নিউরালিংকের ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস: মানুষের চিন্তাকে প্রযুক্তির শক্তিতে রূপান্তর
ভূমিকা :
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জগতে এমন কিছু আবিষ্কার আছে যা সময়ের সীমানা ভেঙে ভবিষ্যতের দরজা খুলে দেয়। এমনই এক যুগান্তকারী প্রযুক্তি হলো নিউরালিংকের ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস (Brain-Computer Interface - BCI)। এলন মাস্কের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত নিউরালিংক (Neuralink) ২০২৪ সালে সফলভাবে একটি মানুষের মস্তিষ্কে চিপ স্থাপন করে, যা চিন্তার মাধ্যমে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণের যুগে প্রবেশের পথ খুলে দেয়। এটি শুধু প্রযুক্তির নয়, মানবজাতির ইতিহাসে এক বিশাল মাইলফলক।
এই নিবন্ধে আমরা নিউরালিংকের প্রযুক্তির নেপথ্যের বিজ্ঞান, এর সম্ভাব্য ব্যবহার, ঝুঁকি ও ভবিষ্যতের দিগন্ত বিশ্লেষণ করব।
নিউরালিংক কী?
নিউরালিংক কর্পোরেশন ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এলন মাস্ক এবং একদল নিউরোসায়েন্টিস্ট ও ইঞ্জিনিয়ারের মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য ছিল এমন একটি প্রযুক্তি তৈরি করা, যা মানুষের মস্তিষ্ককে সরাসরি কম্পিউটারের সঙ্গে সংযুক্ত করতে পারবে। এই উদ্দেশ্য পূরণে নিউরালিংক একটি অত্যাধুনিক “নিউরাল ইমপ্লান্ট” তৈরি করে — এক ধরনের চিপ যা মস্তিষ্কের নিউরনের সঙ্গে কাজ করে।
এই চিপে থাকে হাজার হাজার ইলেকট্রোড, যা মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করে মানুষের চিন্তা, স্নায়ুবিক সংকেত বা “নিউরাল অ্যাকটিভিটি” সংগ্রহ করে এবং তা ডিজিটাল সংকেতে রূপান্তর করে। এভাবেই মানুষের চিন্তা সরাসরি কম্পিউটারে পাঠানো সম্ভব হয়।
২০২৪ সালের ঐতিহাসিক প্রতিস্থাপন :
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে নিউরালিংক প্রথমবারের মতো একজন মানুষের মস্তিষ্কে “টেলিপ্যাথি” নামক চিপ প্রতিস্থাপন করে। এই রোগী পক্ষাঘাতগ্রস্ত ছিলেন এবং হাত বা পা ব্যবহার করতে অক্ষম ছিলেন। প্রতিস্থাপনের পর তিনি শুধুমাত্র চিন্তা করে একটি কম্পিউটার কার্সর চালাতে সক্ষম হন — এটি ছিল এক বৈপ্লবিক ঘটনা।
এই চিপের সাহায্যে তিনি কোনো বাহ্যিক ডিভাইস স্পর্শ না করেই টাইপ করতে ও স্ক্রিনের জিনিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এতে প্রমাণিত হয়, মানুষের চিন্তা সরাসরি ডিজিটাল জগতে অনুবাদ করা সম্ভব।
প্রযুক্তির গঠন ও কার্যপ্রণালী :
নিউরালিংকের চিপটি দেখতে অনেকটাই একটি ছোট কয়েনের মতো, যার নাম “Link”。 এটি মস্তিষ্কের কর্টেক্সে (cerebral cortex) স্থাপন করা হয় এবং এতে থাকে:
প্রায় ১০২৪টি ইলেকট্রোড
একটি ব্লুটুথ বা ওয়ারলেস চ্যানেল
ছোট ব্যাটারি ও চার্জিং সিস্টেম
বিশেষ সফটওয়্যার যা মস্তিষ্কের সংকেত বুঝে ফেলে
এই ইলেকট্রোডগুলো নিউরনের কাছাকাছি অবস্থানে থাকে এবং যখন নিউরন সক্রিয় হয়, তখন ছোট বৈদ্যুতিক সংকেত তৈরি হয়। চিপ সেই সংকেত সংগ্রহ করে এবং তা ওয়ারলেস মাধ্যমে কম্পিউটারে পাঠায়। এরপর বিশেষ সফটওয়্যার সেটিকে মানুষের ইচ্ছা বা কমান্ড হিসেবে ব্যাখ্যা করে।
নিউরালিংকের সম্ভাব্য ব্যবহার :
১. পক্ষাঘাত রোগীদের জন্য যোগাযোগের নতুন দিগন্ত
যারা কথা বলতে বা শরীর নাড়াতে পারেন না, তারা এই চিপের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারবেন। কম্পিউটার স্ক্রিনে টাইপ করা, বোতাম চাপা বা রোবটিক হাত নিয়ন্ত্রণ সবই সম্ভব।
২. স্মৃতি পুনরুদ্ধার
ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি মেমোরি স্টোরেজ এবং রিকল করার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। এর ফলে স্মৃতি দুর্বল ব্যক্তিদের জন্য একটি নতুন সহায়ক ব্যবস্থা গড়ে উঠবে।
৩. মানসিক রোগের চিকিৎসা
ডিপ্রেশন, পিটিএসডি, অ্যাংজাইটি ইত্যাদি মানসিক সমস্যায় নিউরালিংক থেরাপি হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। স্নায়ুবিক ত্রুটি নির্ণয় এবং সংশোধনে চিপটি ভূমিকা রাখতে পারে।
৪. স্নায়ুপ্রযুক্তি সমন্বিত রোবটিকস
চিপের মাধ্যমে রোবট নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। যেমন, এক ব্যক্তি চিন্তা করলেই রোবটিক বাহু বা এক্সোস্কেলেটন চলতে শুরু করবে — যা ভিন্নভাবে সক্ষমদের জীবনে বিশাল পরিবর্তন আনবে।
৫. সরাসরি “চিন্তা থেকে টাইপিং” বা “টেলিপ্যাথিক” যোগাযোগ
এই চিপ দিয়ে ভবিষ্যতে ভাষা ব্যবহার না করেই “চিন্তা থেকে চিন্তা” বা “মাইন্ড-টু-মাইন্ড” যোগাযোগ সম্ভব হতে পারে।
চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি :
১. নিরাপত্তা ও হ্যাকিং
এই প্রযুক্তি যদি ইন্টারনেট সংযুক্ত হয়, তাহলে সাইবার হামলার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। কেউ চাইলে ব্যবহারকারীর চিন্তা পড়তে বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে — যা মারাত্মক বিপজ্জনক।
২. নৈতিকতা ও গোপনীয়তা
চিন্তা, স্মৃতি ও অনুভূতি ব্যক্তিগত বিষয়। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া মস্তিষ্কের তথ্য সংগ্রহ করে, তা হলে এটি ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করবে।
৩. অপারেশন ও শারীরিক ঝুঁকি
মস্তিষ্কে চিপ স্থাপন একটি জটিল অস্ত্রোপচার। যদিও নিউরালিংক “রোবোটিক সার্জন” দিয়ে এই কাজ সম্পন্ন করে, তবুও সংক্রমণ, ক্ষতি বা ব্যর্থতার ঝুঁকি রয়ে যায়।
ভবিষ্যতের দিগন্ত :
নিউরালিংকের বর্তমান চিপ শুধুমাত্র একমুখী (চিন্তা থেকে কম্পিউটার) যোগাযোগে সীমাবদ্ধ। কিন্তু ভবিষ্যতে দুইমুখী যোগাযোগ — যেমন কম্পিউটার থেকে মস্তিষ্কে তথ্য পাঠানো — সম্ভব হলে মানুষ সম্পূর্ণভাবে ভার্চুয়াল জগতে একীভূত হতে পারবে।
ভাবুন, আপনি একটি ভাষা শিখতে চাচ্ছেন, আর মস্তিষ্কে সেই ভাষার তথ্য ডাউনলোড করে দিচ্ছে কম্পিউটার — এটি এখন কল্পনা হলেও অদূর ভবিষ্যতে বাস্তব হতে পারে।
উপসংহার :
নিউরালিংকের ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস আধুনিক প্রযুক্তির এক চরম সীমা ছুঁয়েছে। এটি শুধু পক্ষাঘাত রোগীদের নয়, পুরো মানবজাতির চিন্তা, যোগাযোগ ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের ধরন বদলে দিতে সক্ষম।
তবে এর সঙ্গে জড়িত নৈতিক, নিরাপত্তাজনিত ও প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। দায়িত্বশীলভাবে ব্যবহৃত হলে নিউরালিংক হতে পারে মানব
-প্রযুক্তির মেলবন্ধনের এক অনন্য উদাহরণ — এক সত্যিকারের “সাইবর্গ ভবিষ্যতের” সূচনা।
আমি মোঃ সজীব ইসতিয়াক। 02, বিয়াম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বগুড়া, বগুড়া। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 3 সপ্তাহ যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 11 টি টিউন ও 0 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 2 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 1 টিউনারকে ফলো করি।