আমেদিও অ্যাভোগাড্রো: সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
লোরেঞ্জো রোমানো অ্যামেডিও কার্লো অ্যাভোগাড্রো (Lorenzo Romano Amedeo Carlo Avogadro) ১৭৭৬ সালের ৯ আগস্ট ইতালির তুরিন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মূলত আইনশাস্ত্রে পড়াশোনা শুরু করলেও পরে পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের দিকে মনোযোগ দেন। রসায়নের মৌলিক ধারণা, বিশেষ করে গ্যাসের আচরণ নিয়ে তাঁর কাজ বিজ্ঞানজগতে বিপ্লব ঘটায়। তিনি ১৮৫৬ সালের ৯ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন।
অ্যাভোগাড্রোর প্রধান অবদান: অ্যাভোগাড্রোর হাইপোথিসিস
অ্যাভোগাড্রোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো তাঁর ১৮১১ সালে প্রকাশিত তত্ত্ব, যা আজ "অ্যাভোগাড্রোর হাইপোথিসিস" (বা আইন) নামে পরিচিত। তিনি বলেছিলেন:
“সমান আয়তনের গ্যাস, যদি তাপমাত্রা ও চাপ এক হয়, তাহলে সব গ্যাসেই অণুর সংখ্যা সমান থাকে। ”
এই ধারণা একদিকে গ্যাসের আয়তন ও তার অণুর সংখ্যার মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করে, অন্যদিকে পদার্থের পারমাণবিক ও অণুসংক্রান্ত ধারণাগুলো স্পষ্ট করে তোলে।
প্রেক্ষাপট: অ্যাভোগাড্রোর সময়ের রসায়ন
অ্যাভোগাড্রোর সময়ে জোসেফ লুই গে-লুসাক গ্যাসের আয়তন সংক্রান্ত একটি নিয়ম প্রকাশ করেছিলেন, যা বলেছিল যে গ্যাসগুলো রাসায়নিক বিক্রিয়ায় সহজুুপাতীয় অনুপাতের আয়তনে বিক্রিয়া করে। কিন্তু এর পিছনের ব্যাখ্যা পরিষ্কার ছিল না। অ্যাভোগাড্রো বুঝতে পেরেছিলেন যে, গ্যাসের আয়তন ও বিক্রিয়ার সরল অনুপাত কেবল তখনই সম্ভব, যখন গ্যাসগুলোর সমান আয়তনে অণুর সংখ্যা সমান হয়। তিনি এটিই তাঁর তত্ত্বে উপস্থাপন করেন।
অ্যাভোগাড্রোর সংখ্যা (Avogadro’s Number)
অ্যাভোগাড্রোর তত্ত্ব থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা এসেছে, যা আজ “অ্যাভোগাড্রোর সংখ্যা” নামে পরিচিত। এক মোল (১ mole) পদার্থে যতগুলো মৌলিক কণা (অণু, পরমাণু, বা আয়ন) থাকে, সেই সংখ্যাটি হলো অ্যাভোগাড্রোর সংখ্যা। এর মান হলো প্রায়:
৬.০২২ × ১০²³
অ্যাভোগাড্রোর মৃত্যুর প্রায় ৫০ বছর পরে জিন পারেন (Jean Perrin) প্রমাণিতভাবে এর মান নির্ণয় করেন এবং অ্যাভোগাড্রোর সম্মানেই সংখ্যাটির নামকরণ হয়।
রাসায়নিক সূত্র নির্ধারণে অবদান
অ্যাভোগাড্রোর তত্ত্ব না থাকলে রাসায়নিক যৌগের সঠিক সূত্র নির্ধারণ করা কঠিন হতো। উদাহরণস্বরূপ, পানির গঠন নিয়ে অনেকের ধারণা ছিল HO, কারণ তারা হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের আয়তন অনুপাত ২:১ দেখে ভুল ব্যাখ্যা দিতেন। কিন্তু অ্যাভোগাড্রোর ধারণা অনুযায়ী বোঝা যায়, দুটি হাইড্রোজেন অণু এবং একটি অক্সিজেন অণু বিক্রিয়া করে পানি তৈরি করে — অর্থাৎ সঠিক সূত্র H₂O। এই তত্ত্ব রাসায়নিক সূত্র নির্ধারণের জন্য মৌলিক ভিত্তি স্থাপন করে।
মোল ধারণার ভিত্তি
অ্যাভোগাড্রোর তত্ত্বের মাধ্যমে পদার্থের "মোল" ধারণা প্রতিষ্ঠা করা সহজ হয়। মোল হলো এমন একটি একক, যা পদার্থের পরিমাণকে অণু বা পরমাণুর নির্দিষ্ট সংখ্যায় প্রকাশ করে। এটি রাসায়নিক পরিমাণ নিরূপণ, বিক্রিয়ার সমীকরণ ব্যালান্স করা এবং সমীকরণ থেকে বিভিন্ন যৌগের গণনা করার জন্য অপরিহার্য।
গ্যাসের মোলার আয়তন নির্ধারণে ভূমিকা
অ্যাভোগাড্রোর তত্ত্বের কারণে জানা যায়, ০°C (২৭৩.১৫ K) এবং ১ এটিএম চাপের (STP) অধীনে যেকোনো গ্যাসের ১ মোলের আয়তন প্রায় ২২.৪ লিটার। এটি "মোলার ভলিউম" হিসেবেও পরিচিত। এই ধারণা গ্যাসের হিসাব-নিকাশে অসাধারণ সুবিধা এনে দিয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত
১) হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের বিক্রিয়া:
২ লিটার হাইড্রোজেন এবং ১ লিটার অক্সিজেন থেকে ২ লিটার পানি বাষ্প উৎপন্ন হয়। অ্যাভোগাড্রোর তত্ত্ব দিয়ে বোঝা যায়, সমান আয়তনের গ্যাসে অণু সমান হলে এই সরল আয়তন অনুপাত অণু অনুপাতে রূপান্তর করা যায় — ফলে পানি গঠনের সূত্র নির্ভুলভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব হয়।
২) অণু ও পরমাণুর পার্থক্য স্পষ্ট করা:
অ্যাভোগাড্রো প্রথম বিজ্ঞানী যিনি অণু ও পরমাণুর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য বোঝান। তিনি বলেন, গ্যাসে একাধিক পরমাণু মিলে অণু তৈরি করতে পারে (যেমন O₂, H₂) — যা সেই সময় নতুন ধারণা ছিল।
সময়োপযোগী স্বীকৃতি না পাওয়া
দুঃখজনক হলেও সত্য, অ্যাভোগাড্রোর জীবদ্দশায় তাঁর তত্ত্ব যথেষ্ট স্বীকৃতি পায়নি। কারণ, তখনকার সময়ে বিজ্ঞানীরা পারমাণবিক ও অণু ধারণা নিয়ে বিভ্রান্ত ছিলেন। তবে ১৮৬০ সালের কোন এক সম্মেলনের পর তাঁর তত্ত্ব গুরুত্ব পেতে শুরু করে, যখন বিজ্ঞানীরা রাসায়নিক সূত্রের একক মানের পদ্ধতি প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন।
আধুনিক রসায়নে প্রভাব
আজ রসায়নের প্রতিটি শাখায় অ্যাভোগাড্রোর অবদান অনন্য। পদার্থের ভর থেকে মোল নির্ণয়, গ্যাসের আচরণ বিশ্লেষণ, বিক্রিয়ার গণনা — সবক্ষেত্রেই তাঁর ধারণা অপরিহার্য ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাঁর তত্ত্ব ছাড়া স্টোকিওমেট্রি, গ্যাস আইন, বা রাসায়নিক বিক্রিয়ার হিসাব অসম্পূর্ণ রয়ে যেত।
উপসংহার
অ্যাভোগাড্রো আমাদের পদার্থের মৌলিক গঠন বুঝতে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিলেন। তাঁর হাইপোথিসিস গ্যাসের আচরণ ও রাসায়নিক বিক্রিয়ার সূত্র নির্ধারণে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। অ্যাভোগাড্রোর সংখ্যা এবং তাঁর তত্ত্ব রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান এমনকি জীববিজ্ঞানেও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাই তিনি বিজ্ঞান জগতের অন্যতম প্রধান পথপ্রদর্শক হিসেবে চিরস্মরণীয়।
আমি তানবীন শুভ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 1 সপ্তাহ 5 দিন যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 15 টি টিউন ও 0 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।