সজনা (Moringa oleifera) একটি পুষ্টি সমৃ্দ্ধ জনপ্রিয় সবজি। এটি বছরব্যাপি অর্থাৎ ১২ মাসেই পাওয়া যায় তবে গ্রীষ্মকালে বেশী পাওয়া যায়। সজনা গাছের পাতা, শুঁটি, ফুল এমনকি মূল পর্যন্ত সব অংশেই ভেষজ ও পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান। এটি "মিরাকল ট্রি" বা "অলৌকিক গাছ" হিসাবেও পরিচিত। সজনায় এমন অনেক ভিটামিন, খনিজ ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে যা মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং বিভিন্ন রোগ থেকে সুরক্ষা প্রদান করে।

সজনার পুষ্টি উপাদান

সজনার বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন ধরনের পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান রয়েছেঃ

• ভিটামিনঃ ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ভিটামিন ই, ভিটামিন কে, এবং বি-কমপ্লেক্স গ্রুপ।
• খনিজঃ ক্যালসিয়াম, আয়রন, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, জিঙ্ক, কপার।
• প্রোটিনঃ পাতায় ২৫-৩০% পর্যন্ত প্রোটিন রয়েছে।
• অ্যান্টিঅক্সিডেন্টঃ ফ্ল্যাভোনয়েড, পলিফেনল, বিটাক্যারোটিন।
• অন্য উপাদানঃ ডায়েটারি ফাইবার, অপরিহার্য অ্যামিনো এসিড।
  সজনার পাতা শাক হিসেবে খেলে শরীরে প্রচুর পরিমাণে আয়রন ও ক্যালসিয়াম যোগায়। আবার শুঁটি ভিটামিন সি ও ফাইবারের অন্যতম উৎস।

সজনার স্বাস্থ্যগত উপকারিতা

১. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিঃ

সজনা পাতায় প্রচুর ভিটামিন সি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে। নিয়মিত সজনা খেলে সর্দি-কাশি ও ভাইরাসজনিত সংক্রমণের ঝুঁকি কমে যায়।

২. হাড় ও দাঁতের জন্য উপকারীঃ

সজনায় প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস আছে যা হাড় ও দাঁতকে মজবুত করে। বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও গর্ভবতী মায়েদের জন্য সজনা একটি আদর্শ খাবার।

৩. রক্তশূন্যতা দূর করেঃ

আয়রনের অভাবে শরীরে রক্তশূন্যতা বা অ্যানিমিয়া হয়। সজনা পাতায় রয়েছে প্রচুর আয়রন যা রক্তে হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সাহায্য করে। নিয়মিত সজনা খেলে রক্তশূন্যতা দূর হয় এবং শরীর উজ্জীবিত থাকে।

৪. হজমশক্তি বাড়ায়ঃ

সজনায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার। যা অন্ত্র পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে। এছাড়া এটি হজম প্রক্রিয়া সক্রিয় করে এবং গ্যাস্ট্রিক সমস্যা দূর করতে সহায়তা করে।

৫. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়কঃ

সজনার পাতা ও বীজ রক্তের Glucose লেভেল নিয়ন্ত্রণে রাখে। এটি ইনসুলিন নিঃসরণকে উদ্দীপিত করে এবং ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকার সাধন করে।

৬. হৃদপিণ্ডের স্বাস্থ্য রক্ষাঃ

সজনায় থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ফাইবার রক্তে কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে। এটি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে এবং হৃদরোগ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।

৭. চোখের দৃষ্টি উন্নত করেঃ

সজনায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ ও বিটা-ক্যারোটিন। যা চোখের দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে সাহায্য করে। রাতকানা রোগ প্রতিরোধে সজনা খুবই কার্যকর।

৮. ত্বক ও চুলের জন্য উপকারীঃ

সজনার পাতায় থাকা ভিটামিন সি ও ই ত্বককে উজ্জ্বল করে এবং বার্ধক্যের ছাপ দূর করে। পাশাপাশি সজনার তেল চুলকে মজবুত করে, খুশকি ও চুল পড়া কমাতে সাহায্য করে।

৯. ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়কঃ

সজনায় থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি রোধে সাহায্য করে। বিশেষ করে এতে থাকা ফ্ল্যাভোনয়েড ও পলিফেনল ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।

১০. গর্ভবতী ও স্তন্যদায়ী মায়েদের জন্য উপকারীঃ

গর্ভবতী মায়েদের জন্য সজনায় থাকা ক্যালসিয়াম, আয়রন ও ভিটামিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া স্তন্যদায়ী মায়েদের দুধ বৃদ্ধি করতেও সজনার পাতা উপকারী হিসেবে বিবেচিত হয়।

সজনার ব্যবহার

• শুঁটিঃ তরকারি, ঝোল বা ডাল রান্নায় ব্যবহার হয়।
• পাতাঃ শাক হিসেবে ভাজি বা স্যুপে খাওয়া যায়।
• ফুলঃ ভাজি বা ভর্তা হিসেবে খাওয়া যায়।
• বীজঃ তেল উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়।
• মূলঃ ভেষজ ওষুধ হিসেবে প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহার হয়ে আসছে।

ভেষজ গুণ

• সজনার মূল হজমের সমস্যা ও ব্যথা উপশমে ব্যবহৃত হয়।
• পাতা ও বীজের নির্যাস উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
• ফুলের রস জ্বর ও ঠান্ডা লাগার সময় উপকারী।

উপসংহার

সজনা প্রকৃতির এক অনন্য উপহার, যার প্রতিটি অংশেই পুষ্টি ও ভেষজ গুণ বিদ্যমান। এতে থাকা ভিটামিন, খনিজ, প্রোটিন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শুধু শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় না, বরং হাড়, দাঁত, রক্ত, চোখ, ত্বক, চুলসহ সার্বিক সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ক্যান্সার প্রতিরোধ থেকে শুরু করে গর্ভবতী ও স্তন্যদায়ী মায়েদের জন্যও এটি সমানভাবে উপকারী। সজনার বহুমুখী ব্যবহার এবং সহজলভ্যতা একে “অলৌকিক গাছ” হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। নিয়মিত খাদ্যতালিকায় সজনা অন্তর্ভুক্ত করলে এটি মানবদেহকে রোগমুক্ত, সবল ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করতে সহায়তা করে।