আল হামদুলিল্লাহ এর মানে কি আপনি জানেন? জেনে নিই অজানা কিছু কথা যা কুরআনের আরেকটু কাছে আসতে সাহায্য করবে

"আল হা'মদুলিল্লাহি রব্বিল আ'লামিন" সূরা ফাতিহা, আয়াত-১
"সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর, যিনি এই বিশ্ব জগতের মালিক। "

এই অনুবাদ কি সত্যিই সম্পূর্ণ ভাব প্রকাশ করেছে? সঠিকভাবে?

চলুন এই আয়াত নিয়ে নতুন কিছু জেনে নিই। এই টিউনে শুধু মাত্র আল হামদুলিল্লাহ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। অর্থাৎ আয়াতটির প্রথম অংশ নিয়ে।

"হামদ" শব্দের অর্থ আরবী ভাষায় ২টি জিনিস বোঝায়।
১. প্রশংসা
২. কৃতজ্ঞতা বা ধন্যবাদ
বেশিরভাগ অনুবাদেই হামদ শব্দের অর্থ করা হয়ে থাকে প্রশংসা। এটি ভুল নয়। তবে আপনারা হয়তো শুনে থাকবেন, বলা হয়ে থাকে কুরআন কেবল মাত্র অনুবাদের মাধ্যমে অর্থ বোঝা সম্ভব না।
কিন্তু কেন? জানেন কি সেটা?
আচ্ছা, কেমন হয় যদি এই অনুবাদ করা হয়,
"সমস্ত ধন্যবাদ একমাত্র আল্লাহকে, যিনি এই বিশ্বজগতের মালিক"।
বেশ ভিন্ন ধরনের অনুবাদ, তাই না?
কিন্তু প্রশংসা এবং ধন্যবাদ দু'টি আলাদা জিনিস। তারা এক রকম নয়।
তাই যে আলোচনাটা প্রথমে করা উচিত, সেটি হল প্রশংসা এবং ধন্যবাদের মধ্যে পার্থক্য কোথায়!
ধরুন আপনি রাস্তা দিয়ে হাটছেন। আর একটা খুবই সুন্দর একটি গাড়ি দেখলেন। তখন আপনি কি করেন? প্রশংসা করেন? নাকি ধন্যবাদ দেন?
আপনি এটার প্রশংসা করেন। ধন্যবাদ দেন না।
আবার ধরুন আপনি এমন এক বাড়িতে গেলেন যেখানে খুবই সুন্দর একটি ছোট্ট বাচ্চা আছে। আপনি বাচ্চাটিকে তার সৌন্দর্যের জন্য কি ধন্যবাদ দেন? নাকি প্রশংসা করেন?
প্রশংসা করেন, আশা করি আপনি তাকে ধন্যবাদ দেন না।
আর ধন্যবাদ একটি ভিন্ন জিনিস। আপনি সাধারণত তখনই কাউকে ধন্যবাদ দেন, যখন সে আপনার জন্য বা কারো জন্য ভালো কিছু করে।
তাই আপনি যখন মনোমুগ্ধকর কিছু দেখেন, আপনি তার প্রশংসা করেন। আর যখন দেখেন আপনার জন্য কিংবা অন্য কারো জন্য কেউ কিছু করে, তখন আপনি তাকে ধন্যবাদ দেন।
যখন আপনি কারো প্রশংসা করেন, তার মানে এই না যে, আপনি তাকে ধন্যবাদও দেন। আবার আপনি যখন কাউকে ধন্যবাদ দেন, তার মানে এই না যে, আপনি তার প্রশংসাও করেন।
এটা নিয়ে চিন্তা করুন। কিভাবে আপনি কাউকে ধন্যবাদ দিবেন প্রশংসা না করে? আসুন, কুরআন থেকেই উদাহারণ দেয়া যাক।
মূসা (আ) বেশ অদ্ভুত একটা পরিবারে বড় হয়েছে, একথা আপনারা অনেকেই জানেন। তিনি ফেরাউনের কাছে বড় হলেন। ফেরাউন তাকে সন্তান হিসেবে নিয়েছিলো। ফেরাউনই তাকে লালন-পালন করেছে।
আর অনেক বছর পর মূসা(আ) যখন ফিরে এলেন, তখন ফেরাউন তাকে বলেছিল, কি করে, কোন সাহসে তুমি আমার সাথে এমন করে কথা বলো? আমরাকি তোমাকে লালন-পালন করিনি?
তুমি কি কৃতজ্ঞ না? আর তখন মূসা (আ) বললেন, "সেটাতো আমার প্রতি আপনার একটা অনুগ্রহ ছিলো। ধন্যবাদ। " এটা ছিলো তার ধন্যবাদ দেওয়ার ধরন। অন্য ভাবে বললে, ফেরাউন কখনোই প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য না।
তাহলে প্রশংসা ছাড়াও ধন্য বাদ জানানো সম্ভব।
আবার কুরআন বলছে, তোমরা পিতা মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। কিন্তু যদি তোমার পিতা মাতা শিরক করতে তোমাকে বাধ্য করে, তোমরা তার কথা শুনো না। কিন্তু আয়াতে শুরুতে বলেছেন যে, তবুও তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ হও।
আর আল্লাহ সূরা ফাতিহায় বলছেন যে, প্রশংসা আল্লাহর জন্যে। তিনি এটাও বলছেন কৃতজ্ঞতাও আল্লাহর জন্য। তিনি যেকোন একটার কথা বলছেন না। তিনি দুটোর কথাই বলছেন।
যদি আরবীতে বলা হয়,
"আল মাদ-হুলিল্লাহ", এর অর্থ কি জানেন? এর অর্থ হচ্ছে, প্রশংসা আল্লাহর জন্য। অনুবাদ আগের মতোই আছে। কারণ "মাদ্দ" অর্থও প্রশংসা।
আবার যদি বলা হয়,
"আস শুকরু লিল্লাহ", এর অর্থ কি জানেন? এর অর্থ হচ্ছে, কৃতজ্ঞতা আল্লাহর জন্য। কারণ "শুক্রু" অর্থও কৃতজ্ঞতা।

কিন্তু আল্লাহ বলছেন, আল হামদুলিল্লাহ। এর অর্থ একি সাথে দুটোই।
তাহলে "মাদ্দ" আর "শুক্রু" থেকে "হামদ" কেন ভালো?

ধরুন আপনি গাড়ি চালাচ্ছেন। আর আপনার কাছে ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। রাস্তার পুলিশ ধরলো আপনাকে। আর আপনি বলছেন পুলিশকে যে, স্যার আপনাকে দারুন লাগছে, আপনার ড্রেসটায় খুবই সুন্দর মানিয়েছে আপনাকে।
আপনি তার প্রশংসা করছেন।
সেগুলো কি সত্যিকরের প্রশংসা? না।

আবার ধরুন, আপনার পরীক্ষার ফলাফল দিয়েছে। আপনি ফেল করলেন। আর বাসায় এসে বলছেন, মা তোমার রান্না আজ বেশ মজা হয়েছে। তোমাকে এই কাপড়ে বেশ ভালো লাগছে। তোমাকে খুব ভালোবাসি মা!
আপনি কি আপনার মার সত্যিকারেই প্রশংসা করছেন? না। আপনি তার মিথ্যে প্রশংসা করছেন, যেন তিনি আপনাকে পরীক্ষার ফলাফলের কথা জিজ্ঞেস না করেন।
তার মানে প্রশংসা মিথ্যেও হয়। মিথ্যে প্রশংসা করা হয় রাযাদের জন্যে। অফিসের বসদের জন্যেও মিথ্যে প্রশংসা করা হয়।
আবার প্রশংসা যে কেবল মিথ্যে হবে সব সময় তা নয়। আর প্রশংসাকে আরবীতে বলা হয় "মাদ্দ", যেটা আসলে আল্লাহর জন্য পুরোপুরি উপযুক্ত নয়।

এবার "শুক্রু" নিয়ে ভাবা যাক।
আপনি গাড়ি চালাচ্ছেন, আর আপনার গাড়ির চাকা পানচার হয়ে গেল। আর নতুন চাকা লাগাতে কেউ আপনাকে সাহায্য করেছে। আপনি তাকে তখন ধন্যবাদ দেন। কিন্তু আপনাকে কে সাহায্য করেছে, সেটা যদি আপনি না জানেন, অথবা এমন হয়েছে যে, আপনার গাড়ির চাকা পানচার হয়েছে আপনি বলতেই পারবেন না, আপনি গাড়িতে ঘুমিয়ে আছেন বা অন্য কিছু, আপনাকে কেউ সাহায্য করেছে গাড়ির চাকা বদলে দিয়ে, তখন আপনিকি তাকে ধন্যবাদ দিবেন? না। কারণ ধন্যবাদ দেয়া জন্য কোনো কারণ থাকতে হবে। আপনি ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে ধন্যবাদ দিবেন না, যতক্ষন না আপনি বুঝবেন যে, সে আপনার উপকার করেছে।

আর আল্লাহ "শুক্রু" আর "মাদ্দ" ব্যবহার না করে কেবল "হামদ" ব্যবহার করেছেন। যার দ্বারা দুটো অর্থকেউ বোঝায়। আর শব্দ হিসেবে "হামদ" কেবল অকৃত্রিম ই হতে পারে। এটি তৈরি করা যায় না। এটি অকৃত্রিম প্রশংসা। এটি দ্বারা কোন মিথ্যে প্রশংসা বোঝানো হয় না। এটি কেবল আল্লাহর জন্যে। এটি কোনো প্রতিকৃয়াও না। এটা 'আল মাদহুলিল্লাহ' বলার থেকেও বেশি শক্তিশালী। এটা 'আস শুক্রুলিল্লাহ' বলার থেকেও বেশি শক্তিশালী।

তাহলে "আল হামদুলিল্লাহ" এর ধারণা বোঝাতে বাংলায় ২টি শব্দ লাগে। একটি হলো ধন্যবাদ, আরেকটি হলো প্রশংসা। তাহলে এখানে আমরা বুঝতে পারলাম অনুবাদের একটা কঠিনতম নীতি, যে, কেন কুরআন বুঝতে অনুবাদ নয়, আরবী জানা দরকার। তবে আরবী না জানলে অন্তত অনুবাদ পড়তে পারেন। তবে সেটা দ্বারা পূর্ণ ভাব পাবেন না।

আচ্ছা, কি হতো আল্লাহ যদি ২টি শব্দই ব্যবহার করতো আল্লাহ?

আরবীতে "এবং" কথাটি বোঝাতে ব্যবহার করা হয় "ওয়া" শব্দ।

আল্লাহ যদি বলতেন
"আল মাদ্দহু ওয়াশ-শুক্রুলিল্লাহ", তাহলে কি হতো? এর অর্থ কি আল হুমদুলিল্লা-র মতো হতো?

আসলে না। হতো না। আরবী ভাষার একটা সুন্দর নীতির জন্য এটা একই রকম হতো না। আরবীতে বলা হয়ে থাকে একটা বাক্য "সব চেয়ে সুন্দর কথা সেটাই, যেটা অল্প কথায় পূর্ণ ভাব প্রকাশ করে"

তাহলে "আল হামদুলিল্লাহ" বলা, "আল মাদ্দহু ওয়াশ-শুক্রুলিল্লাহ" বলার চেয়ে ভালো। তবে, এখানে আরো একটা পার্থক্য রয়েছে।

"এবং" এর আরবী শব্দ "ওয়া" শব্দটি আরবী ব্যাকরণ অনুযায়ী ২টি জিনিস করে আলাদা করে। এবং কি অর্থের দিক দিয়েও।

যদি আপনি বলেন
"আল মাদ্দহু ওয়াশ-শুক্রুলিল্লাহ" তার মানে আপনি বলছেন যে, আল্লাহর প্রশংসা কিছু জিনিসের জন্যে, আর কৃতজ্ঞতা অন্য কিছু জিনিসের জন্য। অর্থাৎ কখনো আপনি তার প্রশংসা করছেন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে, আর কখনো আপনি তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন প্রশংসা না করে।
কিন্তু আপনি যখন আল হামদুলিল্লাহ বলেন, তখন আপনি কৃতজ্ঞতা এবং প্রশংসা একই সময়ই একই সাথে প্রকাশ করছেন।

আল হামদুলিল্লাহ কথাটি আমাদের ইতিবাচক ভাবতে সাহয্য করে।

যেমন: আপনার দিনটি খারাপ যাচ্ছে, আর কেউ আপনাকে জিজ্ঞেস করছে, কেমন যাচ্ছে আজকের দিনটা? তখন আপনি বললেন আল হামদুলিল্লাহ, ভালোই।

আসলেই কি আপনি কথাটা মন থেকে বলেছেন? আল্লাহর কাছে এটাই একমাত্র বিষয় না যে, আপনি মুখ দিয়ে কি বললেন। আল্লাহ আপনার অন্তরও দেখবেন। আপনি কি মন থেকেই বলেছেন কি না।

যেমন আপনি জ্যামে রাস্তায় পড়ে আছেন, আর নিজে নিজে বললেন আল হামদুলিল্লাহ! এমনটা ভাবা অবশ্য বেশ কঠিন। তবে, যখন আপনি আল হামদুলিল্লাহ বলবেন, তখন আপনি ইতিবাচক চিন্তা করতে শুরু করতে পারেন। আপনি ভাবতে পারেন যে, "হে আল্লাহ, এই জ্যামটা উপর থেকে হয়তো বেশ খারাপ লাগছে, কিন্তু হয়তো এই জ্যাম আমার জন্য মঙ্গল জনকই। আমি আপনার প্রশংসা করছি এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, কারণ আমি নিরাপদে আছি। আমার জন্য এই গাড়িটি আপাতত হলেও আছে, যা নিয়ে অন্তত জ্যামে আটকে থাকতে পারি। কিন্তু অন্তত গাড়িতো আছে। "
তাহলে আল হামদুলিল্লাহ যেটা করে, তা হলো, একজন মুসলিমকে ইতিবাচক চিন্তা করতে শিখায়।

একটু নড়ে চড়ে বসুন, আর মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। না হলে নিচের কথা গুলো বুঝতে পারবেন না।
আরবীতে আপনি বিশেষ্য পদও ব্যবহার করতে পারেন। আবার ক্রিয়া পদও। আর ক্রিয়ার কাল আছে, বিশেষ্য পদের কোন কাল নেই। এখন মনে হচ্ছে ব্যাকরন শিখাচ্ছি। তবে ঠিক তা নয়।

ধরুন যদি বলি, আমি আল্লাহর প্রশংসা করি।

এখানে কি ব্যবহার করেছি? ক্রিয়া ব্যবহার করেছি। ক্রিয়ার জন্যে একজন কর্তা দরকার হয়। আর এই বাক্যে বর্তমান কাল বোঝানো হয়েছে।

আর যদি বলি 'প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্যে'
এখানে ক্রিয়া ব্যবহার হয় নি। এখানে বিশেষ্য পদ ব্যবহার হয়েছে। যেটার কোনো কাল নেই।

যদি বলি আরবীতে 'আহ মাদুল্লাহ' মানে আমি আল্লাহর প্রশংসা করলাম।

তার মানে আল্লাহর প্রশংসা আমি করছি। যদি না করি, সেই প্রশংসার অস্তিত্ব নাও থাকতে পারে। আমি আল্লাহর প্রশংসা করলাম, এখানে শুধু বর্তমান বোঝানো হচ্ছে। অতীত বা ভবিষ্যতের কথা কিছুই বলা হচ্ছে না। এই ব্যাপারটাই পুরো বিষয়টাকে সৌন্দর্য মন্ডিত করেছে।

সূরা ফাতিহায় আল্লাহ আমাদের বলছেন না এখানে, যে তোমরা আল্লাহর প্রশংসা করো! তার মানে কি? আপনি জানেন? তিনি বলছেন "আল হামদুলিল্লাহ", সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। এখানে বিশেষ্য পদ ব্যবহার করা হয়েছে। তার মানে দাড়ায় আমি প্রশংসা না করলেও আল্লাহর জন্যই সমস্ত প্রশংসা। এটা আমার উপর নির্ভরশীল না। আমি আজ আছি, কাল নাও থাকতে পারি। কিন্তু আল্লাহর প্রশংসা সারা জীবনই থাকবে।

কথা গুলো নোমান আলী খানের লেকচার থেকে নেয়া। লিখতে কিছু ভুল হয়েছে বলে মনে হলে টিউমেন্টে জানিয়ে দিবেন।

Level 0

আমি তারুল খান তারুল। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 6 বছর 8 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 10 টি টিউন ও 9 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 4 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।

I am I


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস