
কৃষক আব্দুল খালেকের অভাব সময়ের বন্ধু লতিরাজ কচু
ভূমিকা
বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের অধিকাংশ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষি খাত ক্রমেই ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। মৌসুমভিত্তিক অতিবৃষ্টি, খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগ ফসল উৎপাদনে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে খরিফ মৌসুমে বাজারে সবজির ঘাটতি দেখা দেয় এবং দাম বেড়ে যায় কয়েকগুণ। এমন সংকটকালীন সময়ে কিছু ফসল কৃষকদের আশার আলো জ্বালায়। তার মধ্যে অন্যতম হলো লতিরাজ কচু।
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার কৃষক আব্দুল খালেক লতিরাজ কচু চাষ করে সাফল্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি এই ফসলকে আখ্যায়িত করেছেন তার জীবনের “অভাব সময়ের বন্ধু” হিসেবে।
প্রেক্ষাপট
সেপ্টেম্বর মাসে বাজারে শাকসবজির ঘাটতি থাকলেও খালেক সাহেব তার লতিরাজ কচুর খামার থেকে নিয়মিত লতি ও ফুল সংগ্রহ করে বিক্রি করতে পেরেছেন। ফলে যেমন তারপরিবার আর্থিক সচ্ছলতা পেয়েছে, তেমনি বাজারেও এই কচু ভোক্তার চাহিদা পূরণ করেছে।
চারা রোপণ ও চাষাবাদ
২০২৩ সালের ২৮ মার্চ, ৫০ শতক জমিতে তিনি লতিরাজ কচুর চারা রোপণ করেন। জমি প্রস্তুত করা, সেচ দেওয়া, আগাছা পরিষ্কার ও নিয়মিত পরিচর্যা করার কারণে মে মাসের শেষ দিক থেকে কচুর লতি সংগ্রহ শুরু হয়। সাধারণত ৭ থেকে ৮টি লতির ওজন এক কেজি হয়। খালেক সাহেব দুই দিন অন্তর প্রায় ৭৫০ কেজি লতি সংগ্রহ করেছেন এবং পাইকারি বাজারে কেজি প্রতি ৫০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন।
এছাড়া কচুর ফুলও উল্লেখযোগ্য আয় এনে দিচ্ছে। প্রতি দুই দিন অন্তর তিনি প্রায় ২০ কেজি ফুল সংগ্রহ করেছেন এবং প্রতিকেজি ৮০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন। চার মাস এভাবে ফুল পাওয়া যায় বলে তিনি জানিয়েছেন।
খরচ ও লাভের হিসাব
৫০ শতক জমির চাষে তার মোট খরচ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১, ০০, ০০০ টাকা (লিজ, শ্রম, সার, সেচ ও পরিবহনসহ)। তবে কচুর লতি বিক্রি করে ইতিমধ্যে তিনি প্রায় ৪, ৫০, ০০০ টাকা আয় করেছেন।
এছাড়া
ফলে মৌসুম শেষে তার মোট আয় দাঁড়ায় প্রায় ৭–৮ লক্ষ টাকা, যা প্রমাণ করে লতিরাজ কচু কৃষকের জন্য একটি অত্যন্ত লাভজনক ফসল।
পুষ্টিগুণ
লতিরাজ কচু শুধু অর্থনৈতিকভাবে নয়, পুষ্টিগুণের দিক থেকেও সমৃদ্ধ। এতে রয়েছেঃ
গ্রামীণ সমাজ ও শহুরে জীবন উভয় যায়গায়ই কচু তরকারি, ভর্তা, ভাজি ও ঝোল হিসেবে খাওয়া হয়।
ভোক্তা দিক
বাংলাদেশে কচু একটি জনপ্রিয় সবজি। তবে লতিরাজ কচু বিশেষভাবে ভোক্তাদের কাছে সমাদৃত, কারণ এরঃ
শুধু দেশীয় বাজার নয়, ভবিষ্যতে যদি যথাযথ প্রক্রিয়াজাতকরণ করা যায়, তবে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে রপ্তানিরও বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে।
কর্মসংস্থান ও সামাজিক প্রভাব
আব্দুল খালেকের কচুর খেতে প্রতিদিন ৮ জন শ্রমিক কাজ করেছেন। তিনি প্রতিদিন কচুর আয় থেকে তাদের মজুরি প্রদান করেছেন। অর্থাৎ তার খামার শুধু তারপরিবারকেই সমৃদ্ধ করেনি, বরং গ্রামের কয়েকটি পরিবারেরও জীবিকা নিশ্চিত করেছে।
এছাড়া লতিরাজ কচু চাষে গ্রামীণ নারীরাও জড়িত হতে পারে, কারণ চারা রোপণ, লতি সংগ্রহ ও বাজারজাতকরণে মহিলাদের অংশগ্রহণ বাড়ানো সম্ভব। এতে পরিবারিক আয় বাড়বে এবং গ্রামীণ অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বাংলাদেশের প্রায় সব জেলা লতিরাজ কচু চাষের জন্য উপযোগী। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যদি কৃষকদের প্রশিক্ষণ, বীজ-চারা সরবরাহ এবং বাজার সংযোগ জোরদার করে, তবে খুব দ্রুত এই ফসল একটি ক্যাশ ক্রপ বা অর্থকরী ফসল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে।
কৃষকের অভিজ্ঞতা
আব্দুল খালেক বলেন, “লতিরাজ কচু ছাড়া এ সময়ে আমার ঘরে অন্য কোনো ফসল নেই। প্রতিদিনের আয়-ব্যয়, শ্রমিকদের মজুরি এমনকি বাড়ি পাকাকরণের কাজও এই কচুর টাকাতেই হচ্ছে। তাই আমি লতিরাজ কচুকে আমার অভাব সময়ের বন্ধু বলি। ”
উপসংহার
লতিরাজ কচু শুধু একটি সবজি নয়, এটি একটি অর্থনৈতিক আশীর্বাদ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কৃষক আব্দুল খালেক প্রমাণ করেছেন যে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে কৃষিতে সফলতা অর্জন সম্ভব।
এ ফসল থেকে একদিকে যেমন কৃষক লাভবান হন, অন্যদিকে ভোক্তারও চাহিদা পূরণ হয়। গ্রামীণ কর্মসংস্থান, নারীর অংশগ্রহণ, পুষ্টি সরবরাহ ও ভবিষ্যৎ রপ্তানি সম্ভাবনা মিলিয়ে বলা যায় যে লতিরাজ কচু বাংলাদেশের কৃষির জন্য একটি টেকসই সমাধান।
তাই খালেক সাহেবের মতো কৃষকদের অভিজ্ঞতা অনুসরণ করে দেশজুড়ে যদি লতিরাজ কচু চাষের প্রসার ঘটে, তবে কৃষি খাতের উন্নয়ন এবং গ্রামীণ জীবনে সমৃদ্ধি আসবেই। সত্যিই, লতিরাজ কচু আজ বাংলাদেশের কৃষকের অভাব সময়ের বন্ধু।
আমি ওবায়দুর রহমান। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 2 মাস 2 সপ্তাহ যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 10 টি টিউন ও 0 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
আমি একজন ডেভেলপমেন্ট প্রফেশনাল, ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন সরকারি ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার সাথে কাজ করছি। ক্লাইমেট চেঞ্জ, অ্যাডাপ্টেশন, মিটিগেশন ও রেজিলিয়েন্স বিষয়ে আমি বিশেষজ্ঞ। পিএইচডি ডিগ্রিধারী হিসেবে গবেষণা, স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানিং, নলেজ ম্যানেজমেন্ট এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে আমার বিশেষ দক্ষতা রয়েছে।