সম্পর্কিত জিন চিহ্নিতকরণ: প্রথমে নির্দিষ্ট রোগের জন্য দায়ী জিন শনাক্ত করা হয়।
2. gRNA ডিজাইন: Cas9-কে নির্দিষ্ট স্থান নির্দেশ করার জন্য একটি উপযুক্ত গাইড আরএনএ তৈরি করা হয়।
3. Cas9 সক্রিয় করা: Cas9 এনজাইমকে গাইড আরএনএর সাহায্যে টার্গেট ডিএনএ অংশে পৌঁছে দেওয়া হয়।
4. ডিএনএ কাটা এবং সম্পাদনা: Cas9 ডিএনএর নির্দিষ্ট স্থানে কেটে সেখানে সংশোধন বা প্রতিস্থাপন করে।
5. জিন মেরামত: শরীরের প্রাকৃতিক মেরামত প্রক্রিয়া কাটাকাটি করা ডিএনএ অংশ ঠিক করে নেয় বা বিজ্ঞানীরা কৃত্রিমভাবে নতুন অংশ ঢুকিয়ে দেন।
-
চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যবহার :
CRISPR ভিত্তিক জিন থেরাপি বর্তমানে বেশ কয়েকটি জিনগত রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে বা পরীক্ষাধীন রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:
1. সিকল সেল অ্যানিমিয়া (Sickle Cell Anemia): রক্তের একটি জিনগত রোগ যা হিমোগ্লোবিনের বিকৃতি ঘটায়। CRISPR ব্যবহার করে এই রোগের জন্য দায়ী ত্রুটিপূর্ণ জিন ঠিক করা সম্ভব হচ্ছে।
2. থ্যালাসেমিয়া: এই রোগে শরীর যথেষ্ট হিমোগ্লোবিন তৈরি করতে পারে না। জিন থেরাপির মাধ্যমে হিমোগ্লোবিন উৎপাদনের জিনে পরিবর্তন আনা হচ্ছে।
3. লিউকেমিয়া এবং কিছু ক্যানসার: কিছু পরীক্ষামূলক চিকিৎসায় ক্যানসার কোষে থাকা মিউটেশন (mutation) চিহ্নিত করে CRISPR এর মাধ্যমে তা প্রতিরোধ করা হচ্ছে।
4. বংশগত অন্ধত্ব: চোখের নির্দিষ্ট জিন সম্পাদনার মাধ্যমে কিছু বংশগত অন্ধত্বের চিকিৎসা বর্তমানে পরীক্ষাধীন।
-
CRISPR থেরাপির সুবিধাসমূহ :
1. সুনির্দিষ্টতা (Precision): অন্যান্য জিন থেরাপির তুলনায় CRISPR অত্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে কাজ করতে পারে।
2. দ্রুততা এবং সাশ্রয়: এই প্রযুক্তি তুলনামূলকভাবে দ্রুত এবং খরচ কম।
3. স্থায়ী সমাধান: জিনে একবার পরিবর্তন আনা হলে তা স্থায়ীভাবে কার্যকর থাকতে পারে।
4. অন্যান্য থেরাপির বিকল্প: যেখানে প্রচলিত চিকিৎসা ব্যর্থ হয়, সেখানে জিন থেরাপি হতে পারে কার্যকর উপায়।
-
সীমাবদ্ধতা এবং ঝুঁকি :
যদিও CRISPR ভিত্তিক জিন থেরাপি অত্যন্ত সম্ভাবনাময়, তবুও কিছু সীমাবদ্ধতা এবং নৈতিক প্রশ্ন রয়েছে:
1. অফ-টার্গেট এফেক্ট: কখনো কখনো Cas9 ভুল জায়গায় কেটে ফেলে, যা বিপজ্জনক হতে পারে।
2. ইমিউন রেসপন্স: Cas9 প্রোটিন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে উত্তেজিত করতে পারে।
3. ন্যায়বিচার এবং প্রবেশাধিকার: এই থেরাপি খুব ব্যয়বহুল হওয়ায় সাধারণ মানুষের পক্ষে প্রাপ্তি কঠিন হতে পারে।
4. নৈতিক প্রশ্ন: ভ্রূণের জিন সম্পাদনা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে — এটি ভবিষ্যতে “ডিজাইনার বেবি” তৈরির সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে, যা সামাজিক বৈষম্য ও অপব্যবহার বাড়াতে পারে।
-
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা :
CRISPR প্রযুক্তি জিন থেরাপির জগতে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। ভবিষ্যতে এটি কেবল জিনগত রোগ নয়, বরং ভাইরাস সংক্রমণ, অটোইমিউন ডিজঅর্ডার, এমনকি বার্ধক্য প্রতিরোধেও ব্যবহৃত হতে পারে।
বর্তমানে বিভিন্ন গবেষণাগারে প্রাণঘাতী রোগ যেমন HIV, পারকিনসনস, হান্টিংটনস ডিজিজ ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা চলছে। আরও উন্নত প্রযুক্তি যেমন base editing ও prime editing ইতিমধ্যে CRISPR-এর উন্নত সংস্করণ হিসেবে উদ্ভূত হয়েছে, যা আরও বেশি নির্ভুল এবং নিরাপদ।
-
উপসংহার :
CRISPR ভিত্তিক জিন থেরাপি আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। এটি এমন এক প্রযুক্তি যা অসংখ্য মানুষের জীবন বাঁচাতে এবং উন্নত করতে পারবে। যদিও এর ব্যবহার এখনও সীমিত এবং কিছু ঝুঁকি ও নৈতিক জটিলতা বিদ্যমান, তবুও বিজ্ঞানীরা আশাবাদী যে ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি আরও নিরাপদ ও সাশ্রয়ী
হয়ে উঠবে। যদি সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয়, তবে CRISPR হতে পারে মানব ইতিহাসে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ।
আমি মোঃ সজীব ইসতিয়াক। 02, বিয়াম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বগুড়া, বগুড়া। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 3 সপ্তাহ যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 11 টি টিউন ও 0 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 2 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 1 টিউনারকে ফলো করি।