কেন এমন হয়? [পর্ব-০২] :: পৃথিবীর অভ্যান্তর ভাগ এখনও এতটা উত্তপ্ত কেন?

ফরাসি ঔপন্যাসিক জুল ভার্নের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিভিত্তিক উপন্যাস ‘অ্যা জার্নি টু দ্য সেন্টার অব আর্থ’ আমরা অনেকেই হয়ত পড়েছি। কিন্তু জুল ভার্নের ওই ভ্রমণকে অনুসরণ করে আদৌ কি পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে যাওয়া সম্ভব? পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরতম খনির কথাটিই ধরা যাক। দক্ষিণ আফ্রিকার জোহান্সবার্গে অবস্থিত কার্লেটনভিলের ত’ তোনা (Tau Tona) সোনার খনিটির গভিরতা ৩.৯ কি.মি. (২.৫ মাইল)। এই গভীরতায় খনির অভ্যান্তরের তাপমাত্রা ৬০° সে. (১৪০° ফা.)। পথ বেয়ে খনির নিচে নামতে থাকলে মনে হবে, এ যেন ধীরে ধীরে জ্বলন্ত কোনো অগ্নিকুন্ডের দিকে এগিয়ে চলা।

১৯৭০ সালের ২৪ মে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজ্ঞানীরা ভূগর্ভের প্রকৃতি জানতে একটি খনন প্রকল্প শুরু করেন। ফিনল্যান্ডের সীমান্তবর্তী রাশিয়ার পেচেংস্কি জেলার কোলা উপদ্বীপে ‘কোলা সুপারডিপ বোরহোল’ নামের এই খনন প্রকল্পটির উদ্দেশ্য ছিল কৃত্রিমভাবে গর্ত খুঁড়ে যতদূর সম্ভব পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে যাওয়া। খনন প্রকল্পটি ১৯৮৯ সালে ১২,২৬২ মিটার (৪০,২৩০ ফুট) গভীরতায় গিয়ে পৌঁছায়। দুই দশক ধরে গভীরতা এবং বোরের পরিমাপে এটিই ছিল মানুষের তৈরি সবচেয়ে গভীর কৃত্রিম গর্ত। পরবর্তীতে, ২০০৮ সালে কাতারের আল শাহীন তেল কূপের গভীরতা পরিমাপ করা হয় ১২,২৮৯ মিটার (৪০,৩১৮ ফুট) এবং ২০১১ সালে রাশিয়ার শাখালিন দ্বীপের উপকূলবর্তী শাখালিন-আই ওডোপ্টু ওপি-১১ তেল কূপের গভীরতা পরিমাপ করা হয় ১২,৩৪৫ মিটার (৪০,৫০২ ফুট)। যাই হোক, সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা অবশ্যি আশা করেছিলেন সবকিছু ঠিক থাকলে ১৯৯৫ সাল নাগাদ তারা ভু-অভ্যান্তরে প্রায় ১৫০০০ মিটার গভীরতায় পৌঁছাতে পারবে। কিন্তু ১৯৯২ সালে মাত্রারিক্ত তাপমাত্রার কারণে খনন প্রকল্পটি সেখানেই বন্ধ হয়ে যায়। উক্ত গভীরতায় তাঁদের হিসেব মতে তাপমাত্রা থাকার কথা ছিল ১০০° সে. (২১২° ফা.) এর কাছাকাছি। কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে সেখানকার তাপমাত্রা ছিল অনেক অনেক বেশি, প্রায় ১৮০° সে. (৩৫৬° ফা.)। এই হিসেবে ১৫০০০ মিটার গভীরতায় তাপমাত্রা গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় ৩০০° সে. (৫৭২° ফা.)। যেখানে ড্রিলিং বিটই কোনো কাজে আসবে না।

পৃথিবীর অভ্যান্তরে উক্ত দূরত্বকে আমাদের ভূ-ত্বকের মোটামুটি প্রায় অর্ধেক দূরত্ব ধরা গেলেও পৃথিবীর কেন্দ্রের ৬৩৭০ কি.মি. (৩৯৫৮ মাইল) দূরত্বের তুলনায় এটি খুব সামান্য (০.২৩ শতাংশ) দূরত্বই বটে। পৃথিবীর গঠনকে অনেকটা পেঁয়াজের গঠনের সঙ্গে তুলনা করা যায়। অপেক্ষাকৃত কম পুরুত্বের পাতলা শক্ত আবরণটি হচ্ছে আমাদের ভূ-ত্বক (Earth Crust)। যার পুরুত্ব গড়ে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ কি.মি.। এর পরের স্তরটি গলিত ও অর্ধগলিত উত্তপ্ত ম্যাগমার ম্যান্টল (Mantle)। এটির পুরুত্ব প্রায় ৩০০০ কি.মি.। এর পরবর্তী প্রায় ২০০০ কি.মি. পর্যন্ত বিস্তৃত আরও উত্তপ্ত স্তরটির নাম বহি:কেন্দ্র (Outer Core)। আর এর পরেই রয়েছে সর্বাধিক উত্তপ্ত অন্ত:কেন্দ্র (Central Core)। ভূ-ত্বত্তবিদদের ধারণা পৃথিবীর কেন্দ্রের কাছাকাছি অংশ এখনো অনেকটা সূর্যের মতোই উত্তপ্ত এবং এই তাপমাত্রা প্রায় ৪০০০° সে. (৭২৩২° ফা.)। সৌভাগ্যবশত, মাটির শক্ত বহিরাবরণের জন্য এই তাপ পৃথিবীর বাইরে আসতে পারে না। যতটুকু আসে তা দ্রুতই বাতাসের সঙ্গে শূন্যে মিলিয়ে যায়।

আমাদের এই পৃথিবীর বয়স কম করে হলেও প্রায় ৪৫৪ কোটি বছর। ধারণা করা হয়, সৃষ্টির শুরুতে এটি ছিল একটি জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ড। এর ওপরের অংশের মাটি ঠান্ডা বায়ুমন্ডলের সংস্পর্শে এসে ধীরে ধীরে শীতল হতে থাকে। ফলশ্রুতিতে আমরা বসবাসযোগ্য এই মনোরম ধরণী পেয়েছি। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই দীর্ঘ সময়কালের মধ্যে পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে এর অভ্যান্তরে থাকা নিকেল ও লৌহের মত ভারী মৌলিক উপাদানগুলো এর কেন্দ্রে ঘনীভূত হয়ে পুরো পৃথিবী শীতল হয়ে যায়নি কেন? আর কেনই বা এর অভ্যান্তরভাগ এখনও এতটা উত্তপ্ত? উত্তর একটাই- তেজস্ক্রিয় বিকিরন। হ্যাঁ, অধিকাংশ বিজ্ঞানীই মনে করেন পৃথিবীর অভ্যান্তর ভাগের পটাশিয়াম-৪০, ইউরেনিয়াম-২৩৮, থোরিয়াম-২৩২ প্রভৃতি তেজস্ক্রিয় মৌল এখনো ক্রমাগত তাপ বিকিরণ করে চলেছে। এসব তেজস্ক্রিয় মৌলের অর্ধ-জীবন (Half-life) যথাক্রমে ১৩০ কোটি বছর, সাড়ে ৪০০ কোটি বছর এবং ১৪০০ কোটি বছর। সুতরাং পৃথিবীর অভ্যান্তরভাগ যে আরো বহু বছর যাবৎ উত্তপ্ত থাকবে, তা অনেকটা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়।

===

পূর্ববর্তী টিউনঃ

কেন এমন হয়? [পর্ব-০১] :: বিগ ব্যাং বা মহাবিষ্ফোরণ থেকে বিশ্বব্রহ্মান্ডের সৃষ্টি, এমনটি ধারণা করা হয় কেন? 

Level 0

আমি অয়ন রহমান। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 10 বছর 10 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 6 টি টিউন ও 12 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস

thanku, asob cint korteo valo lage…

Level 0

ধন্যবাদ

thnx notun kisu jante parlam

জিনিসটা মজার এবং প্রচুর গঠনমূলক ব্যাখ্যা আছে এসবের পিছনে….আরেকটু বড় পরিসরে টিউনটা আশা করেছিলাম…..তবে ধন্যবাদ 🙂