মসলা নাকি বিষ : কি খাচ্ছি আমরা!

টিউন বিভাগ খবর
প্রকাশিত

আসসালামুআলাইকুম

বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বাজারজাত হওয়া বিভিন্ন গুড়া মসলায় গবেষকরা ক্ষতিকর মাত্রায় রাসায়নিক উপাদান সনাক্ত করেছেন।  তাদের দাবি, এসব মসলা মানবদেহের জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনছে। তারা বলেন, ‘মানবদেহে সাইপারমেথরিনের সহনীয় মাত্রা ০.০১ পিপিএম হলেও বাংলাদেশের মসলায় পাওয়া গেছে গড়ে ০.৭৩ পিপিএম।  এছাড়া ডায়াজিননের সহনীয় মাত্রা ০.০১ পিপিএম হলেও পাওয়া গেছে ০.১৯ পিপিএম; যা মানুষের শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।’

কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। ‘গুড়া মসলায় রাসায়নিকের ব্যবহার ও মানবেদেহের ক্ষতি’শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে বাজারজাত হওয়া বিভিন্ন গুঁড়া মসলায় (মরিচ, হলুদ ও মিক্সড মসলা) মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের দ্রবণ পাওয়া গেছে।  প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো পরিকল্পিতভাবে গুঁড়া মসলায় নিম্নমানের কাঁচামালের সঙ্গে ইট, কাঠ, ভুট্টা ও চালের গুঁড়া মেশাচ্ছে।  এছাড়া মানবদেহের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকারক রাসায়নিক ক্রোমাটেড, মেটানিল ইয়োলো, টেক্সটাইল ডাই পিউরি, পেপরিকা, ফিটকিরিসহ বিভিন্ন কেমিক্যাল মিশ্রণ করছে।

প্রতিবেদনে মসলা গবেষক ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, মসলায় মেশানো রাসায়নিক দ্রব্যের জীবাণু গ্রহণ করে মানুষ জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। শুধু মসলায় মেশানো নিম্নমানের কাঁচামাল ও রাসায়নিক শরীরে ক্যান্সার, কিডনি, লিভার আক্রান্তসহ অন্তত ৫০ ধরনের মারাত্মক রোগ ছড়াচ্ছে। যার ভয়াবহতায় অকালে ঝরছে অসংখ্য প্রাণ।

মসলা ব্যবসায়ীরা কি বলছে?

এদিকে মসলা ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশে বছরে প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকার গুঁড়া মসলার চাহিদা আছে। মোটা অংকের এই টাকা হাতাতে উৎপাদন ও বাজারজাতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে খ্যাত-অখ্যাত অর্ধশতাধিক কোম্পানি। অর্থলিপ্সু এসব কোম্পানি অতি মুনাফা লাভের আশায় মানবখাদ্যের অতি প্রয়োজনীয় উপাদান মসলায় ভেজাল দিচ্ছে। যেসব প্রতিষ্ঠানের তদারকি করার কথা তারা জেনেও রহস্যজনক কারণে নীরবতা পালন করছে। এছাড়া নেপথ্যে ‘উৎকোচ’থাকায় বিএসটিআইয়ের (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন) কর্মকর্তারা জনবল সংকটের অজুহাত দেখিয়ে অভিযান পরিচালনা থেকে বিরত থাকছেন।

যদিও বিএসটিআইয়ের মান নিশ্চিতকরণ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা অর্থ লেনদেনের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেছেন, ইচ্ছে থাকলেও জনবল সংকটের কারণে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা কিংবা বাজার থেকে নমুনা সংগ্রহ করে সব মসলা পরীক্ষা করা সম্ভব হয় না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন ও মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের গবেষকরা বলেন, মসলায় মেশানো ইট, কাঠ, ভুট্টা ও চালের গুঁড়া, ক্রোমাটেড, মেটানিল ইয়োলো, টেক্সটাইল ডাই পিউরি, পেপরিকা, ফিটকিরিসহ বিভিন্ন কীটনাশক দ্রব্য ফুটিয়ে রান্না করলেও এর বিষক্রিয়া নষ্ট হয় না। যা দীর্ঘ সময় গ্রহণে শরীরে মারাত্মক সব রোগ সৃষ্টি হয়। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে শূন্যের দিকে নামতে থাকে। যার ভয়াবহতায় গর্ভবতী নারীদের থেকে বিকলাঙ্গ শিশু জন্মের আশঙ্কা থাকে।

প্রতিবেদনে মসলা পরীক্ষার শুরুর প্রক্রিয়া অংশে বলা হয়, গবেষণার প্রয়োজনে গবেষক দল সম্প্রতি সাভার, গাজীপুর ও পুরান ঢাকায় অবস্থিত কয়েকটি মসলা কোম্পানির গোডাউন সরেজমিন দেখে এবং মালিকপক্ষের সঙ্গে কথা বলে। এসময় তারা মরিচ ও হলুদের সঙ্গে মেশানোর জন্য মরিচ ও হলুদের সাদা, কালো, পচা, বোঁটা ও বীজসহ খাবার অনুপযোগী নানা উপাদান মজুদের (সংরক্ষণ) চিত্র দেখতে পান; যা রাখা হয়েছে শুধু চটের বস্তায় ভেজা স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার গোডাউনে।

তারা দেখেন, এসবের অধিকাংশ বস্তা ইঁদুরে কেটেছে। এমনকি সেসব স্থানে ইঁদুর বাসা বেঁধে ইচ্ছেমতো আসা যাওয়াও করছে। ফলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ও দীর্ঘদিন খোলা থাকা বস্তার মরিচের গুণগত মানে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। অতিরিক্ত আর্দ্রতার প্রভাবে এসব কাঁচামালে অতিরিক্ত ময়েশ্চারসহ জন্ম নিচ্ছে মানব শরীরে ক্যান্সার সৃষ্টির উপাদন আফলাটক্সিন। অথচ মজুদকৃত মরিচের মান রক্ষার প্রয়োজনে ডবল পলিথিন বস্তায় মুড়িয়ে রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গুঁড়া মরিচের আদর্শমান ১০১৭ বিডিএস, হলুদের ৯৯১ বিডিএস এবং মিক্সড মসলায় ১২০৫ বিডিএস হলেও বাজারজাত হওয়া মসলার অধিকাংশেরই আদর্শমান অর্ধেকেরও কম। নিম্নমানের উপকরণ ও অতিরিক্ত রাসায়নিকের কারণে মসলায় আদর্শমান রক্ষা হয়নি।

মসলার নিম্নমান হওয়ার নেপথ্য কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে অর্ধশত কোম্পানি ১০০টিরও বেশি জাতের বিভিন্ন মসলা বাহারি নামে বাজারজাত করছে। তবে তাদের মধ্যে অধিকাংশই কাঁচামাল উৎপাদন করছেন না। তারা টেন্ডারের মাধ্যমে সর্বনিম্ন দরদাতার কাছ থেকে নিম্নমানের কাঁচামাল সংগ্রহ করছে। যেসব কাঁচামালে মাঠের ফসল মাড়ানো থেকে শুরু করে পরিষ্কার, শুকানো, মিশ্রণ, সংরক্ষণসহ কোনো প্রক্রিয়ায়ই স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে না। মরিচ ও হলুদ রাস্তার ধারে, টিনের চালে, গোলার অপরিষ্কার পরিবেশে শুকানো হচ্ছে।

পাশাপাশি ওজন ও পরিমাণ বাড়াতে গুঁড়া মরিচে সাদা, কালো, পচা মরিচসহ বীজ ও বোঁটা মেশানো হচ্ছে। এতে মরিচের লাল রঙ কমে যাচ্ছে। আর গুঁড়া মরিচের রঙ গাঢ় লাল করতে উৎপাদক কোম্পানিগুলো উজ্জ্বল লাল বর্ণের স্বাদ ও গন্ধহীন রাসায়নিক পেপরিকা মেশাচ্ছে। ক্ষেত থেকে হলুদ উঠানোর পর সঠিক নিয়মে ঘাম ঝরানো, সিদ্ধ ও শুকানো হচ্ছে না। ফলে রঙ হারাচ্ছে হলুদ। কিন্তু রঙ ফেরাতে ও ওজন বাড়াতে সিদ্ধ করার সময় ক্ষতিকর রাসায়নিক ক্রোমাটেড মেশানো হচ্ছে এতে। এছাড়া শুকানোর পর মিশ্রণ করা হচ্ছে মেটালিল ইয়োলো, ফিটকিরি, টেক্সটাইল ডাই পিউরিসহ বিভিন্ন রাসায়নিক।

আবার মিক্সড মসলায় ব্যবহার হচ্ছে খুবই নিম্নমানের উপকরণ। এমনকি মূল্যবান দারুচিনির পরিবর্তে নিম্নমানের ক্যাসিয়াসহ বিভিন্ন উপকরণ মেশানোর প্রমাণ মিলেছে। এছাড়া ক্ষতিকারক অন্যান্য রাসায়নিক মেশানো হচ্ছে মিক্সড মসলা প্রক্রিয়াজাতকরণে।

বিশেষজ্ঞরা কি বলছেন?

এদিকে মসলা গবেষক ও কৃষি বিশেষজ্ঞরা জানান, বাংলাদেশে বছরে মরিচের চাহিদা প্রায় দুই লাখ টন। উৎপাদন এক লাখ ৪২ হাজার টন। আমদানি ও চোরাপথে আসে ২০ থেকে ৩০ হাজার টন। দেশে উজ্জ্বল, লাল বর্ণ ও ঝাঁঝযুক্ত শুকনো মরিচের চাহিদা বেশি। মরিচের বীজ ও বোঁটা খাবার অনুপযোগী হলেও ক্যাপসাইসিল খ্যাত এসব বীজ-বোঁটা মিশ্রণ করে গুঁড়া মরিচে মেশানো হচ্ছে, যা কখনোই পানিতে ও শরীরে মেশে না। এছাড়া সঠিক পদ্ধতিতে মরিচ ধোয়া ও না শুকানোর কারণে গাছে ব্যবহার করা অত্যধিক রিংডেন, ইউনালফস, এসিফেড, টায়োফজ, সাইপারমেথরিন, ডাইকোফল, ডায়াজিনন, স্যামকোজলসহ বিভিন্ন কীটনাশক শুকনো মরিচে থেকে যাচ্ছে।

গবেষকরা বলেন, এসব কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব রান্নার পরও থেকে যায়। হলুদের চাহিদা বছরে প্রায় দুই লাখ টন হলেও দেশের প্রায় এক হাজার হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয় প্রায় ৮৭ হাজার টন। অবশিষ্ট প্রায় সোয়া এক লাখ টন আমদানি হয়। রঙ ও ওজন বাড়াতে প্রায় একই ধরনের উপাদান মিশিয়ে প্রস্তুত করা হচ্ছে হলুদ ও মিক্সড মসলা।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ পলিসি ডিপার্টমেন্ট বিভাগ সূত্র জানায়, গত বছর প্রায় সাড়ে ৭০০ কোটি টাকার মসলা আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে মসলা উৎপাদনকারী কয়েকটি কোম্পানি প্রায় ১৭৫ কোটি টাকার ‘পেপরিকা’ও ‘মেটালিন ইয়োলো’ আমদানি করেছে।

ইনস্টিটিউট অব ফুড সাইন্স টেকনোলজি, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই), কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিটের একাধিক গবেষক সূত্রের দাবি, এর আগেও বিভিন্ন গুঁড়া মসলা পরীক্ষায় অখাদ্য জাতীয় নানা দ্রব্য মেশানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে। আর খোলা মসলায় এসবের পরিমাণ সনাক্ত হয়েছে আরো বেশি।

বিশিষ্ট শিশু কিডনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, ভেজাল খাদ্যসামগ্রী মানুষকে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিচ্ছে। ভেজাল ও কীটনাশক মিশ্রিত খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করায় সব বয়সের মানুষ মারাত্মক সব রোগে আক্রান্ত হচ্ছে; যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। তিনি জানান, ১০ বছর আগেও এ দেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা ছিল ৮০ লাখ। গত বছর তা দুই কোটি ছাড়িয়েছে। এছাড়া দেশে বছরে প্রায় ৯০ হাজার মানুষ নতুনভাবে ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে।

পূর্বে এখানে প্রকাশিত ➡ 

Level 0

আমি তৌহিদ সোহান। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 8 বছর 10 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 3 টি টিউন ও 37 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 1 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 1 টিউনারকে ফলো করি।

নিস্কলুষ মন, সাধারণ জীবনযাপন।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস

লেখাটি ব্যাপক প্রচার হলে দেশের মানুষের উপকার হত।

    সত্যিই এটা সবার জানা খুবই জরুরী।
    প্রথম টিউমেন্টের জন্য ধন্যবাদ #হারিস রহমান