ইউরোপে বেকারত্ব বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক মন্দা এবং বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত

টিউন বিভাগ খবর
প্রকাশিত

ইউরোপে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। একক মুদ্রা হিসেবে ইউরো চালুর সময়ের পর থেকে এ অঞ্চলের দেশগুলোতে বেকারত্বের হার বর্তমানে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে চাকরিহীনতার এ খবরে নড়েচড়ে বসেছে ইউরোপের নেতারা। বেকারত্বের এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করতে প্রতিজ্ঞা করেছেন তারা। ইউরোপের নেতারা বলছেন, হোঁচট খাওয়া ইউরোপের অর্থনীতিকে পুনর্জাগরণ করতে ১০ লাখ নতুন চাকরির পদ সৃষ্টি করতে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।ইউরোপীয় পরিসংখ্যান বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বরে ইউরো অঞ্চলের ১৭টি দেশে মৌসুমি বেকার মিলে মোট বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৪ শতাংশ। বেকারত্বের এই হার ১৯৯৮-৯৯ সালে ইউরো মুদ্রা প্রচলন হওয়ার পর সর্বোচ্চ।

গবেষণা সংস্থা আইএনজির অর্থনীতিবিদ মার্টিন ভেন ব্লায়েন্ট বলেন, সামনের দিনগুলোতে বেকারত্ব কী রকম বাড়বে সেদিকে আমরা নজর রাখছি। বর্তমানে গ্রিসে ২০ ও স্পেনে ৩০ শতাংশ বেকার রয়েছে। এসব দেশে বেকারত্বের হার বেড়ে যাওয়ায় দেশগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। মঙ্গলবার প্রকাশিত অপর এক প্রতিবেদনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ঋণগ্রস্ত ইতালিতেও বেকারের সংখ্যা আট দশমিক নয় শতাংশ হয়েছে। ২০০৪ সালের পর এ হার সর্বোচ্চ। দুই বছরের গভীর অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে ইউরোপে কর্মসংস্থানে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বৃহত্ কোম্পানিগুলো ব্যয় হ্রাসে কর্মী ছাঁটাই করছে। সর্বশেষ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইল সরঞ্জাম নির্মাতা নকিয়া সিমেন্স নেটওয়ার্ক জার্মানিতে চলতি বছরের শেষ নাগাদ ২ হাজার ৯০০ কর্মী ছাঁটাই করবে; ওই দেশে মোট কর্মী সংখ্যা কমাবে ৯ হাজার ১০০ এবং বিশ্ব জুড়ে ১৭ হাজার। এর মাধ্যমে এক বিলিয়ন ইউরো সাশ্রয় করার উদ্যোগ নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

আইএমএফ, স্ট্যান্ডার্ড এন্ড পুওর’স এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো সংকটাপন্ন দেশগুলোকে আগে থেকেই সাবধান করে দিচ্ছে। সংশোধনের পরামর্শ দিচ্ছে। কেউ পরামর্শ শুনছে, কেউ শুনছে না। ফল কিন্তু একই। অর্থনীতি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। এর প্রভাব পড়ছে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বে। অর্থনীতির স্থিতিস্থাপকতা কম বিধায় অনেক দেশেই অস্থিরতা দেখা দিয়েছে

বিশ্ব অর্থনীতি আরেকটি পতনের দ্বারপ্রান্তে। ইউরোজোনের সার্বভৌম ঋণ সঙ্কট বিশ্ব অর্থনীতিকে আরো নাজুক করে তুলেছে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, বিশ্ব অর্থনীতি অনিশ্চয়তা ও সঙ্কটের নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। ‘বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও সম্ভাবনা ২০১২’ শীর্ষক এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১২ সালে বিশ্ব আগের বছরের তুলনায় ২.৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে। ছয় মাস আগেও ৩.৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ২০১১ সালের মাঝামাঝি থেকেই প্রবৃদ্ধি কমতে শুরু করেছে। যা এখনো অব্যাহত আছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির সূচকগুলো জেগে উঠার ইঙ্গিত দিচ্ছে। গত আগস্টের পর একটানা পঞ্চম মাসের মতো বেকারত্ব হ্রাসের ধারা অব্যাহত রয়েছে। গত আগস্টে বেকারত্বের হার ছিল ৯.১ শতাংশ। ২০০৯ সালে তা ১০ শতাংশে উঠে গিয়েছিল। বেকারত্ব বর্তমানে ৮.৩ শতাংশে নেমে এসেছে। গত কোয়ার্টারে ২.৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। শেয়ার মার্কেটও বেশ চাঙ্গা। শিল্প উত্পাদন ও রফতানি বাড়ছে। ভোক্তা চাহিদা বাড়ছে। তারপরও ইউরো জোনসহ ইউরোপের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের আভাসের ওপর আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদরা আস্থা রাখতে পারছেন না। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও জোর দিয়ে বলতে পারছে না যে, তাদের অর্থনীতি মন্দা থেকে বেরিয়ে এসেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, এ অর্থনৈতিক মন্থরতা ২০১৩ সাল পর্যন্ত চলবে। জাতিসংঘ বলেছে, বিশ্ব জিডিপি ২০১২ সালে সর্বনিম্ন ২.৬ শতাংশ এবং ২০১৩ সালে ৩.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে। যা ২০০৮ সালের পূর্বের প্রবৃদ্ধির গতির চেয়ে কম। রিপোর্টে উন্নয়নশীল বিশ্বের প্রবৃদ্ধি ৬.২ শতাংশ থেকে ৫.৪ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। কারণ, চীন, ভারত, ব্রাজিল, দক্ষিণ কোরিয়া, রাশিয়া, তুরস্ক প্রভৃতি উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর প্রবৃদ্ধির গতিতে মন্থরতা দেখা দিয়েছে। উন্নত বিশ্বে প্রবৃদ্ধি হবে ১.৪ শতাংশ। পূর্বের পূর্বাভাস ছিল ২.৭ শতাংশ। ১৭টি দেশের ইউরো জোনে প্রবৃদ্ধি পূর্বাভাস ১.৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ০.৩ শতাংশ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, ইউরো জোন মন্দার মধ্যে আছে। কারণ, তাদের ঋণ সংকট আরো ঘনীভূত হয়েছে। যদিও সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের বার্ষিক সভায় জার্মানীর চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মার্কেল বলেছেন, সবার সহযোগিতা পেলে ইউরো জোন শীঘ্রই আর্থিক সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সমর্থ হবে। বাস্তবতা হচ্ছে, জার্মানী ছাড়া ইউরো জোনের অপর ১৬টি দেশের অর্থনীতিই আর্থিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। স্ট্যান্ডার্ড এন্ড পুওর’স সমপ্রতি ফ্রান্সের ঋণমান এক ধাপ নামিয়ে দিয়েছে। সার্বভৌম ঋণ পরিশোধে দেশটির সামর্থ্য হ্রাস পেয়েছে। যদিও সমপ্রতি মিডিয়ায় প্রকাশিত প্রেসিডেন্ট সারকোজির ভোগ-বিলাসের চিত্রের সাথে এটি সামঞ্জস্যহীন। জার্মানী এককভাবে ইউরো জোনকে ঋণমুক্ত করতে পারবে না। ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আইএমএফ এগিয়ে আসলেও সংকট মোকাবেলার জন্য যে বড় ফান্ড দরকার তার প্রতিশ্রুতি কেউ দিচ্ছে না। ফলে সমস্যা আরো ঘনীভূত হবে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, বিশ্ব ২০০৮/০৯-এর চেয়েও খারাপ অবস্থায় পড়তে যাচ্ছে। তখনকার আর্থিক সংকট উন্নত বিশ্বের প্রবৃদ্ধি অর্জনেই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। উদীয়মান অর্থনীতিগুলোসহ অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশই প্রবৃদ্ধির চাকা সচল রাখতে পেরেছিল। তাই প্রাকৃতিক কারণে সৃষ্ট বিশ্ব খাদ্য ঘাটতি পরিস্থিতিও দ্রুত সামাল দেয়া সম্ভব হয়েছিল। এবার উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতিও তেমন ভাল অবস্থানে নেই। ইউরোপের প্রায় শূন্য প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য হতাশাব্যঞ্জক। এ সব দেশের পণ্য ও সেবা রফতানির একটা বড় অংশেরই গন্তব্য ইউরোপ। তৃতীয় বৃহত্ অর্থনীতি জাপানও বিগত ৫ বছর ধরে বাজেট ঘাটতি সামলাতে ব্যস্ত আছে। উপর্যুপরি প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেশটিকে আরো নাজুক অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় বিরাজমান রাজনৈতিক উত্তেজনা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম প্রধান উপকরণ জ্বালানি সরবরাহকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ইউরোপের দুরবস্থ, বেকারত্ব মোকাবেলায় উন্নত বিশ্বের নীতি-নির্ধারকদের ব্যর্থতা, সার্বভৌম ঋণ সঙ্কট ও আর্থিক খাতগুলোর ভঙ্গুরতা বিশ্ব অর্থনীতির ভবিষ্যত্ অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তুলেছে।

পশ্চিমা বিশ্ব ও ইরানের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে। গত ডিসেম্বরে জাতিসংঘের পরমাণু বিষয়ক সংস্থা আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি কমিশন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, ইরান সামপ্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি পরীক্ষা চালিয়েছে যা পারমাণবিক বিস্ফোরক সামগ্রী উত্পাদনের জন্য যথেষ্ট। তারপরই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ নতুন করে মাঠে নেমেছে। ইসরাইলও এতে যোগ দিয়েছে। তারা পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করার লক্ষ্যে ইরানের ওপর চাপ বাড়িয়েছে। ইরানের বিরুদ্ধে নতুন অবরোধ আরোপ করেছে। আর্থিক খাতে অবরোধ আরোপের ফলে গত তিন মাসে কার্ব মার্কেটে ডলারের বিপরীতে ইরানের রিয়ালের দাম প্রায় ৫০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। সমপ্রতি তেল কেনা-বেচার ওপরও অবরোধ আরোপ করা হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আরোপিত এ অবরোধে ইরান থেকে তেল আমদানি, ক্রয় এবং ইরানের তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্য পরিবহন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

তেল বাণিজ্যের সাথে যুক্ত আর্থিক ও বীমা কার্যক্রমও অবরোধের আওতায় আনা হয়েছে। তেল বিক্রির বর্তমান চুক্তিগুলো ১ জুলাই’র মধ্যে গুটিয়ে ফেলতে বলা হয়েছে। ইরান অবশ্য ইউরোপকে বেকায়দায় ফেলার জন্য ছয় মাস পর নয় আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই তেল রফতানি বন্ধ করে দেয়ার চিন্তা-ভাবনা করছে। এদিকে হরমুজ প্রণালী দিয়ে তেল পরিবহনে ইরানের বাধা দেয়ার ঘোষণার বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র্র, ইউরোপ সহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশ ভারত মহাসাগরের সংযোগ হিসেবে হরমুজ প্রণালী দিয়ে নির্ঝঞ্ঝাটভাবে তেল সরবরাহ করার লক্ষ্যে সেখানে সামরিক ক্ষমতা জোরদার করেছে। বিশ্বের মোট তেল বাণিজ্যের প্রায় এক-চতুর্থাংশ এ প্রণালী দিয়ে যাতায়াত করে। সরবরাহ ব্যবস্থা অটুট রাখতে যুক্তরাষ্ট্র শক্তি প্রয়োগ করতেও দ্বিধা বোধ করবে না বলে জানিয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজারে। তেলের দাম আবার বাড়তে শুরু করেছে। ইরান বিশ্ব তেল উত্পাদনের ৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। যদিও সৌদি আরব, ইরাকসহ বেশ কয়েকটি দেশ তেল উত্তোলন ও রফতানি বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে।

প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে না পারায় ইউরোপে বেকারত্ব, ছাঁটাই, নতুন কর্মসংস্থানের ঘাটতি চরম আকার ধারণ করেছে। অপরদিকে ওয়াল স্ট্রীটসহ আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজারগুলোতে শেয়ারের দাম বাড়ছে। এই বিপরীত চিত্র সাধারণ জনগণকে হতাশ ও ক্ষুব্ধ করেছে। ফলে ‘ওয়াল স্ট্রীট দখল করো’র মতো আন্দোলন বিশ্বব্যাপী সাধারণ মানুষের সমর্থন আদায় করতে সমর্থ হয়েছে। অর্থনীতিতে কোনো দৃষ্টিগ্রাহ্য উন্নতি করতে না পারার কারণে অধিকাংশ দেশেই ক্ষমতাসীন সরকারগুলো নির্বাচনে পরাজিত হচ্ছে। বেশ কয়েকটি দেশে জনরোষের কারণে সরকার বদল হয়েছে। কোথাও কোথাও সরকারি দলের মধ্যেই অসন্তোষ মোকাবেলায় সরকার প্রধানের পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে না। গ্রীস, ইতালী, তুরস্কসহ আন্দোলন করে সরকার পরিবর্তন করা জনগণ এখন ভাবছে যে, তাদের ষোল আনাই মিছে। ফলে আন্দোলন করে সরকার বদল করে ভাগ্য পরিবর্তনের প্রবণতা এখন কমে গেছে। কিন্তু অর্থনীতিগুলো গতি ফিরে পাচ্ছে না। এর কারণ নির্ণয় ও করণীয় নির্ধারণে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদ, দাতা সংস্থা, গবেষণা প্রতিষ্ঠান সবাই কাজ করছে। আইএমএফ, স্ট্যান্ডার্ড এন্ড পুওর’স এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো সংকটাপন্ন দেশগুলোকে আগে থেকেই সাবধান করে দিচ্ছে। সংশোধনের পরামর্শ দিচ্ছে। কেউ পরামর্শ শুনছে, কেউ শুনছে না। ফল কিন্তু একই। অর্থনীতি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। এর প্রভাব পড়ছে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বে। অর্থনীতির স্থিতিস্থাপকতা কম বিধায় অনেক দেশেই অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।

বিশ্বায়নের এ যুগে বাংলাদেশের অর্থনীতিও বিশ্ব পরিস্থিতির সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। গরীব দেশ হওয়ায় ছোট আঘাতেও অর্থনীতির সূচকগুলো নেতিবাচক ফল দিতে শুরু করে। সামষ্টিক অর্থনীতি চাপের মধ্যে আছে, সরকার অতিরিক্ত ঋণ নিচ্ছে, বৈদেশিক সহায়তা কমে গেছে, সরকারের ব্যয় বেড়ে গেছে ইত্যাদি সমালোচনা হচ্ছে। আয়-ব্যয় ভারসাম্যে ঘাটতি, বেকারত্ব না কমা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, ব্যাংকের উচ্চ সুদহার, বিনিয়োগের ওপর চাপ সৃষ্টি, মূল্যস্ফীতি ১১ শতাংশ -এগুলো অর্থনীতির জন্য ভাল লক্ষণ নয়। তারপরও আশার দিক হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার সন্তোষজনক। কয়েক বছর ধরেই গড়ে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বজায় রেখেছে। জনগণের আয় বেড়েছে। গরীব ও নিম্ন আয়ের মানুষগুলোর ওপর মূল্যস্ফীতির তেমন চাপ পড়ছে না। সরকার সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষগুলোকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের মানুষগুলোও বিদ্যুত্, গ্যাসসহ বিভিন্ন পণ্য ও সেবায় প্রণোদনা পাচ্ছে। প্রতি ইউনিট বিদ্যুত্ উত্পাদনে ১০-১৫ টাকা ব্যয় হচ্ছে। গ্রাহক পাচ্ছেন ৫-৬ টাকায়। গ্যাসও প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ দামে পাচ্ছেন। কৃষি উত্পাদনে ব্যাপক ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। এ সব আর্থিক সুবিধার সিংহভাগই যাচ্ছে সারাক্ষণ হা-হুতাশে মত্ত শহরের বিত্তবানদের ঘরে। যাদের এসব সুবিধার আওতার বাইরে থাকার কথা। এদিকে বিদেশি সাহায্য ও ঋণ সহায়তার প্রবাহ কমে গেছে। বৈদেশিক সহায়তার প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের ধীর গতির কারণেও বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ কমে গেছে। এটি এখনো বড় ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারছে না। কারণ, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রফতানিতে ১৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

২০১১ সালে রেমিটেন্স আয়ে প্রায় ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। জনশক্তি রফতানিতে ৪৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। গত জানুয়ারি মাসে রেমিটেন্স এসেছে সর্বোচ্চ ১২১.৫০ কোটি ডলার। হতে পারে, টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রবাসীরা বেশি অর্থ পাঠাচ্ছেন। যেভাবেই হোক দেশে বাড়তি বৈদেশিক মুদ্রা আসছে। এ অর্থের বেশিরভাগই যাচ্ছে গ্রামের নিম্নআয়ভোগী দরিদ্র পরিবারগুলোর কাছে। তাই মূল্যস্ফীতি তাদের গায়ে তেমন লাগছে না। বাংলাদেশের অর্থনীতির বিশেষত্ব এখানেই। সমস্যা বেশি শহুরে শ্রেণীর। তারা কোনো খোঁজ-খবর না নিয়েই শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে রাতারাতি বাড়-গাড়ীর মালিক হতে চান। সেরা পণ্য ও সেরাটা সস্তায় পেতে চান। বাড়ী বানানোর সময় রাস্তার জন্য একটু যায়গা ছাড়বেন না। অথচ রাস্তায় যানজট দেখে ইউরোপ-আমেরিকার উদাহরণ দেবেন। তেল, গ্যাস, বিদ্যুত্ ইত্যাদিতে আরো ভর্তুকি কেন দেয়া হয় না তা নিয়ে সারাক্ষণই মাতামাতি করেন। অসদুপায়ে অর্থ উপার্জন করেন। অথচ বছর শেষে আয়কর রিটার্ন জমা দেয়ার সময় দেখা যায় তাদের আয় গ্রামের কৃষকের আয়ের কাছাকাছি। ফলে দেশে অঘোষিত অর্থের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। এ সম্পদ দুর্নীতিকে চাঙ্গা রেখেছে। বিরাট সম্পদ বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির অসম বণ্টন নিশ্চিত করছে। ধনী-গরীব বৈষম্য বিপজ্জনকভাবে বাড়েছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে বাংলাদেশ যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে এ বৈষম্য ঘোচানোর মধ্য দিয়েই তা সফলভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশের মতো সীমিত সম্পদের দেশকে সীমাহীন প্রতিকূলতার মধ্যে উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌঁছানো একটি দূরূহ কাজ। অর্থনীতির তত্ত্বের নিরিখে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি ও প্রবৃদ্ধি মেলানো কঠিন। চলমান বিশ্বমন্দার বিরূপ প্রভাবে উন্নয়নশীল তো বটেই, ইউরোপের গ্রিস ও ইতালির মতো শক্তিশালী অর্থনীতিও মুখ থুবড়ে পড়েছে। সাধারণভাবে আমাদের অর্থনৈতিক অর্জন অনেক ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য হওয়ার পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় সূচকগুলো যথেষ্ট বেগবান ও বলিষ্ঠ। কৃষি, শিক্ষা, মা ও শিশুমৃত্যু, তথ্যপ্রযুক্তি ও বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিসহ বিভিন্ন খাতে যুগান্তকারী উন্নয়নের পাশাপাশি শিল্প ও কৃষিজ উৎপাদন, মাথাপিছু বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবহারের হার, শিক্ষার বিশেষত নারীশিক্ষার ব্যাপক প্রবৃদ্ধি ইত্যাদি সূচকে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪০তম বর্ষ উদযাপন উপলক্ষে নিউইয়র্কে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও জাতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে একটি উন্নয়নের মডেল হিসেবে উপস্থাপন করেছে।’
আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন নতুন গন্তব্যে পৌঁছেছে। গত তিন বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গড়ে ৬ শতাংশেরও অধিক হারে বেড়েছে এবং শত প্রতিকূলতার মধ্যেও উপর্যুপরি বাম্পার ফলনের কল্যাণে ২০১১-১২ সালে তা ৬.৭ শতাংশ অতিক্রম করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এ হার গড়ে ৩.২ শতাংশ এবং উল্লেখ্য যে ১৯৯০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত গড়ে ৪.৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। বাংলাদেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির হার পাকিস্তান, নেপালসহ এ অঞ্চলের অপরাপর দেশ থেকে ভালো অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় ২০০৬ সালের ৪৮৭ ডলার থেকে বেড়ে ২০১১ সালে ৮১৮ ডলারে পৌঁছেছে যা বাংলাদেশকে অতি সত্বর একটি মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার লক্ষ্যে একটি বড় অর্জন।
জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন সম্প্রতি বাংলাদেশের এ সাফল্যে অকপটে স্বীকার করেছেন। ২০১৫ সালের মধ্যে সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে যে ১৬টি দেশ সাফল্য দেখাতে পেরেছে তাদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচন, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা, নারী উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তি, শিক্ষা ও কৃষি উন্নয়ন বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করবে বলে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন তার সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরে এবং পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন বক্তৃতা বিবৃতিতে স্পষ্ট করেই বলেছেন। বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে উত্তরোত্তর সাফল্য অনেক উন্নয়ন বিশেষজ্ঞের কাছে আদর্শ হিসেবে কাজ করছে। জাতিসংঘের ৬৬টি শান্তি মিশনের মধ্যে ৪৫টি মিশনেই বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করেছে এবং দুটি মহিলা শান্তিরক্ষী দল পাঠাতে সক্ষম হয়। বিশ্বফোরামে বাংলাদেশের সাফল্যের মধ্যে ২০১০ সালের গউএ অধিৎফ-৪, ২০১১ সালে ঝড়ঁঃয ঝড়ঁঃয ঘবংি অধিৎফ এবং ২০১০ সালে বাংলাদেশের দুটি ঘএঙ কর্তৃক ঊহবৎমু ওহহড়াধঃরড়হ অধিৎফ লাভ করা অন্যতম। এছাড়াও বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন, জঙ্গিবাদ, সহিংসতাসহ সব আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।
২০০৭-০৯ সালব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা থেকে বিশ্ব অর্থনীতি প্রত্যাশার চেয়ে দ্রুত ঘুরে দাঁড়ালেও ২০১১ সালে আবারও একটি বড় ধাক্কা ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়া মহাদেশকে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়াকে বাঁধাগ্রস্ত করছে বলে মনে হচ্ছে। মন্দা থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে উন্নত ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলো বিপুল বাজেট ঘাটতি, উচ্চ সরকারি ঋণ (ঢ়ঁনষরপ ফবনঃ), মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্বের হার বৃদ্ধিসহ কয়েকটি দেশের সার্বভৌম ঋণ (ংড়াবৎবরমহ ফবনঃ) সমস্যা প্রবৃদ্ধির গতিকে ঝুঁকিপূর্ণ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি উন্নত দেশের চলতি হিসাবে বিশাল আকারের ঘাটতি এবং জ্বালানি তেল রফতানিকারক দেশ ও কয়েকটি বিকাশমান অর্থনীতির চলতি হিসাবে বিশাল আকারে উদ্বৃত্ত বিশ্ব অর্থনীতিকে ভারসাম্যহীন করে তুলেছে। এ ভারসাম্যহীনতা কমিয়ে আনার ব্যর্থতা বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে অনেকটা নাজুক করে তুলেছে। আন্তর্জাতিক পরিম লে নীতিনির্ধারণে সমন¦য়ের অভাবও বিশ্ব আর্থিক ব্যবস্থাপনার সংস্কার কার্যক্রমকে বিলম্বিত করছে।

বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির হার বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির বাজারে ঊর্ধ্বমুখী প্রভাব ফেলেছে। এ প্রসঙ্গে স্বীকার করতেই হয় যে, সরকারের বলিষ্ঠ মুদ্রানীতি পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে দেয়নি। তার সঙ্গে মার্কিন মুদ্রা ডলারের মূল্য বৃদ্ধি এ পরিস্থিতিকে অধিকতর নাজুক করে তুলেছে। এর কারণ হিসেবে ব্যাপকহারে বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাত্রাতিরিক্ত বিনিয়োগ এবং বিদেশি বিনিয়োগের অভাবকে দায়ী করেন। গত দুই অর্থবছরে মূলধনি বিনিয়োগের পরিমাণ আগের যে কোনো সময়ের ৫ বছরের বিনিয়োগের চেয়ে অধিক। বিদ্যুৎ ও জাহাজ নির্মাণখাতসহ নতুন খাতে বিনিয়োগের বিরাট দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আছে। যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। ব্যক্তিগতভাবে এ ধরনের স্বল্পমেয়াদি সমস্যাগুলো অর্থনীতির জন্য কোনো দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আছে বলে আমি মনে করি না। ঘাটতি অর্থায়ন (ফবভরপরঃ ভরধহহপরহম) এখনো বাজেটে উল্লিখিত অঙ্কের মধ্যেই রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপকভাবে বিনিয়োগে গেছে যেখানে ক্রেডিট ডিপোজিট রেট ৮২ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নিবিড় তত্ত্বাবধানের ফলেই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে।

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার শুরুতে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর এর বিরূপ প্রভাব না পড়লেও ২০০৮-০৯ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিক থেকে রফতানি ও আমদানি খাতে কিছুটা প্রভাব পড়ে যা ২০০৯-১০ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। মন্দা-পরবর্তী বিশ্ববাণিজ্যের গতি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশেরও বৈদেশিক বাণিজ্যে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয় এবং ২০১০-১১ অর্থবছরের রফতানি ও আমদানি প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ২৩ বিলিয়ন ও ৩২ বিলিয়ন ডলার (যা ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ছিল যথাক্রমে ১০.৫ বিলিয়ন ও ১৪.৭ বিলিয়ন ডলার)। ২০১১ সালের শেষ ছয় মাসে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় আবারও বাংলাদেশে চাপ অনুভূত হচ্ছে এবং এর ফলে মুদ্রাস্ফীতি ও সরকারি ঋণের বৃদ্ধি ঘটছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর বিশ্বমন্দার সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে যথাযথ আগাম ধারণা অর্জন এবং সে প্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক উদ্যোগ ও মুদ্রা ব্যবস্থাপনার নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের মতো নানাবিধ সহায়তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে মন্দার বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা করা সম্ভব হয়েছে। মন্দার প্রভাবে মধ্যপ্রাচ্যে আবাসন শিল্পে ধস নামা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং মালয়েশিয়াসহ কয়েকটি দেশে অভ্যন্তরীণ চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় বাংলাদেশ থেকে শ্রমশক্তি রফতানি বৃদ্ধির গতি কিছুটা হ্রাস পায়। তবে এ সময় রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক পর্যায়ে থাকে এবং ২০০৮-০৯ ও ২০০৯-১০ অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয় যথাক্রমে ২২.৪২ শতাংশ ও ১৩.৪০ শতাংশ। ২০১০-১১ অর্থবছরের প্রথমার্ধে জনশক্তি রফতানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেলেও জানুয়ারি, ২০১১ থেকে তা ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং তা ২০১০-১১ অর্থবছরে ১১.৬৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে (২০০৫-০৬ বছরে এর পরিমাণ ছিল ৪.৮৭ বিলিয়ন ডলার)। কর্মসংস্থান বাড়ানো ও বেকারত্ব কমাতে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ৪৬তম, যা তার পার্র্শ্ববর্তী দেশ ভারত (১১১তম), আফগানিস্তান (১৮০তম), পাকিস্তান (১৫২তম) এবং নেপাল (১৯০তম) থেকে অনেক এগিয়ে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের পঞ্চম জনশক্তি রফতানিকারক দেশ।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনিক ও রাজস্ব খাতে গৃহীত ব্যবস্থার পাশাপাশি মুদ্রা খাতেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। চলতি মৌসুমে ধানের ভালো উৎপাদন এবং আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল থাকায় আগামী মাসগুলোতে বাজার নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে আশা করা যায়। রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধির গতি হ্রাস ও বিদ্যুৎসহ অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির কারণে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০১০-১১ অর্থবছরে চলতি হিসাবের ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত হ্রাস পেয়েছে। এ সময়ে বিনিময় হারের অবচিতি ঘটেছে। তা সত্ত্বেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সহনশীল পর্যায়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। ২০০৬ সালে বৈদেকি মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৫ বিলিয়ন ডলার এবং ২০১১ সালের ডিসেম্বরে এর পরিমাণ ৯.৫ বিলিয়ন ডলার। জানুয়ারি ২০১১ থেকে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক ধারায় ফিরে এসেছে। এছাড়া বিদ্যুৎ ও জ্বালানি এবং অবকাঠামো খাতে সরকার যে ব্যাপক কার্যক্রম শুরু করেছে তার সফল বাস্তবায়ন অর্থনীতিতে অনুকূল বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টি করবে যা দেশকে কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধির পথে নিয়ে যাবে বলে আশা করা যায়।
এ কথা বলা যায়, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। কখনও ঋণাতœক প্রবৃদ্ধি এ দেশে দেখা যায়নি। স্বাধীনতার আগে ও পরে এ দেশে মাত্র কয়েক বছর অর্থনীতির অবস্থা খারাপ ছিল এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের অর্থনীতি নাজুক থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। স্বাধীনতার পর পর এদেশে মাত্র কয়েক’শ কোটি টাকার বাজেট ছিল। এখন তা লক্ষ কোটি অতিক্রম করেছে। এটা যে কোনো মাপকাঠিতে খুব বড় একটি অর্জন এবং এটা নিয়ে বিজয়ের ৪০ বছর পূর্তিতে আমরা গর্ব করতে পারি।
বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বিশ্বের যে কোনো উন্নয়নশীল দেশের জন্য ঈর্ষার বিষয়। মোট জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ২০১১ সালে বাংলাদেশের অবস্থান উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে ২৪তম ছিল (২০১০ সালে বাংলাদেশের এ অবস্থান ছিল ৫৫তম)। এর অর্থ হলো বিশ্বে এখন ১৯১টি স্বাধীন দেশ রয়েছে, যাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হারের চেয়ে কম। তারপরও কি আমরা বলব বাংলাদেশ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র?
আমদানি ও রফতানি খাতে ২০১০-১১ অর্থবছরে ব্যাপক প্রবৃদ্ধি অনেক বিশ্লেষককে আশ্চর্যানি¦ত করেছে। এ দুই ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান এশিয়ার শীর্ষ তিনের মধ্যে। পরিসংখ্যান দেখলে তা সহজেই বোঝা যায়। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা প্রথম। রফতানির ক্ষেত্রে আমরা নতুন বাজারে প্রবেশ করছি। আমি মনে করি, রফতানিতে খুব তাড়াতাড়ি আমাদের গার্মেন্টস খাতের সঙ্গে রেমিট্যান্স খাত ও ওষুধ খাত প্রতিযোগিতা করবে। এ ছাড়া মানবসম্পদের উন্নয়ন করতে পারলে সে খাতটিরও ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়াতে দক্ষ মানবসম্পদ রফতানির বড় সুযোগ রয়েছে। মানবসম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে বাজার ধরতে পারলে রেমিট্যান্স কয়েক গুণ বাড়ানো সম্ভব।
খাদ্যদ্রব্য ও জ্বালানি মূল্য বিশ্বের সর্বত্রই বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অদূর ভবিষ্যতে এটি হ্রাস পাবে এমন সম্ভাবনা কম। সম্মানিত বুদ্ধিজীবীদের আলোচনা শুনলে মনে হয় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যর্থতার জন্যই দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের অবগতির জন্য বলছি যে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান প্রায় একই রকম। স্বাধীনতার পর থেকে ধীরে ধীরে দারিদ্র্যের হার কমছে এবং এ বছর তা ৩১ শতাংশ দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ৩১ শতাংশ এখন দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করছে।

বাংলাদেশের পুঁজিবাজার নিয়ে বাজার বিশ্লেষক ও রাজনীতিকরা তাদের নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী পুঁজিবাজারের ২০১১ সালের নিম্নমুখী প্রবণতা বিশ্লেষণ করলেও বর্তমানে সঠিক অবস্থা অনেকটা পরিষ্কার। আমি মনে করি পুঁজিবাজারে উত্থান ও পতন একটি স্বাভাবিক ব্যাপার এবং বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের সার্বিক সরবরাহ বিবেচনায় নিয়ে ২০১০ সালে শেষের দিকে সূচকে ব্যাপক উত্থান ছিল অস্বাভাবিক। এ সময়ে এক শ্রেণীর সুবিধাবাদি ব্যবসায়ী তাদের ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থে বাজার থেকে অনেক টাকা হাতিয়ে নেয়। সম্প্রতি প্রকাশিত পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০০টি তালিকাভুক্ত কোম্পানির ১৪৯১ জন পরিচালকের শতকরা দুই ভাগের কম শেয়ার তাদের নিজ কোম্পানিতে আছে। এ ছাড়াও ৩৮টি কোম্পানির স্পনসর ও পরিচালকদের শতকরা ৩০ ভাগের কম শেয়ার তাদের মালিকানায় আছে। এসব কোম্পানি ও পরিচালকরাই তাদের শেয়ার ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করেছিলেন এবং তারা (ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী) তাদের মূলধন হারিয়েছেন। সরকার এ ধরনের অব্যবস্থা রোধে ডিমিউঁচুয়েলাইজেশন করার উদ্যোগসহ তদন্ত কমিটির রিপোর্ট গ্রহণ করে এসইসিকে পুনর্গঠনসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছেন। এসব ব্যবস্থার বাস্তবায়নকে সবাই নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। পুঁজিবাজারকে তার নিজস্ব গতিতে স্বাধীনভাবে চলতে দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে তাদের নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছ ও দীর্ঘমেয়াদি নির্দেশনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে।

স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে কিছু প্রতিবন্ধকতার জন্য আমাদের অর্থনীতি পূর্ণমাত্রায় গতিশীল হতে পারছে না। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল অবকাঠামোগত উন্নয়ন। পর্যাপ্ত গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন অপরিহার্য। উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলাও জরুরি। আমাদের অর্থনীতির গতিশীলতার আরেকটি প্রতিবন্ধকতা হলো আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। আমলাতন্ত্রের দক্ষতার অভাবে প্রচুর অর্থব্যয় সত্ত্বেও দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ আশানুরূপভাবে আকৃষ্ট হচ্ছে না। এমনকি বৈদেশিক সহায়তা যথাযথ ব্যবহারের অপারগতায় বিভিন্ন প্রকল্পের অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি ও বহু অর্থ অব্যবহৃত থেকে ফেরত যাচ্ছে। এসব প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবন্ধকতা ছাড়াও সব সময় আমাদের অর্থনীতিকে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়, যেমন জলবায়ু পরিবর্তনের খামখেয়ালিপনা, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা ও অস্থিরতা, বিশ্ববাজারে তেল ও খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি আমাদের অর্থনীতির ভিত নাড়িয়ে দেয়।

‘দেশের মানুষ বাড়ছে কিন' জমি বাড়ছে না’- এ প্রচারণা দীর্ঘদিনের। এবং অদূর ভবিষ্যতে ভয়ঙ্কর পরিণতির পরিণাম ব্যক্ত করে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জনসংখ্যা সঙ্কোচন নীতি প্রণয়ন করেন। ‘ছেলে হোক মেয়ে হোক দু’টি সন্তানই যথেষ্ট’- এই তত্ত্ব প্রচার করেন। পরবর্তী সরকারগুলো সে ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন। এমনকি এরশাদ এ নীতিতে অগ্রগামী হওয়ায় জাতিসংঘ পুরস্কারও লাভ করেন। হালে এ প্রচারণার পালে আরো বাতাস লেগেছে। এখন ‘ছেলে হোক, মেয়ে হোক এক সন্তানই যথেষ্ট- এ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। এসব প্রপাগান্ডার একটাই ভিত্তি। ‘দেশের মানুষ বাড়ছে কিন' জমি বাড়ছে না এক ছটাকও।’
অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত, ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিক্ষাবিদ এমনকি সরকারের আমলা-মন্ত্রী সবাই উক্ত প্রচারণায় একযোগে বিশ্বাসী; বিপদ শুধু তাই নয়। বরং আত্মঘাতী ও ভয়ঙ্কর বিপদ এটা যে, সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখার পরও যে জমি বাড়তে পারে এ সত্য সাধারণভাবে কারো অনুভূতিতে, চিন্তায় বা মগজে আদৌ নেই। এ চিন্তা ও উপলব্ধিহীনতার কারণেই আমরা আজও আমাদের সীমান্তের হক্ব আদায়ের ব্যাপারে সচেতন ও সার্থক নই। অথচ সমপ্রতি বিভিন্ন স'ান থেকে প্রাপ্ত তথ্যে প্রমাণিত হচেছ, বাংলাদেশের ভুখণ্ড কমছে না, বরং বাড়ছে। এ শতাব্দীর শেষ নাগাদ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর বনভূমি অঞ্চল সাগরে তলিয়ে যাবে বলে যে আশঙ্কার কথা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জরিপে বলা হচ্ছে বাংলাদেশ তার বাইরে।
জানা গেছে, ক্রসবাঁধ পদ্ধতিতে বঙ্গোপসাগর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ১ লাখ হেক্টর জমি। আয়তন এক হাজার বর্গ কিলোমিটার। এই প্রক্রিয়ায় আগামী কয়েক বছরের মধ্যে নোয়াখালীর সঙ্গে যুক্ত হবে দেশের মূল ভুখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন সাগরকন্যা সন্দ্বীপ। এছাড়া সমুদ্র থেকে উদ্ধার হবে আরও নতুন ভুখণ্ড। সূত্র মতে, ১৯৬৫ সাল থেকে পদ্মা, মেঘনা ও বঙ্গোপসাগরের মোহনা থেকে এ জমি উদ্ধারের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ভূমিহীন ৯ লাখ মানুষকে পুনর্বাসন করা হয়েছে সাগর থেকে উদ্ধারকৃত এ জমিতে। এভাবে বছরে ২ হাজার হেক্টর নতুন ভূমি দেশের মূল ভুখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে।
তথ্য মতে, উজান থেকে আসা পলি সঞ্চিত হয়ে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার মোহনায় পড়ে উঠেছে এ ভূখণ্ড। নদীগুলো বছরে ২.৪ বিলিয়ন টন পলি নিয়ে আসে বঙ্গোপসাগরের মোহনায়। এছাড়া, দেশের ২৩০টি নদীর মিলিত ধারাও মিশেছে এ মোহনায়। এ ব্যাপারে চর ডেভেলপেমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট প্রজেক্ট সূত্র জানায়, ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে বাংলাদেশের এই কেন্দ্রীয় উপকূল অঞ্চলটি অত্যন্ত সক্রিয়। এ কারণে পদ্মা ও মেঘনার জলপ্রবাহ বহন করে নিয়ে আসে ব্যাপক পলি। এই পলি তটরেখা বরাবর ক্রমাগত সঞ্চিত হয়। এতে একদিকে নদী ভাঙ্গনের কারণে গৃহহীন হচ্ছে অন্যদিকে বাড়ছে দেশের ভূ-আয়তন। এই নতুন ভূমিতে প্রতিবছর পুনর্বাসিত হচ্ছে ১৫ হাজার ভূমিহীন মানুষ। এছাড়া, ভূমিহীন মানুষের খাস জমি বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছে ৩০ হাজার একর। বর্তমানে ভোলার দক্ষিণাঞ্চল, হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ, নোয়াখালীর দক্ষিণাঞ্চলে এভাবে ভূমি জেগে উঠার প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া খুবই সক্রিয় বলে সূত্র জানায়।
নেদারল্যান্ড সরকারের আর্থিক সহযোগিতায় এই ভূমি উদ্ধার প্রকল্পের কাজ চলছে। ১৯৭৭ সাল থেকে চর ও ভূমি পুনরুদ্ধার প্রকল্পের মাধ্যমে চলছে এই কর্মসূচি। নেদারল্যান্ড সরকারের ৮৭ শতাংশ অনুদান ও বাংলাদেশ সরকারের ১৩ শতাংশ আর্থিক সহযোগিতায় এ কাজ চলছে। ১৯৫৬ সালে প্রথম সমুদ্র থেকে ভূমি উদ্ধারের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এজন্য মেঘনার উপর একটি ক্রসবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিলো- যা হাতিয়ার সঙ্গে রামগতিকে সংযুক্ত করেছিলো। এই বাঁধের ফলে ২১ হাজার হেক্টর জমি জেগে উঠে। ১৯৬৫ সালে শুরু হয় এখানে মানুষের বসতি। এছাড়া ক্রসবাঁধ ২-এর মাধ্যমে নোয়াখালীর সোনাপুর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে ৬.৫ কিলোমিটারের একটি ক্রসবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিলো। এর ফলে সমুদ্র থেকে জেগে উঠে ৭৯ হাজার হেক্টর জমি। এভাবে নোয়াখালীর সঙ্গে চর জব্বারকে সংযুক্ত করা হয়।
সূত্র মতে, আরও ১৯টি ক্রসবাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এই ক্রসবাঁধের একটি সন্দ্বীপ, উড়কির চর ও নোয়াখালীকে যুক্ত করবে। এতেও ২২ হাজার হেক্টর জমি উদ্ধার হবে। সন্দ্বীপের সঙ্গে গড়ে উঠবে সড়ক যোগাযোগও। এ সংক্রান্ত প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই ও মডেল স্টাডি শেষ হয়েছে। মেঘনা মোহনা পর্যবেক্ষণ প্রকল্প (এমইএস) হাইড্রোলজি ও মর্ফলজি বিষয় পর্যবেক্ষণ করছে। অন্যদিকে ১৯টি ক্রসবাঁধের মাধ্যমে সমুদ্র থেকে আরও নতুন ভূখণ্ড উদ্ধার করা হবে।
উল্লেখ্য, নেদারল্যান্ডের এক চতুথাংশ ভূমি গঠন করা হয়েছে সমুদ্রে ক্রসবাঁধ দিয়েই। নেদারল্যান্ডের অভিজ্ঞতা ও আর্থিক সহায়তায় সরকার চর উন্নয়ন ও বসতি স'াপন প্রকল্পের কাজ চালিয়ে নিচ্ছে দীর্ঘদিন থেকে। এর মাধ্যমে চর মজিদ, চর ভাটিরটেক ও চর বাগ্গারদোনার উন্নয়ন কাজ চলছে। বাংলাদেশের নদী ভাঙ্গনের বাস'চ্যুত মানুষ ও ভূমিহীন মানুষের আবাসন সমস্যা সমাধানে এটা একটা বড় পদক্ষেপ। নদী ভাঙ্গন যত মানুষকে বাস্তচ্যুত করেছে তার চেয়ে বেশি জায়গা উদ্ধার হয়েছে সমুদ্র থেকে। নেদারল্যান্ডের মতো একই পদ্ধতিতে এখানেও ব্যাপক জায়গা উদ্ধার করা সম্ভব। জানা যায়, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাঁধ তৈরি করলে অদূর ভবিষ্যতে আমরা আরেকটি বাংলাদেশের চেয়েও বড় পুনর্গঠিত নতুন ভূমি পাব।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, ২০০১ সালে বাংলাদেশ সমুদ্র আইন বিষয়ক জাতিসংঘ কনভেনশনে স্বাক্ষর করলেও এ সংক্রান্ত কোন কার্যকর পদক্ষেপই গ্রহণ করতে পারেনি। নিজস্ব সমুদ্রসীমানা ও সমুদ্র অর্থনৈতিক অঞ্চলের মানচিত্রও প্রকাশ করতে পারেনি। অথচ ভারত ও মায়ানমার তা আগেই করে ফেলেছে। পাশাপাশি ভারতের ব্লক ম্যাপে বাংলাদেশের সুন্দরবন এলাকায় (প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার বর্গকিলোমিটার) তাদের সীমানা বলে দেখিয়েছে। ভারত ঐ এলাকায় গ্যাসের সন্ধানও পেয়েছে। অন্যদিকে মায়ানমারও গভীর সমুদ্রে বাংলাদেশের ১৭ হাজার বর্গকিলোমিটার জুড়ে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান করেছে এবং তা পেয়েছে।
কাজেই এ মুহূর্তেই সমুদ্র সীমা নির্ধারণ ও সামুদ্রিক সম্পদ আহরণ যে প্রকাশ জরুরী তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এদিকে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ২০১২ সালের মধ্যে তারা বাংলাদেশের সমুদ্র সীমা নির্ধারণ করবে। এখন বাংলাদেশ মাত্র ১৭ নটিক্যাল মাইল সমুদ্র সীমা ভোগ করছে। কিন' জাতিসংঘের সহায়তায় সঠিক সীমা নির্ধারণ হলে তা ৩০০ নটিক্যাল মাইলে পরিণত হবে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সমুদ্র সীমায় চিংড়ি, গ্যাস, তেলসহ আরো অনেক সম্পদ পাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। কার্যতঃ এক সমুদ্র সম্পদই যে গোটা বাংলাদেশবাসীর ভাগ্য ঘুরিয়ে দিতে পারে তাও সহজেই অনুমেয়। দেরিতে হলেও সরকার সমুদ্রের প্রতি নজর দিয়েছে। অতি সম্প্রতি ৪২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে কুতুবদিয়া বা সুবিধাজনক স'ানে গভীর সমুদ্র বন্দর স'াপনের উদ্যোগ নিয়েছে।

সূত্রঃ বিডি নিউজ ২৪ ডট কম, ঊইকিপিডিয়া, গুগোল

Level 0

আমি জর্জ অলড্রিন ঘোষ (তুষার)। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 12 বছর 1 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 25 টি টিউন ও 52 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস

এত বড় লেখা !

ভালই তো লিখেছেন………।দেখা যাক ……।

ভাই মাথা ঘুরতেসে এতও লেখা মেইন topic অল্প অল্প করে লিখলে পরতাম