রসায়ন, বিজ্ঞানের এক বিস্ময়কর শাখা, যা আমাদের চারপাশের বস্তুজগৎকে বোঝার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। এই শাস্ত্র আমাদের শেখায় কীভাবে ছোট ছোট পরমাণু ও অণু মিলে সবকিছু গঠন করে এবং কীভাবে পদার্থের এক রূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু এই সহজ সত্যগুলো জানার পেছনে রয়েছে হাজার বছরের লম্বা এক যাত্রা—যা শুরু হয়েছিল মানুষের আদি কৌতূহল থেকে।
খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ সালের দিকে মিশরীয়রা রঙ তৈরি, ধাতু গলানো এবং প্রসাধনী বানানোর জন্য রাসায়নিক পদ্ধতি ব্যবহার করত। প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থ “চরক সংহিতা” বা “রাসায়ন শাস্ত্র” থেকে জানা যায়, সেই সময়ও ঔষধি ও ধাতুপ্রযুক্তি নিয়ে বিস্তৃত জ্ঞান ছিল। প্রাচীন চীনারা বারুদের আবিষ্কার করে মানবসভ্যতায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে—যা রসায়নের এক অসাধারণ উদাহরণ। এভাবে বিভিন্ন সভ্যতা আলাদা আলাদাভাবে রসায়নের প্রাথমিক জ্ঞান বিকশিত করছিল।
এরপর মধ্যযুগে আসে অ্যালকেমির যুগ, যা ইউরোপ, আরব এবং এশিয়ার বৈজ্ঞানিক জগতকে এক করে দেয়। অ্যালকেমিস্টরা বিশ্বাস করতেন, যে কোনো ধাতুকে সোনায় পরিণত করা সম্ভব এবং মানুষের অমরত্বের চাবিকাঠি আছে “ফিলোসফার’স স্টোন”-এ। যদিও অ্যালকেমির লক্ষ্যগুলো আজকের দৃষ্টিতে অবৈজ্ঞানিক, কিন্তু অ্যালকেমিস্টদের নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষাই আধুনিক রসায়নের ভিত্তি গড়ে দেয়। তারা প্রথমবারের মতো ডিস্টিলেশন, ফিল্টারেশন, ক্রিস্টালাইজেশনের মতো পদ্ধতি তৈরি করে, যা আজও ল্যাবরেটরিতে ব্যবহৃত হয়।
১৭শ শতকে রবার্ট বয়েল অ্যালকেমির অস্পষ্ট ধারনাকে চ্যালেঞ্জ করে বিজ্ঞানের পদ্ধতিগত দৃষ্টিভঙ্গি আনেন। ১৬৬১ সালে তাঁর লেখা “The Sceptical Chymist” বইটিকে আধুনিক রসায়নের প্রথম গ্রন্থ হিসেবে ধরা হয়। তিনি বলেন, সব পদার্থ মৌলিক কণায় গঠিত এবং রাসায়নিক বিক্রিয়া বোঝার জন্য নির্ভুল পরিমাপ ও পর্যবেক্ষণ অপরিহার্য। এভাবে রসায়নকে সরাসরি পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা-নির্ভর বৈজ্ঞানিক শাস্ত্রে রূপান্তরিত করেন বয়েল।
১৮শ শতকের শেষ দিকে অ্যান্টনি ল্যাভয়সিয়ে দহন প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করে “উপাদান সংরক্ষণ নীতি” (Law of Conservation of Mass) প্রমাণ করেন। তিনি বলেন, রাসায়নিক বিক্রিয়ায় মোট ভর পরিবর্তিত হয় না—শুধু পদার্থের রূপ বদলে যায়। তাঁর কাজ রসায়নের ইতিহাসে এক বিপ্লব সৃষ্টি করে, কারণ এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে প্রতিটি বিক্রিয়ায় নির্দিষ্ট পরিমাণ মৌলিক উপাদানই থাকে, হারিয়ে যায় না।
১৯শ শতকে জন ডাল্টন পরমাণু তত্ত্ব (Atomic Theory) দেন, যা বলে প্রত্যেক মৌল অনন্য পরমাণুর সমষ্টি। এরপর ১৮৬৯ সালে দিমিত্রি মেন্ডেলিফ মৌলগুলোর গুণাবলী ও পারমাণবিক ভরের ভিত্তিতে পর্যায়সারণী (Periodic Table) তৈরি করেন। এই পর্যায়সারণী রসায়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জামে পরিণত হয়, যা মৌলগুলোর বৈশিষ্ট্য ও পারস্পরিক সম্পর্ক বোঝায় এবং নতুন মৌল আবিষ্কারে বিজ্ঞানীদের দিশা দেয়।
২০শ শতকে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বিকাশ পদার্থ ও রাসায়নিক বন্ধনের অণুস্তর বোঝার দ্বার উন্মোচন করে। এর ফলে আমরা ইলেকট্রন, অরবিটাল ও বন্ডিং এর প্রকৃতি বুঝতে শিখি। একইসাথে জৈব রসায়ন (Organic Chemistry) বিকশিত হয়, যা কার্বন যৌগ নিয়ে কাজ করে এবং জীববিজ্ঞানের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। পলিমার রসায়নের হাত ধরে তৈরি হয় নাইলন, পলিথিন, পলিস্টাইরিনের মতো প্লাস্টিক, যা আজকের জীবনযাত্রায় অপরিহার্য।
এই সময়েই জৈব রসায়ন ও মেডিকেল রসায়নের হাত ধরে ওষুধ শিল্পে বিপ্লব ঘটে। পেনিসিলিনের মতো অ্যান্টিবায়োটিকের আবিষ্কার কোটি কোটি মানুষের প্রাণ বাঁচায়। ভিটামিন ও হরমোনের রাসায়নিক গঠন বোঝার মাধ্যমে মানুষের পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়।
আজকের দিনে রসায়ন শুধু ল্যাবরেটরির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; পরিবেশ সংরক্ষণ, নবায়নযোগ্য শক্তি, কসমেটিকস, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, কৃষি, ইলেকট্রনিক্স, এমনকি মহাকাশ গবেষণায়ও রসায়নের অবদান অনস্বীকার্য। সৌরকোষ (Solar Cell) তৈরি, জলীয় ইলেক্ট্রোলাইসিস পদ্ধতিতে হাইড্রোজেন জ্বালানি উৎপাদন, জৈবপচনশীল প্লাস্টিক তৈরি—এসবই আধুনিক রসায়নের গবেষণার ফল। এমনকি বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধে CO₂ ক্যাপচার প্রযুক্তি, পানির বিশুদ্ধকরণ পদ্ধতি, দূষণমুক্ত শিল্প উৎপাদনেও রসায়নের বড় ভূমিকা রয়েছে।
বর্তমান ও ভবিষ্যতের রসায়ন আরও টেকসই ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবনে মনোযোগী। গ্রিন কেমিস্ট্রি (Green Chemistry) নীতির মাধ্যমে বিষাক্ত দ্রব্যের ব্যবহার কমিয়ে নির্ভরযোগ্য ও পরিবেশবান্ধব রাসায়নিক প্রক্রিয়া তৈরি হচ্ছে। এছাড়া ন্যানোকেমিস্ট্রির মাধ্যমে অতি ক্ষুদ্র মাত্রায় নতুন বৈশিষ্ট্যের পদার্থ তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে, যা চিকিৎসা, ইলেকট্রনিক্স ও শক্তি সংরক্ষণে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনছে।
রসায়নের এই দীর্ঘ ও চমকপ্রদ যাত্রা প্রমাণ করে যে মানুষ কৌতূহল, পর্যবেক্ষণ এবং নিরবিচ্ছিন্ন চেস্টার মাধ্যমে প্রাকৃতিক নিয়ম আবিষ্কার করে প্রযুক্তি ও সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। রসায়ন আমাদের শেখায় যে ছোট কণার বিশ্লেষণ থেকেই সম্ভব বড় সমস্যার সমাধান—আর সেখানেই লুকিয়ে আছে বিজ্ঞানের সৌন্দর্য।
আমি তানবীন শুভ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 2 সপ্তাহ 6 দিন যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 15 টি টিউন ও 0 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।