বিশ্বতত্ত্ব : অনাদি ও অনন্ত’

বিংশ শতাব্দীতে নিরীশ্বরবাদের ওপর প্রথম আঘাতটি আসে বিজ্ঞানের বিশ্বতত্ত্ব (cosmology) নামক শাখা থেকে। এ-বিশ্বজগতের কোনো শুরু নেই, এটি অনাদিকাল থেকে অস্তিত্বশীল ছিল এবং অনন্তকাল পর্যন্ত থাকবে-এ ধারণা এ-সময় মিথ্যা প্রমাণিত হয়; আবিষ্কৃত হয়-এ বিশ্বজগতের একটা শুরু ছিল। সোজাভাবে বললে, এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয় যে, এ-বিশ্বজগত শূন্য থেকে (from nothing) সৃষ্টি করা হয়েছে।

অনাদি ও অনন্ত বিশ্বজগতের ধারণা পাশ্চাত্যে এসেছিল বস্তুবাদী দর্শনের কাঁধে ভর করে। প্রাচীন গ্রীসে এ-দর্শনের জন্ম। এ-দর্শন অনুসারে: এ-বিশ্বজগত অনাদিকাল থেকে চলে আসছে ও অনন্তকাল পর্যন্ত চলবে এবং বস্তুর বাইরে এ-বিশ্বজগতে অন্য কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। যেহেতু মধ্যযুগে পাশ্চাত্যে চার্চের দোর্দণ্ড প্রতাপ ছিল, বস্তুবাদ সেখানে তখন ততটা পাত্তা পায়নি। আধুনিক যুগে এসে পশ্চিমা বিজ্ঞানী ও দার্শনিকরা গ্রীক দর্শনের দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং এর ফলে বস্তুবাদ আবার পাদ-প্রদীপে চলে আসে।

বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট (Immanual Kant) 'বস্তুবাদী' শব্দটির প্রচলিত অর্থে বস্তুবাদী ছিলেন না। অথচ আধুনিক যুগে তিনিই হচ্ছেন প্রথম ব্যক্তি যিনি বিশ্বজগতকে বস্তুবাদের আলোকে ব্যাখ্যা করেন। কান্ট ঘোষণা করেন: এ-বিশ্বজগত অনাদি ও অনন্ত এবং কোনো কিছুই বিশ্বজগতের বাইরে নয়। ঊনবিংশ শতাব্দী যখন শুরু হলো, তখন ব্যাপকভাবে এ-ধারণা গৃহীত হয়ে গেছে যে, এ-বিশ্বজগতের কোনো শুরু নেই এবং একে সৃষ্টিও করা হয়নি। পরবর্তী কালে কার্ল মার্কস (Karl Marx) ও এঙ্গেলস (Friedrich Engels)-এর মতো দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদীরা এ ধারণাকে সমর্থন করেন এবং ধারণাটি বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেও কমবেশি গুরুত্ব পেতে থাকে। অনাদি ও অনন্ত বিশ্বের ধারণা সবসময়ই নিরীশ্বরবাদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। বিশ্বজগত কোনো এক সময় শুরু হয়েছিল- এ-ধারণা মেনে নেয়ার অর্থ একজন স্রষ্টাকে মেনে নেয়া। তাই বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি না-থাকা সত্ত্বেও দাবী করা হলো যে, বিশ্বজগত অনাদি ও অনন্ত। এ দাবী যারা করতেন তাদের মধ্যে ছিলেন জর্জেস পলিটজার (Georges Politzer) ও। তিনি বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে Principes Fondamentaux de Philosophie (The Fundamental Principles of Philosophy) নামক গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে বস্তুবাদ ও মার্কসবাদের একজন গোড়া সমর্থক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। অনাদি ও অনন্ত বিশ্বজগতের ধারণাকে অকাট্য মেনে নিয়ে তিনি সৃষ্টির ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি লেখেন: “বিশ্বজগত কোনো সৃষ্ট বস্তু নয়। এটি সৃষ্ট হলে অবশ্যই একে শূন্য থেকে তাৎক্ষণিকভাবে একজন স্রষ্টা কর্তৃক সৃষ্ট হতে হতো। সৃষ্টির ধারণা মেনে নিতে হলে এ-কথাও মেনে নিতে হয় যে, এমন একটা সময় ছিল যখন বিশ্বজগতের অস্তিত্ব ছিল না এবং আরো মেনে নিতে হয় যে, শূন্য থেকে কোনো কিছু সৃষ্টি করা সম্ভব। অথচ এটি এমন এক কথা যা বিজ্ঞান মেনে নিতে পারে না। ”

সৃষ্টির ধারণার বিরুদ্ধে এবং অনাদি ও অনন্ত বিশ্বজগতের ধারণার পক্ষে অবস্থান নিয়ে পলিটজার ভেবেছিলেন, বিজ্ঞান তাঁর পক্ষে আছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল বিজ্ঞান তাঁর পক্ষে নেই। সহসাই বিজ্ঞান আবিষ্কার করলো, বিশ্বজগতের একটা শুরু ছিল। আর বিশ্বজগতের শুরু যখন আছে, তখন—পলিটজারের বিচারেই একজন স্রস্টার অস্তিত্ব স্বীকার - না-করে উপায় থাকে না।

বিশ্বজগত যে অনাদি নয়, এক সময় যে এটি শূন্য থেকে সৃষ্টি হয়েছিল-এ-সত্য জানা যায় 'বিগ ব্যাং' (Big Bang) তত্ত্বের আবিষ্কারের ফলে। বিংশ শতাব্দীর সম্ভবত সবচে' গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার এটি। বস্তুত, একাধারে অনেকগুলো আবিষ্কারের ফসল হিসেবে বিগ ব্যাং তত্ত্বের জন্ম। ১৯২৯ সালে আমেরিকার জ্যোতির্বিদ এডউইন হাবল (Edwin Hubble) লক্ষ্য করেন যে, বিশ্বজগতের গ্যালাক্সিগুলো পরস্পর থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। অন্যভাবে বললে, তিনি আবিষ্কার করলেন, বিশ্বজগত ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে। এ আবিষ্কার সংশ্লিস্ট বিজ্ঞানীদের একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বাধ্য করলো। সিদ্ধান্তটি হলো: এ-বিশ্বজগত সৃষ্টি হয়েছে একটি একক পয়েন্ট (single point) থেকে। জ্যোতির্বিদরা হাবলের আবিষ্কারের সারবত্তা পরীক্ষা করতে যেয়ে আবিষ্কার করলেন আরেকটি সত্য। সত্যটি হচ্ছে : বিশ্বজগত যে-একক পয়েন্ট বা বিন্দু থেকে সৃষ্টি হয়েছে, সেটির মাধ্যাকর্ষণশক্তি ছিল অসীম এবং ভর (mass) ছিল শূন্য; আর এই ভরহীন পয়েন্টে এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণের ফলেই বজ্র ও সময় অস্তি জ্বলাভ করে এবং সৃষ্টি হয় সম্প্রসারণশীল (expanding) এ- এ বিশ্বজগতের। অন্যভাবে বললে, এ-বিশ্বজগত সৃষ্টি হয়েছে শূন্য (nothing) থেকে।

বিগ ব্যাং বা 'মহা-বিস্ফোরণ তত্ত্ব' আবিষ্কৃত হলেও, অনেক জ্যোতির্বিদই একে সত্য বলে মেনে নিতে অস্বীকার করলেন এবং অনাদি বিশ্বজগতের পুরনো বিশ্বাসই আঁকড়ে ধরে থাকলেন। এ-গোড়ামীর কারণ
খুঁজে পাওয়া যাবে বিখ্যাত বস্তুবাদী পদার্থবিদ আর্থার এডিংটনের (Arthur Eddington) বক্তব্যে। তিনি বলেছিলেন: “বর্তমানে আমরা যে-প্রকৃতি দেখছি, সেটি একসময় আকস্মিকভাবে অস্তিত্বলাভ করতে শুরু করেছিল-এ-ধারণা আমার কাছে ফিলসফিক্যালি (phylosophically) অগ্রহণযোগ্য। ” বস্তুবাদীদের কাছে অগ্রহণযোগ্য হলেও, বিগ ব্যাং তত্ত্ব কিন্তু পরবর্তী কালে বিভিন্ন সুস্পষ্ট বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের দ্বারা সত্য প্রমাণিত হতে থাকে। ঊনবিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে আরনো পেনজিয়াস (Arno Penzias) ও রবার্ট উইলসন (Robert Wilson) নামক দুজন বিজ্ঞানী মহা-বিস্ফোরণের (Big Bang) তেজষ্ক্রিয় অবশেষ (radioactive remains) চিহ্নিত করেন। নব্বই এর দশকে কোবে (COBE, Cosmic Background Explorer) স্যাটেলাইট বিজ্ঞানী দুজনের পর্যবেক্ষণের সত্যতা প্রমাণ করে।

এসব সত্য আবিষ্কারের ফলে কোনঠাসা হয়ে পড়ে নাস্তিকরা। প্রসঙ্গক্রমে, 'Atheistic Humanism'-এর লেখক ও University of Reading-এর দর্শনের নাস্তিক অধ্যাপক এন্থনি ফ্লিউ (Anthony Flew)-এর আগ্রহউদ্দীপক স্বীকারোক্তির কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলছেন: “স্বীকারোক্তি আত্মার জন্য ভালো বলে কুখ্যাতি আছে। আমি স্বীকার করছি যে, সৃষ্টিতত্ত্বসংক্রান্ত সমকালীন সর্বসম্মত মত নাস্তিকদের ভালোরকম বিব্রত করবে। কারণ, বিশ্বজগতের একটা শুরু ছিল-এ-কথাটা St. Thomas-এর মতে ফিলসফিক্যালি প্রমাণ করা সম্ভব না-হলেও, দেখা যাচ্ছে, সৃষ্টিতত্ত্ববিদরা এর সপক্ষে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ঠিকই হাজির করছেন। .(বিশ্বজগতের কোনো শুরু বা শেষ নেই-এ ধারণাটা) যদিও আমি এখনো সঠিক বলেই বিশ্বাস করি, তথাপি বলতেই হচ্ছে যে, বিগ ব্যাং তত্ত্বের উপস্থিতিতে ওই বিশ্বাসের ওপর স্থির থাকা মোটেই সহজ ও স্বস্তিদায়ক ব্যাপার নয়। ”

বিগ ব্যাং তত্ত্বের বিরুদ্ধে নাস্তিকদের ক্ষোভ প্রকাশ করার আরো উদাহরণ আছে। ১৯৮৯ সালে লিখিত এক নিবন্ধে বিখ্যাত বস্তুবাদী বিজ্ঞান জার্নাল Nature-এর নিরীশ্বরবাদী সম্পাদক জন মেডক্স (John Maddox) এ তত্ত্বের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। 'বিগ ব্যাং নিপাত যাক'-শীর্ষক ওই নিবন্ধে মেডক্স লিখেছেন যে, বিগ ব্যাং 'ফিলসফিক্যালি অগ্রহণযোগ্য'। তিনি আরো ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, বিগ ব্যাং তত্ত্ব পরবর্তী দশকে টিকে থাকবে এমন সম্ভাবনা কম। বলা বাহুল্য, মেডক্সের ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক প্রমাণিত হয়নি, বরং উল্টো এ-তত্ত্বের গ্রহণযোগ্যতা পরবর্তী দশকে আরো বেড়েছে এবং অনেক আবিষ্কারই বিশ্বজগত সৃষ্টির ধারণার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। অবশ্য কোনো কোনো বস্তুবাদী মনীষী এ-ব্যাপারে তুলনামূলকভাবে যৌক্তিক হতে চেয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, ইংরেজ বস্তুবাদী পদার্থবিদ এইচ পি লিপসন-এর (H. P. Lipson) কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। এই বিজ্ঞানী, অনিচ্ছা সত্তেও, সৃষ্টিসম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক সত্যকে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন: “আমি মনে করি আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, সৃষ্টির ধারণা এ-ক্ষেত্রে একমাত্র ধারণা যা গ্রহণ করা যেতে পারে। এটা মেনে নেয়া আমার মতো অন্য পদার্থবিদদের জন্যও কঠিন। কিন্তু গবেষণালব্ধ প্রমাণাদি যখন একে সমর্থন করে, তখন তা স্বীকার না-করে উপায়ই বা কী?” (দেখুন, H.P. Lipson, “A Physicist Looks at Evolution", Physics Bulletin, vol. 138, 1980, p.241)।

মোদ্দাকথা, আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যা চূড়ান্তভাবে যে-সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে, তা হচ্ছে: সময় (time) ও বস্তুর (matter) প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন থেকে অসীম ক্ষমতাধর একজন স্রষ্টা-ই ও-দুটোকে সৃষ্টি করেছেন। যে অনন্ত শক্তি বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন, তিনি-ই হলেন আল্লাহ যিনি অফুরন্ত ক্ষমতা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী। -

Level 1

আমি Sk Shakib। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 1 বছর 6 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 8 টি টিউন ও 0 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 1 টিউনারকে ফলো করি।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস