টেকটিউনস কমিউনিটি, কেমন আছেন সবাই? আশা করছি সবাই ভাল আছেন। আমরা ইদানীং সবাই ফাস্ট চার্জারের কথা শুনে থাকি প্রায় সকল ফোন কোম্পানি এটার দিকে নজর দিয়েছে। আজকের টিউন এই আজব ফাস্ট চার্জার নিয়েই। আজকে আমি বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত গতির ফাস্ট চার্জার, Oppo এর SuperVooc (সুপার ভক) এর সাথে আপনাকে পরিচয় করিয়ে দেব সাথে থাকবে ছোট রিভিউ।
Oppo এর Oppo Find X ফোনটি মার্কেটে যথেষ্ট সাড়া ফেলে এর কারণ ছিল চমৎকার লুক, বেজেললেস স্ক্রিন, দারুণ ক্যামেরা এবং সবচেয়ে প্রভাববিস্তারকারী দিক হচ্ছে এর SuperVOOC চার্জার। Oppo দাবী করে বাজারের সব ফাস্ট চার্জিং থেকে এটি দ্বিগুণ দ্রুত যা অন্য ফোনের অর্ধেক সময়ে ফুল চার্জ হয়। আর যদি এটি তাদের প্রমোশনের মত সত্যি হয় তাহলে বলাই যায় এটি আমাদের পূর্বের সকল চার্জিং অভিজ্ঞতাকে পাল্টে দেবে।
Oppo এর মতে ফোনটির SuperVOOC চার্জার মাত্র ৩৫ এর ভেতর ফুল চার্জ হয়ে যাবে যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানির লাগে মিনিমাম ১ ঘণ্টা। তো তাদের এই সুপার বয়ানে আমার মনে তিনটি প্রশ্ন আসে,
Oppo এর দাবী কতটা সত্য এবং সঠিক? চলুন আমরা পরীক্ষা করে দেখি আসলেই কি তারা সুপার ফাস্ট কিনা।
আমি পরীক্ষাটি করার জন্য সব ফোন গুলোর আসল চার্জার ব্যবহার করেছি। আপনাদের আজকে বিস্তারিত ভাবে পরীক্ষাটি দেখানোর চেষ্টা করব।
আমি দুইভাবে পরীক্ষাটি করতে চাই, একবার ফোনের স্ক্রিন অন করে চার্জ দেব, আবার স্ক্রিন অফ করে চার্জ দেব।
আমি সব গুলো ফোন স্ক্রিন অফ করে ০ থেকে ১০০% চার্জ দিয়েছি, রেজাল্ট দেখুন।
আমরা দেখতে পাচ্ছি Oppo Find X মাত্র ৩১ মিনিটে ফুল চার্জ হয়ে গেছে, যা সত্যিই অবিশ্বাস্য। তারপরেই আছে Huawei P20 pro যার সময় লেগেছে ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিট। বাকি তিনটি ফোন মোটামুটি একই সময় লেগেছে।
ধরুন বিভিন্ন ফোনের ব্যাটারি পাওয়ার কম-বেশি হতেই পারে তাহলে চলুন ওয়াট দিয়ে পরীক্ষা করা যাক।
এখানেও দেখতে পাচ্ছি SuperVooc এর প্রথমে আছে। এবার যদি আমরা প্রতি ১০ মিনিটে ফোন গুলোতে কত mAh পাম্প হয় এটাও পরীক্ষা করি তাহলেও দেখতে পারব Oppo Find X প্রথম।
এবার আমার ২য় পরীক্ষার পালা, আমি ফোন গুলো এবার স্ক্রিন অন্য রেখে চার্জ দেব। কারণ আমি দেখতে চাই অতিরিক্ত হিটে কেমন চার্জ হয়। Oppo এখানেও দাবী করেছে তাদের ফোনের স্ক্রিন অন থাকলেও একই সময়ে ফুল চার্জ হবে।
তো আমি ৫০% ব্রাইটনেস দিয়ে চেক করি। যদিও কিছু কিছু ফোন স্ক্রিন অন থাকায় ফাস্ট চার্জিং ফিচার কাজ করবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয়।
এবং ফলাফল! Oppo এর দাবী একদম সঠিক, তাদের Oppo Find X ফোন চার্জ হয় মাত্র ৩৩ মিনিটে একই সাথে Huawei P20 লাগে ১ ঘণ্টা ১৩ মিনিট। প্রথম দুটি ফোনের কোন পরিবর্তন হয় নি। কিন্তু ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে স্ক্রিন অন রাখাতে আই-ফোন এর চার্জিং স্পিডের বারটা বেজে যায় প্রায় ২ ঘণ্টা লেগে যায় ফুল চার্জ হতে। বাকি Samsung এবং LG এর একই অবস্থা, সেটা দেখতেই পাচ্ছেন।
এবার শেষ বারের মত ফোন গুলোর টেম্পারেচার চেক করে নেয় যাক। এর মাধ্যমে প্রমান হবে সুপার ফাস্ট চার্জার ফোনকে কতটা গরম করে।
দেখতে পাচ্ছি প্রথম দিকে Oppo এর প্রায় ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকলেও পরে অনেক কমে যায়। যদি বাকি ফোন গুলোর কথা বলি, সবার মাঝে টপে আছে আমাদের সবার প্রিয় আই-ফোন। কি বলেন!
আমরা যদি বাজারের ফাস্ট চার্জিং এ ২য় ফোন Huawei P20 এর সাথেও তুলনা করি তাহলেও দেখা যায় এর অর্ধেক সময়ে ফুল চার্জ হয়ে যায় Oppo Find X এটা হচ্ছে SuperVooc এর কারসাজী!
আগেই বলে নিতে চাই আমার পড়াশুনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং থেকে, বুয়েট থেকে না, সুতরাং সাইন্স বা ফিজিক্স নিয়ে গভীর কোন জ্ঞান আমার নেই। এখন যে তথ্য গুলো দেব সেগুলো বিভিন্ন জায়গা থেকে রিসার্চ করে, Oppo এর বিভিন্ন সোর্স থেকে নেয়া। চেষ্টা করব সহজেই বুঝিয়ে দিতে।
সুপার ফাস্ট চার্জিং আসলে কিভাবে কাজ করছে?
চার্জিং স্পিড পরিমাপ করা হয় ওয়াট দিয়ে যা তৈরি হয় ভোল্টেজ এবং কারেন্ট এর সমন্বয়। ওয়াট যত বেশি হবে ফোন চার্জ তত দ্রুত হবে।
সাধারণত গতানুগতিক রেগুলার চার্জার গুলো থাকে ১০ ওয়াটের যা 10W= 5V*2A। আর অধিকাংশ ফোনের ব্যাটারিও থাকে ৫ ভোল্টের।
বেশিরভাগ ফাস্ট চার্জিং যা করে সেটা হচ্ছে তারা চার্জের স্পীড বাড়িয়ে দেয় ভোল্টেজ বৃদ্ধির মাধ্যমে। অতিরিক্ত ভোল্টেজের জন্য ফোন একবার হিট হয় এবং ফোন গুলোকে সঠিক ভাবে ব্যবহার করার জন্য চার্জের ভোল্টেজ ৯ থেকে কমিয়ে ৫ ভোল্ট করে নিতে হয় যা ফোনের ব্যাটারিতে কনভার্ট হয় এতে আবার হিট হয় সুতরাং আমরা আমরা দেখতে পাচ্ছি ভোল্টেজ বাড়ানোর জন্য ফোন পরপর দুইবার হিট হচ্ছে যা মোটামুটি এক ধরনের সমস্যা।
আবার Huawei যা করে সেটা হচ্ছে তারা ভোল্টেজ না বাড়িয়ে কারেন্ট মানে অ্যাম্পিয়ার বাড়িয়ে দেয় (22.5W = 5V * 4.5 A) এবং ফাস্ট চার্জিং এর ক্ষেত্রে এটাও দারুণ কাজ করে। এবং আগের পদ্ধতিতে যেখানে দুইবার হিট হত সেখানে এই পদ্ধতি হিট হয় একবার। তারমানে বড় সমস্যার কিছুটা সমাধান এটি। একই ভাবে Oppo এর সাধারন চার্জার এবং OnePlus প্রায় একই পদ্ধতি ফলো করে।
এবার ফাইনালি আসা যাক SuperVOOC চার্জার এর কাছে। তাদের স্পিড ৫০ ওয়াট! ভোল্টেজ ১০ এবং অ্যাম্পিয়ার ৫! কি আবাক হচ্ছেন? আবাক হবারই কথা কারণ ৫০ আমরা সাধারণত ল্যাপটপ এর ক্ষেত্রেই দেখে আসছি। কিন্তু ফোনের ক্ষেত্রে কিভাবে কাজ করে?
আমার ব্যক্তিগত ভাবে তাদের এই উদ্ভাবন দারুণ লেগেছে। তারা যা করেছে, তাদের ফোনের ব্যাটারি টি হচ্ছে ১০ ভোল্ট এবং ব্যাটারি দুইটি আলাদা সেল দিয়ে বানানো এবং প্রতিটি সেল ৫ ভোল্ট করে। সুতরাং ১০ ভোল্ট চার্জ এর জন্য ফোনের ভেতর আলাদা ভাবে কনভার্ট করার দরকার হয় না। এবং অতিরিক্ত হিট ও হয় না। চার্জার দুইটি ব্যাটারি সেলকে একই সাথে চার্জ দেয় এবং এই স্পেশাল ব্যাটারি ফোনকে প্রয়োজন মত মাত্র ৫ ভোল্টই সরবারহ করে।
চলুন এবার এই সুপার ফাস্ট চার্জিং SuperVooc এর কিছু সুবিধা জেনে নেয়া যাক।
দুইটি খারাপ দিক আছে যেমন প্রথমত এটির খরচ। SuperVocc এটি ডেভেলপ করতে মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। এটি তৈরিতে ব্যবহার করতে হয়েছে অতিরিক্ত কিছু কম্পোনেন্ট। এটিতে দরকার হয়েছে ৫ ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, কিছুটা ভারী চার্জার, অতিরিক্ত চিকন চার্জার ক্যাবল। যা খুব স্বাভাবিক ভাবেই ফোনের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে এবং ফোনটি যথেষ্ট ব্যয় সাধ্য। একই সাথে এর রিপ্লেস চার্জারও ব্যয়বহুল।
ভাই! তারপরেও কিন্তু এটি আই-ফোন থেকে অনেক সস্তা, কি বলেন?
আরেকটি খারাপ দিক হচ্ছে এর স্থায়িত্ব, যদি ফোনটি আমি ব্যক্তিগত ভাবে বেশিদিন ব্যবহার করি নি সুতরাং এখানে গ্যারান্টি দিতে পারব না যে কত দিন টিকবে বা ব্যাটারি কত দিন ভাল থাকবে। তবে Oppo এখানে দুটি মন্তব্য করেছে,
"যেহেতু আমাদের ফোন, বাজারের অন্য ফোনের মত গরম হয় না সুতরাং বলা যায় আমাদের ব্যাটারি অনেক বেশিই স্থায়ী হবে এবং আমাদের আগের জেনেরশনের ফোনে যেহেতু একই প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রায় ৯০ মিলিয়ন ফোন বিক্রি করেছি, কোন সেফটি ইস্যু ছাড়া। সুতরাং এবারও এর ব্যতিক্রম কিছু হবে না। "
সবমিলিয়ে আমার কাছে পজিটিভ মনে হচ্ছে তবে দেখা যাক সামনে কি হয়।
এই প্রযুক্তিটি একদম নতুন তাই এখন পর্যন্ত খুব বেশি ফোনে এই সুবিধা দেয়া হয় নি। চলুন দেখি বর্তামানে কোন কোন ফোনে এই সুবিধা পাচ্ছেন।
এতক্ষন যে ফোন নিয়ে এত গবেষণা করলাম চলুন সেটার সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেয়া যাক। চলুন OPPO Find X ফোনটির ডিজাইন নিয়ে আলোচনা করা যাক।
OPPO Find X ফোনটি দেখতে বেশ চমৎকার কারণ এর বেজেল প্রায় নেই বললেই চলে। ফোনটির পপআপ ক্যামেরা থাকার কারণে যেকোনো সময় দ্রুত ছবি তুলা যায়। আর এর ইমেজ কোয়ালিটি দুর্দান্ত। ফোনটিতে আছে 6.4 Amoled ডিসপ্লে যার ভিডিও কোয়ালিটি চমৎকার এবং কালার রেঞ্জ দারুণ। ফোনটিতে দেয়া হয়েছে ২৫৬ জিবি ইন্টারনাল স্টোরেজ।
OPPO Find X ফোনের কিছু বিষয় ভাল লাগে নি একটি হচ্ছে ফোনটি চারপাশ থেকে কার্ভ এবং হাতে নিলে বারবার কেন যেন স্লিপ খায়। যারা ফোন খুব যত্নের সাথে রাখতে পারেন তাদের জন্য ভাল হবে কিন্তু আমার মত যাদের হাত থেকে ফোন দিন কয়েকবার পরে তাদের জন্য বলব এটি জঘন্য চয়েজ হতে পারে। অন্য দিকে ফোনটিতে রাখা হয় নি কোন ফিঙার প্রিন্ট। যা বর্তমান সময়ের সাথে খুব বেমানান।
OPPO Find X ফোনটিতে রাখা হয় নি কোন হ্যাডফোন জ্যাক। হতে পারে ব্লুটুথ হ্যাডসেট কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে কিন্তু হ্যাডফোন জ্যাকের বিকল্প হয় না। ফোনটিতে গান শুনে তেমন কোন মজা পাই নি। স্পিকার গুলো ব্যাটার কোয়ালিটির মিউজিক দিতে প্রায় ব্যর্থ। ফোনটিতে যেহেতু SuperVooc চার্জার আছে সুতরাং বুঝতেই পারছেন এতে ওয়ারলেস চার্জারের ব্যবস্থা নেই।
MWC 2022 এ Oppo দুটি আপকামিং VOOC ঘোষণা করেছে। প্রথমটি 150W SuperVOOC (20V 7.5A), যা দিয়ে 4, 500mAh ব্যাটারি ৫০% হতে সময় লাগবে মাত্র ৫ মিনিট আর ১০০% হতে সময় লাগবে ১৫ মিনিট। অন্যটি 240W SUPERVOOC Flash Charge" (24V 10A) যা পুরো ব্যাটারি চার্জ করতে সময় নেবে ৮ মিনিট ৯ সেকেন্ড, ৫০% হতে ৩ মিনিট ২৪ সেকেন্ড।
বর্তমানে প্রায় সব ফোন ব্র্যান্ড গুলোই সুপার ফাস্ট চার্জিং নিয়ে আসছে। তবে ফাস্ট চার্জিং সুবিধা থাকার পরেও যে প্রশ্ন থেকে যায় সেটা হচ্ছে ফোন গরম হয় কিনা বা সেইফ কিনা, এই দিক থেকে আমি মনে SuperVooc এর উদ্ভাবনটি দারুণ।
কেমন লাগল আজকেই এই টিউনটি তা অবশ্যই জানাবেন। এই টিউন পড়ে আপনার কি মনে হয় তা অবশ্যই টিউমেন্ট করুন।
পরবর্তী টিউন পর্যন্ত ভাল থাকুন। আমাদের সমসাময়িক যে সংকট চলছে এর থেকে রক্ষা পেতে সবাই সচেতন থাকবেন কারণ আপনার সচেতনতাই পারে আমাদের সবাইকে খারাপ অবস্থা থেকে বাচাতে। সবাই বাসায় থাকুন আর আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন, আল্লাহ হা-ফেজ।
আমি সোহানুর রহমান। সুপ্রিম টিউনার, টেকটিউনস, ঢাকা। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 11 বছর যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 585 টি টিউন ও 200 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 118 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
কখনো কখনো প্রজাপতির ডানা ঝাপটানোর মত ঘটনা পুরো পৃথিবী বদলে দিতে পারে।