শবে বরাত সম্পর্কিত পূর্ণাঙ্গ আলোচনা [মেগা টিউন]

”বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম”

আসসালামু আলাইকুম ।
সকলকে আমার টিউনে স্বাগতম । এটিই আমার প্রথম টিউন । সকলের সহযোগিতা ও পরামর্শ বিশেষভাবে কাম্য ।

আশা করি এ লেখাটি সবাই  মনোযোগ সহকারে পড়বেন ।
আমি শবে বরাত সম্পর্কিত সকল ব্যাখ্যা ইনশাআল্লাহ্ এ লেখাতে উপস্থাপন করার চেষ্টা করব ।
শুধু আপনাদের কাছে অনুরোধ লেখাটি অন্তর দিয়ে না পড়ে আপনার বুদ্ধি দিয়ে বিচার করার চেষ্টা করবেন ।
আর আমার কোন ভুল থাকলে অবশ্যই আমি তা মেনে নেব । কোন মানুষই ভুলের ঊর্ধে নয় ।

ইসলামের মধ্যে এমন কতিপয় বিষয় রয়েছে যাতে অনেকের মধ্যে মতভেদ রয়েছে । এসব বিষয় নিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে অনেক বিভেদ তৈরী করে ফেলেছি । একদল বলছি যে এটা করা ঠিক তো আর এক দল বলছি ওটা করা ঠিক । আবার এসব কারনে এক দল অন্য দলকে গালি দিচ্ছি যা মোটেও ঠিক না । সব মুসলিম ই তো ভাই ভাই ।

নিঃসন্দেহ মুমিনরা ভাই-ভাই, সুতরাং তোমাদের ভাইদের মধ্যে তোমরা শান্তিস্থাপন করবে, আর তোমরা আল্লাহ্কে ভয়-ভক্তি করবে যেন তোমাদের অনুগ্রহ করা হয়। (Al-Hujuraat: 10)

মুমিনগণ, কেউ যেন অপর কাউকে উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোন নারী অপর নারীকেও যেন উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। কেউ বিশ্বাস স্থাপন করলে তাদের মন্দ নামে ডাকা গোনাহ। যারা এহেন কাজ থেকে তওবা না করে তারাই যালেম। (Al-Hujuraat: 11)

কোন ভাই যদি ভুল পথে চলে যায় তবে অন্য ভাইদের উচিত তাকে মন্দ কথা না বলে সঠিক পথটি দেখিয়ে দেওয়া । ইনশাআল্লাহ আমি তাই করব ।

এবার মূল আলোচনায় আসি,

 ➡  কোরআনে শবে বরাতঃ

কোরআনে শবে বরাত বলতে সূরা দোখানের ১ম ৪ আয়াতের কথা বলা হয়ে থাকে । অনেকেই এর তাফসীর উল্লেখ করে বলেন ওখানে যে রাতের কথা বলা আছে তা শাবানের মধ্যরাত্রি । তাফসীরে জালালাইনের ৫ম খন্ডের ৮৫৪ পৃষ্ঠাতে সূরা আদ-দোখানের ৩য় আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছে, “নিশ্চই আমি একে নাজিল করেছি এক বরকতময় রাতে, এটা লাইলাতুল ক্বদর বা শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাত । এতে উম্মুল কিতাব সপ্ত আসমানে অবস্থিত লাওহে মাহফূয থেকে দুনিয়ার আসমানে অবতীর্ণ হয় । নিশ্চয় আমি সতর্ককারী । অর্থাৎ এটা দ্বারা ভয় প্রদর্শন কারী ।”

একটু বুঝার চেষ্টা করুন, দেখুন এখানে বলা হয়েছে, “এটা লাইলাতুল ক্বদর বা শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাত ।” এটার অর্থ দুই ভাবে করা যায়ঃ

(১) তাফসীরকারক এখানে লাইলাতুল ক্বদর এবং শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাত বলতে একই রাতকে বুঝিয়েছেন । তাই দুটিকে “বা” দ্বারা যুক্ত করেছেন । কারন, আমরা জানি একটি শব্দের দুটি ভিন্ন সমার্থক শব্দ লিখতে আমরা “বা” ব্যবহার করি ।
(২) অথবা তাফসীর কারক এখানে লাইলাতুল ক্বদর এবং শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাত বলতে দুটি ভিন্ন রাতকে বুঝিয়েছেন । কারন আমরা এটাও জানি যে দুটি ভিন্ন শব্দের যে কোন একটি কে বুঝাতে “বা” ব্যবহৃত হয় ।

যদি আমরা ধরে নেই যে, তাফসীর কারক এখানে (১) নং অর্থটা বুঝাতে চেয়েছেন, তাহলে আমি একাধিক হাদীস দ্বারা প্রমান দিতে পারব যে লাইলাতুল ক্বদর আসলে রমজান মাসের শেষ দশদিনের বেজোড় রাতগুলোর যে কোন একটি, এটা শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাত নয় । [ সহীহ বুখারী (তাওহীদ) হাদিস নাম্বার:২০১৫,২০১৭,২০২০, জামে তিরমিজী (ইফাঃ) হাদিস নাম্বার:৭৯০]
সুতরাং, এ অর্থটা কোন ক্রমেই গ্রহন যোগ্য না ।

এবার যদি আমরা (২) নং অর্থটা ধরি তাহলে, তাফসীর কারক এখানে দুটি ভিন্ন রাতকে বুঝিয়েছেন । কিন্তু তিনি স্পষ্ট করে বলেননি সেটা কোন রাত । সেটা কি লাইলাতুল ক্বদরের রাত নাকি শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাত । একই সাথে দুটি রাত কোন ভাবেই গ্রহনযোগ্য হতে পারে না । এবার আমরা আর একটু দেখি যে সূরা ক্বদরের ব্যাখ্যায় তিনি কি বলেছেন,
সূরা ক্বদরের ব্যাখ্যায় তাফসীরে জালালাইন সহ সকল তাফসীর গ্রন্থে ক্বদরের রাতকে রমজান মাসের শেষ দশদিনের বেজোড় রাতগুলোর যে কোন একটি বলা হয়েছে । তাহলে দেখা যাচ্ছে তাফসীরে জালালাইনের অন্যখানে ক্বদরের রাতকে রমজান মাসের শেষ দশদিনের বেজোড় রাতগুলোর যে কোন একটি বলা হয়েছে, সেটা শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাত নয় ।
তাহলে (২) নং অর্থটা যদি আমরা ধরি তাহলে তাফসীরে জালালাইনের সূরা ক্বদরের ব্যাখ্যার রেফারেন্স দিয়ে সূরা দোখানের তাফসীরের ৩য় আয়াতের ব্যাখ্যায় রাতটা হবে ক্বদরের রাত এবং সেটা রমজান মাসের শেষ দশদিনের বেজোড় রাতগুলোর যে কোন একটি, শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাত নয় ।
তাফসীরে জালালাইনের অনুবাদক ৫ম খন্ডের পৃষ্ঠা ৬৮০ বলেছেন, ঐ রাতের তাফসীর ”শাবানের মধ্যরাত্রি” শুদ্ধ নয় ।

এবার আসুন আমরা দেখি তাফসীরে ইবনে কাসীরে উক্ত সূরার তাফসীরে কী বলা আছেঃ
তাফসীরে ইবনে কাসীর, ১৬ তম খন্ড পৃষ্ঠা ৬০৯-৬১০ এ বলা হয়েছে ঐ রাতকে শাবান মাসের ১৫ তম রাত বলা কষ্টকর উক্তি, কারন তা কুরআনের আয়াতের পরিপন্থী ।
আবার এ সম্পর্কে ব্যবহৃত হাদীসকে মুরসাল বলা হয়েছে । আরো দেখুন, তাফসীরে মাআরেফুল কোরআন ১২৩৫ পৃষ্ঠা, তাফসীর ফী যিলালিল কোরআন ২৪৮ পৃষ্ঠাতে একই কথা বলা আছে ।

এবার আমি কোরআন দিয়েই তা প্রমান করব ইনশাআল্লাহ । আপনারা হয়তো জানেন যে কোরআনের এক আয়াতের ব্যাখ্যা অন্য আয়াতে পাওয়া যায় । আর এটাই সর্বোত্তম ব্যাখ্যা ।

দেখুন সূরা দোখানের ৩ নং আয়াতে বলা আছে,
”আমি একে নাযিল করেছি। এক বরকতময় রাতে, নিশ্চয় আমি সতর্ককারী।”
আবার, সূরা ক্বদরের ১ নং আয়াতে বলা আছে,
”আমি একে নাযিল করেছি শবে-ক্বদরে।”
আরো দেখুন, সূরা বাকারাহ এর ১৮৫ নং আয়াতে বলা আছে,
”রমযান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন”

এ আয়াত গুলো পাশাপাশি দেখলে স্পষ্ট বুঝা যায় যে কোরআন নাযিল হয়েছে রমযান মাসের শবে ক্বদরের রাতে । আর আমি আগেই হাদীস দ্বারা প্রমাণ করেছি যে ক্বদরের রাত মূলত রমযান মাসের শেষ ১০ দিনের বিজোড় রাতগুলোর একটি । সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, সূরা দোখানের ৩ নং আয়াতে ক্বদরের কথা বলা হয়েছে । এটা কোরআন থেকেই প্রমাণিত হল । এখনও যদি কেউ সূরা দোখানের ৩ নং আয়াতের অর্থ শাবানের ১৫ তম রাত করেন, তবে তা হবে কোরআনের অর্থ বিকৃতির সামিল ।

ইমাম কুরতুবী (রহঃ) তাঁর তাফসীরে বলেছেনঃ “কোন কোন আলেমের মতে ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ দ্বারা উদ্দেশ্য হল মধ্য শাবানের রাত (শবে বরাত)। কিন্তু এটা একটা বাতিল ধারণা।”

অনেকে বলে থাকেন যে শাবানের ১৫ তম রাতে আল্লাহ কোরআন নাযিলের সিদ্ধান্ত নেন এবং তা শবে ক্বদরের রাতে নাযিল করেন । সূরা দোখানের উক্ত আয়াতের অর্থ কোন ভাবেই তেমন না । ওখানে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোন কথাই বলা নেই । আবার শাবানের ১৫ তম রাতে যদি মহান আল্লাহ কোরআন নাযিলের এমন মহা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েই থাকেন তবে একাধিক সহীহ হাদীসে তার বর্ণনা আসার কথা, কিন্ত এ সম্পর্কে একটা সহীহ হাদীসও পাওয়া যায় না । সুতরাং এটা একটা মনগড়া ব্যাখ্যা ছাড়া আর কিছুই না । এমন ব্যাখ্যা যিনিই দিন না কেন তা প্রত্যাখ্যাত ।

একমাত্র তাবেয়ী ইকরিমা (র) এর একটা মত উল্লেখ করে বলা হয় যে, তিনি বলেছেন বরকতময় রাত বলতে শাবান মাসের পনের তারিখের রাতকেও বুঝানো যেতে পারে ।(তাফসীরে জালালাইন)

তিনি যদি এটা বলে থাকেন তাহলে এটা তার ব্যক্তিগত অভিমত । যা কুরআন ও হাদীসের বিরোধী হওয়ার কারণে পরিত্যাজ্য । একাধিক সাহাবী ও তাবেয়ী থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তাঁরা ‘মুবারক রজনী’র ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, এই রাতটি হলো ‘লাইলাতুল ক্বাদর’ বা মহিমান্বিত রজনী। সাহাবীগণের মধ্য থেকে ইবন্ আব্বাস রা. ও ইবন্ উমার রা. থেকে এ ধরণের ব্যাখ্যা বর্ণিত হয়েছে। তাবেয়ীগণের মধ্য থেকে আবূ আব্দুর রহমান আল-সুলামী (৭৪হিঃ), মুজাহিদবিন জাবর (১০২ হিঃ), হাসান বসরী (১১০হিঃ), ক্বাতাদা ইবন্ দি‘আমা (১১৭হিঃ), ও আব্দুর রহমান বিন যায়েদ বিন আসলাম মাদানী (১৮২হিঃ) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁরা সকলেই ব্যাখ্যা করেছেন যে, লাইলাতুল মুবারাকাহ অর্থ হলো লাইলাতুল ক্বাদর। (নাহ্হাস মা’আনিল কুরআন ৬/৩৯৫; যামাখশারী, আল-কাশ্শাফ ৩/৪২৯; ইবনুল ‘আরাবী, আহকামুল কুরআন ৪/১৬৯০; ইবনু আতিয়্যাহ, আল-মুহাররার আল-ওয়াজীয ৫/৬৮-৬৯; কুরতুবী, তাফসীর ১৬/১২৬; আবু হাইয়্যান, আল-বাহর আল-মুহীত ৮/৩২-৩৩; ইবন্ কাছীর, তাফসীর ৪/১৪০; সূযুতী, আদ-দুররুল মানছুর ৫/৭৩৮-৭৪২; শাওকানী, ফাতহুল কাদীর ৪/৫৭০-৫৭২; আলুসী, রুহুল মা’আনী ১৩/১১০; থানবী, তাফসীর-ই আশরাফী ৫/৬১৫-৬১৬; সাবুনী মুহাম্মদ আলী, সাফওয়াতুত্ তাফাসীর ৩/১৭০-১৭১; মুফতী শফী, মা’আরেফ আল-কুরআন ৭/৮৩৫-৮৩৬)
এখন তাহলে আমরা একাধিক সাহাবী ও তাবেয়ীগণের মতকে বেশী প্রাধান্য দেব নাকি একজন তাবেয়ী এর মতকে ? অবশ্যই একাধিক সাহাবী ও তাবেয়ীগণের মতকে । যেখানে আল্লাহর রাসূলের একাধিক সাহাবী ও তাবেয়ীগণ কোরআনের কোন ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেখানে একজন তাবেয়ীর নিজেস্ব ব্যাখ্যা গ্রহন করা মোটও যৌক্তিক নয় ।

ইমাম আবু বকর আল জাসসাস তার আল-জামে লি আহকামিল কুরআন তাফসীর গ্রন্থে লাইলালাতুন মুবারাকা দ্বারা মধ্য শাবানের রাত উদ্দেশ্য করা ঠিক নয় বলে বিস্তারিত আলোচনা করার পর বলেন :
লাইলাতুল কদরের চারটি নাম রয়েছে, তা হল : লাইলাতুল ক্বদর, লাইলাতু মুবারাকাহ, লাইলাতুল বারাআত ও লাইলাতুস সিক।(আল জামে লি আহকামিল কুরআন, সূরা আদ-দুখানের তাফসীর দ্রষ্টব্য)
লাইলাতুল বারাআত হল লাইলাতুল কদরের একটি নাম। শাবান মাসের পনের তারিখের রাতের নাম নয় ।

ইমাম শাওকানী (রহ.) তার তাফসীর ফতহুল কাদীরে একই কথাই লিখেছেন।(তাফসীর ফাতহুল কাদীর : ইমাম শাওকানী দ্রষ্টব্য)

আমার মনে হয় এতটুকু ব্যাখ্যাই যথেষ্ট এটা বুঝাতে যে, সূরা দোখানে কোন ভাবেই শাবান মাসের পনের তারিখের রাতের কথা বলা হয় নি । অর্থাৎ, এটা একদম স্পষ্ট যে, কোরআনের কোথাও শাবানের ১৫ তম রাত তথা শবে বরাতের কোন উল্লেখ নেই ।

হাদীসে শবে বরাতঃ

১ নং হাদীসঃ

ইমাম তিরমিযী (রহঃ) বলেনঃ আমাদের কাছে আহমাদ ইবনে মুনী’ হাদীস বর্ণনা করেছেন যে তিনি ইয়াযীদ ইবনে হারূন থেকে, তিনি হাজ্জাজ ইবনে আরতাহ থেকে, তিনি ইয়াহইয়া ইবনে আবি কাসির থেকে, তিনি উরওয়াহ থেকে, তিনি উম্মুল মু’মিনীন আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে তিনি বলেছেনঃ আমি এক রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিছানায় পেলাম না তাই আমি তাকে খুঁজতে বের হলাম, ‘বাকী নামক কবরস্থানে তাকে পেলাম। তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)বললেনঃ তুমি কি আশংকা করেছো যে আল্লাহ ও তার রাসূল তোমার সাথে অন্যায় আচরণ করবেন? আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমি মনে করেছি আপনি আপনার অন্য কোন স্ত্রীর কাছে গিয়েছেন। তিনি বললেনঃ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মধ্য শাবানের রাতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন, অতঃপর কালব গোত্রের পালিত বকরীর পশমের পরিমানের চেয়েও অধিক পরিমান লোকদের ক্ষমা করেন।

ইমাম তিরমিযী বলেনঃ আয়িশা (রাঃ) এর এই হাদীস আমি হাজ্জাজের বর্ণিত সনদ (সূত্র) ছাড়া অন্য কোনভাবে চিনি না। আমি মুহাম্মাদকে (ইমাম বুখারী,ইমাম তিরমিযীর ওস্তাদ) বলতে শুনেছি যে, তিনি হাদীসটিকে দুর্বল বলতেন। তিরমিযী (রহঃ) বলেনঃ ইয়াহ্ইয়া ইবনে কাসীর উরওয়াহ থেকে হাদীস শুনেননি। এবং মুহাম্মদ (ইমাম বুখারী) বলেছেনঃ হাজ্জাজ ইয়াহ্ইয়াহ ইবনে কাসীর থেকে শুনেননি। অপর দিকে এ হাদীসের একজন বর্ণনাকারী হাজ্জাজ ইবনে আরতাহ মুহাদ্দিসীনদের নিকট দুর্বল বলে পরিচিত।

এ হাদীসটি সম্পর্কে ইমাম বুখারী ও ইমাম তিরমিযীর মন্তব্যে প্রমাণিত হয় যে, হাদীসটি দুটো দিক থেকে মুনকাতি অর্থাৎ উহার সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন।

এ হাদীসটি ‘আমলের ক্ষেত্রে পরিত্যাজ্য হওয়ার জন্য ইমাম তিরমিযীর এ মন্তব্যটুকু কি যথেষ্ট নয়? যদি তর্কের খাতিরে এ হাদীসটিকে বিশুদ্ধ বলে ধরে নেয়া হয় তাহলে কি প্রমাণিত হয়? আমরা যারা ঢাকঢোল পিটিয়ে মাসজিদে একত্র হয়ে যেভাবে শবে বরাত উদযাপন করি তাদের ‘আমলের সাথে এ হাদীসটির মিল কোথায়? বরং এ হাদীসে দেখা গেল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিছানা ছেড়ে চলে গেলেন, আর পাশে শায়িত আয়িশা (রাঃ) কে ডাকলেন না। তাকে জাগালেন না বা সালাত আদায় করতে বললেন না। অথচ আমরা দেখতে পাই যে, রামাযানের শেষ দশকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে রাত জেগে ইবাদাত-বন্দেগী করতেন এবং পরিবারের সকলকে জাগিয়ে দিতেন। বেশী পরিমাণে ইবাদাত-বন্দেগী করতে বলতেন। যদি ১৫ শাবানের রাতে কোন ইবাদাত করার ফাযীলাত থাকত তাহলে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেন আয়িশাকে (রাঃ) বললেন না? কেন রামাযানের শেষ দশকের মত সকলকে জাগিয়ে দিলেন না, তিনি তো নেক কাজের প্রতি মানুষকে আহ্বান করার ক্ষেত্রে আমাদের সকলের চেয়ে অগ্রগামী ছিলেন। এ ব্যাপারে তিনি তো কোন অলসতা বা কৃপণতা করেননি।
তাছাড়াও তিনি ঐ একবার ব্যতীত সারা জীবনে যে আর এমন করেছেন বা বলেছেন তেমন কোথাও পাওয়া যায় না ।

২ নং হাদীসঃ

আলা ইবনে হারিস থেকে বর্ণিত, আয়িশা (রাঃ) বলেনঃ এক রাতে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করছিলেন। সিজদাহ এত দীর্ঘ করলেন যে, আমি ধারণা করলাম তিনি ইন্তেকাল করেছেন। আমি এ অবস্থা দেখে দাড়িয়ে তার বৃদ্ধাঙ্গুল ধরে নাড়া দিলাম, আঙ্গুলটি নড়ে উঠল। আমি চলে এলাম। সালাত শেষ করে তিনি বললেনঃ হে আয়িশা অথবা বললেন হে হুমায়রা! তুমি কি মনে করেছ আল্লাহর নবী তোমার সাথে বিশ্বাস ভংগ করেছেন? আমি বললামঃ আল্লাহর কসম হে রাসূল! আমি এমন ধারণা করিনি। বরং আমি ধারণা করেছি আপনি না জানি ইন্তেকাল করলেন! অতঃপর তিনি বললেনঃ তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললামঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভাল জানেন। তিনি বললেনঃ এটা মধ্য শাবানের রাত। এ রাতে আল্লাহ তা’আলা তার বান্দাদের প্রতি মনোনিবেশ করেন। ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং রাহমাত প্রার্থনাকারীদের রহম করেন। আর হিংসুকদেরকে তাদের অবস্থার উপর ছেড়ে দেন। (বাইহাকী তার শুয়াবুল ঈমান কিতাবে বর্ণনা করেছেন)

হাদীসটি মুরসাল। সহীহ বা বিশুদ্ধ নয় । বর্ননাকারী ’আলা' আয়িশা (রাঃ) থেকে শুনেননি।

৩ নং হাদীসঃ

আলী ইবনে আবী তালেব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন তোমরা রাত জেগে সালাত আদায় করবে আর দিবসে সিয়াম পালন করবে। কেননা আল্লাহ তা’আলা সূর্যাস্তের পর দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করে বলেনঃ আছে কি কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কোন রিয্ক প্রার্থনাকারী আমি রিয্ক দান করব। আছে কি কোন বিপদে নিপতিত ব্যক্তি আমি তাকে সুস্থ্যতা দান করব। এভাবে ফজর পর্যন্ত বলা হয়ে থাকে। (ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/৪৪৪)

এ হাদীসটি ইমাম ইবনু মাজাহ তাঁর উস্তাদ হাসান বিন আলী আল-খাল্লাল থেকে, তিনি আব্দুর রাজ্জাক থেকে, তিনি মুয়াবিয়া বিন আব্দুল্লাহ বিন জাফর থেকে, তিনি তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ বিন জাফর থেকে, তিনি হযরত আলী ইবনু আবী তালিব (রাঃ) থেকে রাসূলুল্লাহ (সঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন।

মুহাদ্দিসগণ হাদীসটিকে বানোয়াট বা অত্যান্ত দুর্বল পর্যায়ের বলে বর্ণনা করেছেন। এ হাদীসটি একমাত্র ইবনু আবি সাবরাহ বর্ণনা করেছেন। তিনি ব্যতীত অন্য কেউ এ হাদীস বর্ণনা করেননি। এ হাদীসে আলী ইবু আবি তালিব থেকে তাঁর কোন ছাত্র বর্ণনা করেননি। আব্দুল্লাহ বিন জাফর বিন আবি তালিব থেকেও তাঁর কোন ছাত্র হাদীসটি বর্ণনা করেননি। এমনকি মুয়াবিয়া ও ইবরাহিম বিন মুহাম্মদ থেকেও তাঁদের কোন ছাত্র হাদীসটি বর্ণনা করেননি। শুধুমাত্র ইবনু আবি সাবরাহ দাবী করেছেন যে, তিনি ইবরাহীম থেকে উক্ত সনদে হাদীসটি শ্রবন করেছেন। তাঁর কাছ থেকে আব্দু রাজ্জাক ও অন্যান্যরা বর্ণনা করেছেন।
ইবনু আবি সাবরাহ (১৬২ হি) এর পূর্ননাম আবু বকর বিন আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মদ বিন আবি সাবরাহ। তুলনামূলক নিরীক্ষা ও বিচারের মাধ্যমে হাদীসের ইমামগণ নিশ্চিত হয়েছেন যে, তিনি হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় নিতেন। অসংখ্য ইমাম তাঁকে মিথ্যা ও বানোয়াট হাদীস বর্ণনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত করেছেন। তন্মধ্যে ইমাম আহমদ, ইয়াহয়িয়া বিন মাঈন, আলী ইবনুল মাদীনী, বুখারী, ইবনু আদী, ইবনু হিব্বান ও হাকিম নাইসাপূরী অন্যতম। (ইবনু হাজার, তাক্বরীব, পৃষ্ঠাঃ ৬৩২; তাহযীব, ১২/২৫-২৬)
এরই আলোকে আল্লামা শিহাব উদ্দীন আহমদ বিন আবি বকর আল-বুসীরী (৮৪০ হি) এ হাদীসের টীকায় বলেছেন, আবনু আবি সাবরাহর দুর্বলতার কারণে এ সনদটি দুর্বল। ইমাম আহমদ ও ইবনু মাঈন তাঁকে হাদীস বানোয়াটকারী হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। (আল-বুছীরী, যাওয়ায়েদ ইবনে মাজাহ, পৃষ্ঠাঃ ২০৩)
এ যুগের বিখ্যাত মুহাদ্দিস নাসিরুদ্দীন আল-বানী (রহঃ) বলেছেন, হাদীসটি অত্যন্ত দুর্বল বা বানোয়াট। তিনি আরো বলেন, সনদটি বানোয়াট। (আলবানী, দাঈফু সুনানি ইবনি মাজাহ, পৃষ্ঠাঃ ১০৩; যাঈফাহ, ৫/১৫৪)

৪ নং হাদীসঃ

উসমান ইবনে আবিল আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা দেয়, আছে কি কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কেহ কিছু চাইবার আমি তাকে তা দিয়ে দিব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ মুশরিক ও ব্যভিচারী বাদে সকল প্রার্থনাকারীর প্রার্থনা কবুল করা হয়। (বাইহাকী, শুয়াবুল ঈমান)
বিখ্যাত মুহাদ্দিস নাসিরুদ্দীন আল-বানী (রহঃ) হাদীসটিকে তার সংকলন ”যয়ীফ আল-জামে” নামক কিতাবের ৬৫২ নং ক্রমিকে দুর্বল প্রমাণ করেছেন।

৫ নং হাদীসঃ

”যে ব্যাক্তি মধ্য শাবানের রাত ও দুই ঈদের রাত ইবাদতে জাগ্রত থাকবে তার অন্তরের মৃত্যু হবে না যে দিন সকল অন্তর মরে যাবে।” (ইবনু হাজার, তাক্বরীব, পৃষ্ঠাঃ ৬৩২; তাহযীব, ১২/২৫-২৬)

এই হাদীসের একমাত্র বর্ণনাকারী উপর্যুক্ত ঈসা ইবনু ইবরাহীম ইবনু তাহমান বাতিল হাদীস বর্ণনাকারী হিসাবে সুপরিচিত। ইমাম বুখারী, নাসায়ী, ইয়াহয়িয়া বিন মাঈন ও আবু হাতিম রাযি ও অন্যান্য সকল মুহাদ্দিস একবাক্যে তাকে পরিত্যক্ত বা মিথ্যাবাদী রাবী বলে উল্লেখ করেছেন। এছাড়া ঈসা ইবনু ইবরাহীন নামক এই ব্যক্তি তার উস্তাদ হিসেবে যার নাম উল্লেখ করেছেন সেই সালামা বিন সুলাইমান দুর্বল রাবী বলে পরিচিত। আর তার উস্তাদ হিসেবে যার নাম উল্লেখ করা হয়েছে সেই মারওয়ান বিন সালিম মিথ্যা হাদীস বর্ণনার অভিযোগে অভিযুক্ত। (ইবনুল জাওযী, আল-ইলাল আল-মুতানাহিয়া ২/৫৬২; ইবনু হাজার, আল-ইসাবা ফী তাময়ীযীস সাহাবা ৫/৫৮০; তালখীস আল-হাবীর, ২/৬০৬)
এখানে দেখা যাচ্ছে যে, এই হাদীসটির সনদের রাবীগণ অধিকাংশই মিথ্যাবাদী বা অত্যন্ত দূর্বল। এরা ছাড়া কেউ এই হাদীস বর্ণনা করেননি। কাজেই হাদীসটি রানোয়াট পর্যায়ের।

৬ নং হাদীসঃ

হাদীস শরীফে বলা হয়েছে: ”আল্লাহ তা’আলা মধ্য শাবানের রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন এবং অংশীবাদী (মুশরিক) ও বিদ্বেষ পোষনকারী ব্যতীত সকলকে মাফ করে দেন ।” (ইবনু মাজাহ, আস-সূনান ১/৪৪৫, বাযযার, আল-মুসনাদ ১/১৫৭)

এই অর্থের হাদীস কাছাকাছি শব্দে ৮ জন সাহাবীঃ আবূ মূসা আশআরী, আউফ ইবনূ মালিক, আব্দল্লাহ ইবনু আমর, মুয়ায ইবনূ জাবাল, আবু সা’লাবা আল-খুশানী, আবূ হুরাইরা, আয়েশা ও আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ) থেকে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে। এগুলির মধ্যে কিছু সনদ দুর্বল ও কিছু সনদ হাসান পর্যায়ের। সামগ্রিক বিচারে হাদীসটি সহীহ। যদিও বিভিন্ন মুহাদিাদসীনগণ হাদীসটিকে দুর্বল বলেছেন তবুও শাইখ আলবানী বলেন, হাদীসটি সহীহ তা অনেক সাহাবী থেকে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে । (আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদীস আসসাহীহা ৩/১৩৫)

শবে বরাত সম্পর্কিত যত হাদীস আছে তার মধ্যে এটিই একমাত্র হাদীস যা সর্বোচ্চ হাসান পর্যায়ের ।এই হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, এই রাতে আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে মাফ করেন। কিন্তু এই মাফ অর্জনের জন্য শিরক ও বিদ্বেষ বর্জন ব্যতীত অন্য কোন আমল করার কথা এ হাদীসে উল্লেখ নাই । অর্থাৎ, এ রাতের গুরুত্ব এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হলেও এ রাতের এবাদাতের কোন গুরুত্বের কথা প্রমাণিত হয় না ।

এছাড়া শবে বরাত সম্পর্কিত যত হাদীস আছে তার মূলভাব উপরুক্ত হাদীসগুলোর অনুরূপ বা একই ।
শবে বরাত সম্পর্কে এ ছাড়া বর্ণিত অন্যান্য সকল হাদীস সম্পর্কে ইবনে রজব হাম্বলী (রহঃ) বলেনঃ এ মর্মে বর্ণিত অন্য সকল হাদীসই দুর্বল।

এখন একটু ভাবুন, শবে বরাতের রাতটি যদি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ হতো তবে মহান আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কোরআনে তা অবশ্যই উল্লেখ করতেন যেমনটা শবে ক্বদরের ক্ষেত্রে করেছেন । আর তা না হলেও একাধিক সহীহ হাদীসে তার বর্ণনা আসত । যেমনটি আমরা দেখতে পাই না ।(একটি হাসান হাদীস ব্যতীত) যে হাদীসগুলো উল্লেখ করা হয় তা সবই দুর্বল ।
দুর্বল হাদীস ঐ সকল আমল ও ইবাদাতের ক্ষেত্রে গ্রহণ করা যায় যে সকল আমল কোন সহীহ হাদীস দ্বারা ইতোপূর্বে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু মধ্য শাবানের রাতের ক্ষেত্রে কোন সহীহ হাদীস নেই। এ মূল নীতিটি ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) উল্লেখ করেছেন।

সহীহ হাদীসে শাবান মাসের রোজার ব্যপারে যা বলা আছে তা নিন্মরূপঃ

(১) ইয়াহইয়া ইবনু ইয়াহইয়া (রহঃ) উম্মুল মুমিনীন আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাধারে (নফল) সাওম (রোযা/রোজা/সিয়াম/ছিয়াম) পালন করে যেতেন- এমন কি আমবা বলাবলি করতাম, হয়ত তিনি সাওম (রোযা/রোজা/সিয়াম/ছিয়াম) ছাড়বেন না। আবার কখনও তিনি একাধারে (দীর্ঘদিন) সাওম (রোযা/রোজা/সিয়াম/ছিয়াম) পালন করতেন নাঃ এমন কি আমরা বলাবলি করতাম, হয়ত তিনি আর সাওম (রোযা/রোজা/সিয়াম/ছিয়াম) পালন করবেন না। আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে একমাত্র রমযান মাস ছাড়া কখনও পূর্ণ মাস সাওম (রোযা/রোজা/সিয়াম/ছিয়াম) পালন করতে দেখিনি। আমি তাকে শাবান মাস ব্যতীত অন্য কোন মাসে অধিক সংখ্যক (নফল) সাওম (রোযা/রোজা/সিয়াম/ছিয়াম) পালন করতে দেখিনি। (সহীহ মুসলিম (ইফাঃ), অধ্যায়ঃ ১৪/ সিয়াম (রোজা), হাদিস নাম্বার:২৫৯২,২৫৯৩)

(২) ইসহাক ইবনু ইবরাহীম (রহঃ) আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্নিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাবান মাস ব্যাতীত বছরের অন্য কোন মাসে এত অধিক সাওম (রোযা/রোজা/সিয়াম/ছিয়াম) পালন করতেন না। তিনি বলতেনঃ তোমরা যথাসাধ্য অধিক পরিমাণে ভাল কাজ কর। কারণ আল্লাহ তা’আলা সওয়াব দিতে কখনও ক্লান্ত হন না বরং তোমরাই আমল করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়। আরও বলতেনঃ ”বান্দা যে কাজ নিরবিচ্ছিন্নভাবে করতে পারে, তাই আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়- তার পরিমাণ কম হলেও।”(সহীহ মুসলিম (ইফাঃ), অধ্যায়ঃ ১৪/ সিয়াম (রোজা), হাদিস নাম্বার:২৫৯৪)

(৩) আবূর রবী যাহরানী (রহঃ) আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একমাত্র রমযান মাস ব্যতীত কখনও পূর্ণমাস সাওম (রোযা/রোজা/সিয়াম/ছিয়াম) পালন করেননি। তিনি যখন (নফল) সাওম (রোযা/রোজা/সিয়াম/ছিয়াম) পালন করতেন তা একাধারে করে যেতেন। এমনকি লোক মনে করত না, আল্লাহর শপথ! তিনি আর সাওম (রোযা/রোজা/সিয়াম/ছিয়াম) ছাড়বেন না। আবার কখন, তিনি সাওম (রোযা/রোজা/সিয়াম/ছিয়াম) পালন করা হতে বিরত থাকতেন। যাতে লোকেরা মনে করত আল্লাহর শপথ!তিনি হয়ত আর সাওম (রোযা/রোজা/সিয়াম/ছিয়াম) পালন করবেন না। (কেবল মাত্র রমযানের পূর্ণ মাস সাওম (রোযা/রোজা/সিয়াম/ছিয়াম) পালন করার জন্য মুসলমানদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মহানাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি মাসের কয়েক দিন করে নফল সাওম (রোযা/রোজা/সিয়াম/ছিয়াম) পালন করতেন। কিন্তু শাবান মাসে সর্বাধিক সংখ্যক সাওম (রোযা/রোজা/সিয়াম/ছিয়াম) পালন করতেন। কারণ শাবান মাস হচ্ছে রমযান মাসের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার মাস।) (সহীহ মুসলিম (ইফাঃ), অধ্যায়ঃ ১৪/ সিয়াম (রোজা), হাদিস নাম্বার:২৫৯৫)

এসকল হাদীসে আমাদের শাবান মাসে রোজা রাখার ব্যপারে উৎসাহিত করা হয়েছে । এসব হাদীসের কোথাও বিশেষভাবে শাবানের ১৫ তারিখে রোজা রাখার কথা বলা হয় নি । মহানবী শাবানে অধিক রোজা রাখতেন কারন তা ছিল রমযান মাসের জন্য প্রস্তুতি ।

শবে বরাতের রাতের এবাদাত সম্পর্কিত হাদীস পর্যালোচনাঃ

(১) ”যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাতে প্রত্যেক রাকআতে ৩০ বার সূরা ইখলাস পাঠের মাধ্যমে ৩০০ রাকআত সালাত আদায় করবে, জাহান্নামের আগুন অবধারিত এমন ১০ ব্যক্তির ব্যাপারে তার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।”
হাদীসটি আল্লামা ইবনুল ক্বায়্যিম বাতিল বা ভিত্তিহীন হাদীস সমূহের মধ্যে উল্লেখ করেছেন। (ইবনুল ক্বাইয়্যিম, নাক্বদুল মান্কুল ০১/৮৫)

(২) হযরত আলী ইবন্ আবি তালিব রা.-এর নামে প্রচারিত; ”যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাতে ১০০ রাকাআত সালাত আদায় করবে, প্রত্যেক রাকাআতে সূরা ফাতিহা ও ১০ বার সূরা ইখলাস পাঠ করবে সে উক্ত রাতে যত প্রয়োজনের কথা বলবে আল্লাহ তা’আলা তার সকল প্রয়োজন পূরণ করবেন। লাওহে মাহফুযে তাকে দুর্ভাগা লিপিবদ্ধ করা হলেও তা পরিবর্তন করে সৌভাগ্যবান হিসেবে তার নিয়তি নির্ধারণ করা হবে। আল্লাহ তা’আলা তার কাছে ৭০ হাজার ফেরেশতা প্রেরণ করবেন যারা তার পাপরাশি মুছে দিবে, বছরের শেষ পর্যন্ত তাকে সুউচ্চ মর্যাদায় আসীন রাখবে, এছাড়াও আল্লাহ তা’আলা আদন’ জান্নাতে ৭০ হাজার বা ৭ লক্ষ ফেরেশতা প্রেরণ করবেন যারা বেহেশতের মধ্যে তার জন্য শহর ও প্রাসাদ নির্মাণ করবে এবং তার জন্য বৃক্ষরাজি রোপন করবে ....। যে ব্যক্তি এ নামায আদায় করবে এবং পরকালের শান্তি কামনা করবে আল্লাহ তা’আলা তার জন্য তার অংশ প্রদান করবেন।”
হাদীসটি সর্বসম্মতভাবে বানোয়াট ও জাল হিসেবে প্রমাণিত। এর বর্ণনাকারীগণ কেউ অজ্ঞাত পরিচয় এবং কেউ মিথ্যাবাদী জালিয়াত হিসেবে পরিচিত। (ইবনুল জাওযী, আল-মাওদু’আত ০২/৪৯-৫০; সূয়ুতী আল-লাআলী, ০২/৫৭-৫৮; ইবন্ ইরাক, তানযীহ, ০২/৯২-৯৩; মোল্লা ক্বারী, আল-আসরার, পৃ-৩৩০-৩৩১; আল-মাসনু, পৃ-২০৮-২০৯; শাওকানী, আল ফাওয়ায়েদ ০১/৭৫-৭৬)
মূলত ১০০ রাকাআত সালাত আদায়ের প্রচলন হিজরী ৪র্থ শতকের পরে মানুষের মাঝে প্রসিদ্ধি লাভ করে। মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন যে, ৪৪৮ হি. সনে বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রথম ইহার প্রচলন শুরু হয়। (মোল্লা আলী ক্বারী মিরক্বাতুল মাফাতীহ ৩/৩৮৮)। এসময়ে বিভিন্ন মিথ্যাবাদী-গল্পকার, ওয়াযেয় এই অর্থে কিছু জাল হাদীস তৈরী করে প্রচার করে।

(৩) ৫০ রাকাআত আদায়ের ফযীলত সংক্রান্ত বর্ণিত হাদীসটি সম্পর্কে ইমাম যাহাবী একে ভিত্তিহীন ও বানোয়াট হাদীস হিসেবে হাদীসটির বর্ণনাকারী অজ্ঞাত রাবী মুহাম্মদ বিন সাঈদ আলমীলী আত-তাবারীর জীবনীতে উল্লেখ করেছেন। উক্ত মুহাম্মদ বিন সাঈদ এ হাদীসটি তার মতই অজ্ঞাত রাবী মুহাম্মদ বিন আমর আল-বাজালী এর সনদে হযরত আনাস রা. থেকে মরফু হিসেবে বর্ণনা করেছেন। (যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল, ০৬/১৬৮-১৬৯)

(৪) মধ্য শাবানের রজনীতে ১৪ আকাআত সালাত আদায়ের ফযীলত সংক্রান্ত হাদীসটি উল্লেখ করে ইমাম বায়হাক্বী বলেন, ”ইমাম আহমদ বলেছেন যে, এই হাদীসটি আপত্তিকর, পরিত্যাক্ত, জাল ও বানোয়াট বলে প্রমাণিত। কেননা হাদীসটির সনদে অজ্ঞাত পরিচয় বর্ণনাকারীগণ রয়েছে।” (বায়হাক্বী, শু’আব আল-ঈমান, ০৩/৩৮৬-৩৮৭, হাদীস নং- ৩৮৪১)

(৫) উক্ত রাত্রে ১২ রাকআত সালাত আদায়ের ফযীলত সংক্রান্ত বর্ণিত হাদীসটি জালিয়াতকারীগণ হযরত আবু হুরায়রা রা. পর্যন্ত একটি জাল সনদ তৈরী করে তাঁর সূত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে প্রচার করেছে। উক্ত হাদীসটির সনদের অধিকাংশ বর্ণনাকারীই অজ্ঞাত। পরিচিত বর্ণনাকারীগণ দূর্বল ও পরিত্যাজ্য। (ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ’আত, ০২/৫২; সূয়ুতী, আল-লাআলী ০২/৫৯)

উপরের আলোচনার মাধ্যমে এটা সুস্পষ্ট ভাবে প্রমাণিত হয় যে, মধ্য শাবানের রাতে নির্দ্দিষ্ট পদ্ধতিতে নির্দ্দিষ্ট সূরার মাধ্যমে নির্দ্দিষ্ট রাকাত সালাত আদায় সংক্রান্ত হাদীস সমূহ বানোয়াট ভিত্তিহীণ । মুহাদ্দিসগণ এ ব্যপারে সকলেই একমত । কিন্তু কতিপয় নেককার ও সরলপ্রাণ ফকীহ ও মুফাস্সীর তাঁদের রচনাবলিতে এগুলির জালিয়াতি ও অসারতা উল্লেখ ব্যতীতই এসকল ভিত্তিহীন হাদীস স্থান দিয়েছেন। এমনকি কেউ কেউ এগুলোর উপর ভিত্তি করে ফতোয়া প্রদান করেছেন ও তদনুযায়ী আমল করেছেন, যা পরবর্তীতে এই রীতি প্রসারিত হওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করেছে।
মোল্লা আলী ক্বারী (১০১৪ হি) মধ্য শাবানের রাতে সালাত আদায়ের ফযীলত সংক্রান্ত হাদীসগুলির অসারতা উল্লেখপূর্বক বলেন, সবচেয়ে আশ্চার্যের ব্যাপার হলো যে, যারা সুন্নাতের ইলমের সন্ধান পেয়েছেন তারা এগুলো দ্বারা প্রতারিত হন কি করে! এ সালাত চতুর্থ হিজরী শতকের পর ইসলামের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে যার উৎপত্তি হয়েছে বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে। এ ব্যাপারে অসংখ্য জাল হাদীস তৈরী করা হয়েছে যার একটিও সঠিক বা নির্ভরযোগ্য নয়। (মোল্লা আলী ক্বারী, আল-আসরার, পৃষ্ঠাঃ ৩৩০-৩৩১; ইবনুল ক্বাইয়্যেম, আল-মানার আল-মুনীফ, পৃষ্ঠাঃ ৮৯-৯৯)
তিনি আরো বলেন, হে পাঠক, এসকল ভিত্তিহীন মিথ্যা হাদীস ”কুতুল কুলুক” ”ইহয়িয়া-উ-উলুমিদ্দীন” ও ইমাম সা’লাবীল তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ থাকার কারণে আপনারা প্রতারিত ও বিভ্রান্ত হবেন না। (মোল্লা আলী ক্বারী, আল মাসনূ, পৃষ্ঠাঃ ২০৮-২০৯)
ইসমাঈল বিন মুহাম্মাদ আজলুনীও (১১৬২ হি) অনুরূপ মন্তব্য করেছেন। (আজলুনী, কাশফুল খাফা, ২/৫৫৪-৫৫৫)
আল্লামা শাওকানী (১২৫০ হি) শবে বরাতের রাত্রিতে আদায়কৃত এই সালাত সংক্রান্ত হাদীসের ভিত্তিহীণতা উল্লেখ পূর্বক বলেন, এসকল হাদীস দ্বারা এক দল ফকীহ প্রতারিত হয়েছেন। যেমন ইহয়িয়াউ উলূমিদ্দীন গ্রন্থকার ইমাম গযালী ও অন্যান্যরা। এমনিভাবে কতিপয় মুফাসসিরও প্রতারিত হয়েছেন। এ সালাতের বিষয়ে বিভিন্ন ধরণের জাল হাদীস রচিত হয়েছে। এ সকল হাদীস মাউযূ বা বানোয়াট হওয়ার অর্থ হলো, এই রাত্রিতে নির্ধারিত পদ্ধতিতে নির্ধারিত রাকআত সালাত আদায়ের প্রচলন বাতিল ও ভিত্তিহীন।(শাওকানী, আল-ফাওয়ায়েদ ১/৭৬)

হাফেয ইবনে রজব (রহঃ) তার কিতাব লাতায়িফুল মায়ারিফে লিখেছেনঃ

”তাবেয়ীদের যুগে সিরিয়ায় খালিদ ইবনে মা’দান, মকহুল, লুকমান ইবনে আমের প্রমুখ আলিম এ রাতকে মর্যাদা দিতে শুরু করেন এবং এ রাতে বেশী পরিমাণে ইবাদাত-বন্দেগী করতেন। তখন লোকেরা তাদের থেকে এটা অনুসরণ করতে আরম্ভ করল। এরপর লোকদের মধ্যে মতানৈক্য শুরু হল; বসরা অঞ্চলের অনেক আলেমগণ এ রাতকে গুরুত্ব দিতেন। কিন্তু মক্কা ও মদীনার আলিমগণ এটাকে বিদ’আত বলে প্রত্যাখ্যান করলেন। অতঃপর সিরিয়াবাসী আলিমগণ দুই ভাগ হয়ে গেলেন। একদল এ রাতে মাসজিদে একত্র হয়ে ইবাদাত-বন্দেগী করতেন। এদের মধ্যে ছিলেন খালেদ ইবনে মা’দান, লোকমান ইবনে আমের। ইসহাক ইবনে রাহভিয়াহও তাদের অনুরূপ মত পোষণ করতেন।
আলিমদের অন্যদল বলতেনঃ এ রাতে মাসজিদে একত্র হয়ে ইবাদাতবন্দেগী করা মাকরূহ, তবে কেহ ব্যক্তিগতভাবে ইবাদাত-বন্দেগী করলে তাতে দোষের কিছু নেই। ইমাম আওযায়ী এ মত পোষণ করতেন।
মোট কথা হল, মধ্য শাবানের রাতের আমল সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরামদের থেকে কোন কিছু প্রমাণিত নয়। যা কিছু পাওয়া যায় তা তাবেয়ীগণের যুগে সিরিয়ার একদল আলেমের আমল

এ রাতটি সাহাবীগণের যুগে কেউ পালন করেননি। তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ীগণের যুগ থেকে কেউ কেউ এরাত পালন শুরু করেন। তখন অন্যান্য তাবেয়ী তাঁদের এ কাজের প্রতিবাদ করে বলেন যে, যেহেতু কোনো সাহাবী বা মশহুর তাবেয়ী ইমাম ও ফকীহ এ রাত পালন করেননি, সেহেতু তা পালন করা জাযেয় নয়। এ রাত পালনের প্রতিবাদে মদীনার প্রখ্যাত তাবে-তাবেয়ী আব্দুর রহমান বিন যাইদ বিন আসলাম (১৮২ হি.) বলেন: আমাদের কোনো উস্তাদ, মদীনার কোনো (ইমাম) ফকীহ (এমনকি)কোনো আলেমকে দেখিনি যে শাবান মাসের মাঝের রাতের দিকে কোনো রকম ভ্রক্ষেপ করেছেন। (ইবন্ ওয়াদ্দাহ,আল-বিদাউ,পৃষ্ঠাঃ ৪৬)

অর্থাৎ,এ রাত উজ্জ্বাপন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে ছিল না, সাহাবীগণের যুগে ছিল না শুধুমাত্র তাবেয়ীগণের যুগে, তাও তাবেয়ীগণ পালন করেন নি তাদের যুগে কিছু আলেম এর সূত্রপাত করেন । তবে এটা কি বেদ’আত নয় ? অবশ্যই বেদ’আত ।

যে কেহ এমন আমল  করবে যা করতে আমরা (ধর্মীয়ভাবে) নির্দেশ দেইনি তা প্রত্যাখ্যাত। (মুসলিম)

সাহাবী জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুমু’আর খুতবায় বলতেনঃ আর শুনে রেখ! সর্বোত্তম কথা হল আল্লাহর কিতাব ও সর্বোত্তম পথ-নির্দেশ হল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পথ-নির্দেশ। আর ধর্মে নতুন বিষয় প্রচলন করা হল সর্ব নিকৃষ্ট বিষয়। এবং সব ধরনের বিদ’আতই পথভ্রষ্টতা। (মুসলিম)

”সকল নব-আবিস্কৃত (দীনের মধ্যে) বিষয় হতে সাবধান! কেননা প্রত্যেকটি নব-আবিস্কৃত বিষয় বিদ’আত, আর প্রত্যেকটি বিদ’আত হল পথভ্রষ্টতা।” (আবূ দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ ও বাইহাকী)

শবেবরাত উজ্জ্বাপন অবশ্যই নব আবিষ্কৃত এবং একটি বিদ’আত । আমাদের বিদ’আত থেকে সাবধান থাকতে হবে তা না হলে আমরা পথভ্রষ্ট হয়ে যাব ।

আবার অন্য ভাবে দেখুন,

সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ”আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা আমারউম্মতকে কোন গোমরাহী বা বিভ্রান্তিতে একমত হতে দিবেন না। (তিরমিযী)

সাহাবী আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা আমার উম্মতকে কোন ভ্রান্ত বিষয়ে একমত হওয়া থেকে মুক্তি দিয়েছেন। (সহীহ জামেয়)

শবে বরাত উজ্জ্বাপন নিয়েও সবার মধ্যে কোন ঐক্যমত নেই । একটু ভেবে দেখবেন ।

আবার বলা হয়েছে,

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্নেহাস্পদ দৌহিত্র আবূ মুহাম্মাদ হাসান ইবনু আলী ইবনু আবী তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হতে এ কথা শুনে স্মরণ রেখেছিঃ  সন্দেহযুক্ত বিষয় বর্জন করে সন্দেহমুক্ত বিষয় গ্রহণ কর। (তিরমিযীঃ ২৫২০, নাসায়ীঃ ৫৭১১, আর ইমাম তিরমিযী বলেছেনঃ হাদীসটি হাসান সহীহ)

আশা করি আমার এ হাদীসটা উল্লেখ করার উদ্দেশ্য আপনারা বুঝতে পেরেছেন ।

এ পর্যন্ত আমার সকল আলোচনা যদি আপনারা পড়ে থাকেন তবে অবশ্যই আপনাদেরর বুঝে যাবার কথা যে, শবে বরাত উজ্জ্বাপন মূলত একটি বিদ’আত । সকল মুসলিমের উচিত তা পরিহার করা । যেখানে শবে বরাত উজ্জ্বাপনই বেদ’আত সেখানে সে রাত সম্পর্কিত কোন এবাদাত বা আলাদা এবাদাত থাকার কোন অবকাশই নেই ।

শবে বরাতের রাতকে উদ্দেশ্য না করে একাধিক সহীহ হাদীসে আছে প্রত্যেক রাতের শেষ তৃতীয়াংশে ইবাদাতের কথা । আমরা কতজন সেটা করি ?
শুধু শাবানের ১৫ তারিখে শবে বরাতের রোজা না রেখে, একাধিক সহীহ হাদীসে আছে প্রত্যেক মাসের ১৩,১৪,১৫ তারিখে রোজা রাখার কথা । তা আমরা কয়জনে পালন করছি ?
আসলে আমরা যদি সহীহ আমল গুলোই করার চেষ্টা করি তবে তা করে শেষ করতে পারব না, নতুন কোন আমল করার তো প্রশ্নই আসে না ।

এবার দেখুন মহান আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কোরআনে বলেছেনঃ

অতএব জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস কর, যদি তোমাদের জানা না থাকে; (An-Nahl: 43)
অতএব তোমরা যদি না জান তবে যারা স্মরণ রাখে তাদেরকে জিজ্ঞেস কর। (Al-Anbiyaa: 7)

এবার মহান আল্লাহ তা’আলার কথা শুনে নিচে শবে বরাত সম্পর্কে বিভিন্ন ওলামায়ে কেরামদের মতামত তুলে ধরা হলঃ

(১) শায়েখ মতিউর রহমান মাদানীঃ
https://www.youtube.com/watch?v=QPcpY2j0xh4

(২) তারেক মুনাওয়ারঃ
https://www.youtube.com/watch?v=17nod6XowV0

(৩) ডঃ মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহঃ
https://www.youtube.com/watch?v=ry2obn8wZuU

(৪) মুফতী কাজী ইব্রহীমঃ
https://www.youtube.com/watch?v=Ob3TsxatyzM

(৫) শায়খ কামালুদ্দীন জাফরীঃ
https://www.youtube.com/watch?v=ekyr95E_1pc

উপরুক্ত সকল আলোচনা থেকে নিন্মক্ত সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়ঃ

(১) পবিত্র কোরআনে শবে বরাতের কোন উল্লেখ নেই;
(২) কোন সহীহ হাদীসেও এর কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না;
(৩) এ রাতের ফযীলত সংক্রান্ত প্রায় সকল হাদীস এবং এ রাতের এবাদাত সংক্রান্ত সকল হাদীস জাল ও বানোয়াট;
(৪) ”এ রাতে আল্লাহ তা’আলা মুশরিক ও বিদ্বেষী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন” এ মর্মে বর্ণিত সকল হাদীসের সনদ দুর্বল হওয়া সত্তেও, আট জন সাহাবী কর্তৃক বর্ণনা ও নাসিরুদ্দীন আল বানীর হাদীসটি গ্রহনের কারনে তা সামগ্রিক ভাবে হাসান পর্যায়ের ধরা হয় । তবুও এ হাদীসে কোথাও এ রাত্রিতে বিশেষ কোন এবাদাতের কথা বলা হয় নি । শুধুমাত্র মুশরিক ও বিদ্বেষী না হলেই সে ক্ষমা পাবে ।
(৫) হাসান হাদীস আমলযোগ্য । তাই উক্ত হাদীসের কারনে যদি কেউ এ রাতের ফযীলতে বিশ্বাস করেন তবে তিনি অধিক সওয়াব পাবেন, এমনটি নয় । আবার বিশ্বাস না করলে গোনাহগার হবেন এমনটি ভাবারও কোন সুযোগ নেই ।
(৬) অধিক সওয়াবের নিয়্যেতে বা এ রাতের ফযীলতের কারনে এ রাতকে কেন্দ্র করে সকল এবাদাত তথা নামায, রোজা, জিকর, মোনাজাত ইত্যাদি এবং বিশেষ খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন এ সবই বিদ’আত ।
(৭) এ রাতের ফযীলতের কারনে আপনি এমন কিছু করতে পারেন না যা বিদ’আতের অন্তর্ভুক্ত । এ রাতে বিশ্বাস করলে আপনি অধিক সওয়াব পাবেন না, আবার না বিশ্বাস করলেও কোন গোনাহ হবে না । শুধু মুশরিক ও বিদ্বেষী না হলে আল্লাহ আপনাকে এমনিই ক্ষমা করবেন। কিন্তু এ রাতের অতিশায্যে বিদ’আতী কর্মে লিপ্ত হলে আপনি পথভ্রষ্ট হবেন । কারন, মহানবী বলেছেন, সকল বিদ’আতই (আমলের ক্ষেত্রে) হল পথভ্রষ্টতা । আপনার পথই যদি আপনি হারিয়ে ফেলেন তবে কি হবে এত আমল দিয়ে ?
(৮) অনেক সাহাবী পরবর্তিতে বিদ’আতের ভয়ে অনেক হালাল কর্ম পরিহার করেছেন ।
(৯) এ রাতের ফযীলতে বিশ্বাস করেন কোন অসুবিধা নাই তবে অনুরোধ কোন ভাবেই বিদ’আতে লিপ্ত হয়েন না ।

ধৈর্য সহকারে লেখাটা পড়ার জন্য আপনাদের সকলকে অসংখ্য ধন্যবাদ । আশা করছি লেখাটির মাধ্যমে আপনাদের সকল সংশয় দূর করতে পেরেছি ।
ইসলামকে জানুন ও সঠিক আমল করুন । আল্লাহ তা’আলা আমাদের সকলকে বিদ’আত থেকে বাচার ও সঠিক আমল করার তৌফিক দিন – আমীন ।
আজকের মত এখানেই বিদায় নিচ্ছি, সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন ।

ধন্যবাদ

[নোটঃ এখানে শবে বরাত বলতে ”লাইলাতুল নিস্ফ মিন শাবান” কে বোঝানো হয়েছে]

Level 2

আমি মোঃ সিজার আহমেদ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 10 বছর 7 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 1 টি টিউন ও 3 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস

প্রথম টিউনটা এমন একটা টিউনই করলেন যার সাথে টেকটিউনসের কোন সম্পর্ক তো নাই ই বরং এটা সরাসরি নীতিমালার সর্বপ্রথম বাক্যটিকেই লংঘন করে।

যদি বলেন আপনি নীতিমালা লংঘন করেননি তবে কথা এদিক সেদিক না পেচাইয়া সরাসরি উত্তর দেন এই টিউনে বিজ্ঞান অথবা প্রযুক্তি বিষয়ক কি আছে?

    @শিহাব খান: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ শিহাব ভাই । আমার প্রথম টিউনে আপনিই প্রথম টিউমেন্ট করলেন। আমার মনে থাকবে।

    জ্বি ভাই আমি সরাসরি উত্তর দিচ্ছি, এই টিউনে আমি টেকটিউনস এর দুইটি নীতিমালা ভেঙ্গেছি । যথাঃ

    ১.০১ টেকটিউনসে প্রকাশিত সকল টিউন নৈতিক ও প্রযুক্তি সংক্রান্ত হতে হবে। সৃজনশীল, তথ্যবহুল ও মানসম্মত টিউনও টেকটিউনসে প্রধান্য পাবে।
    ১.২৬ ধর্ম, ধর্মগ্রন্থের বাণী ও সামাজিক প্রক্ষাপটকে আঘাত করে এমন কোন বিষয় নিয়ে টিউন করা যাবে না বা এধরনের লেখা, টিউনে থাকা যাবে না।

    আশ্চর্যের কথা আমার টিউনকে এখনো রিমুভ বা আমাকে অপসারন করা হয় নি। অারো আশ্চর্যের কথা এই দুটি নিয়ম ভঙ্গ করে এমন অসংখ্য টিউন আপনি টেকটিউনসে দেখতে পাবেন। যাদের টিউন আজ পর্যন্ত ডিলিট করা হয় নি বা তাদের কাউকেও অপসারন করা হয় নি। এসব টিউনের একটিও কি সম্মানিত Admine দের নজরে পড়ে নি। অবশ্যই পড়েছে। তবে বলতে পারবেন কেন সেগুলো ডিলিট করা হয় নি ?
    মূলত সেই টিউনগুলোই আমাকে আমার এই টিউনটি করতে উদ্বুগ্ধ করেছে।
    আমার মনে হয় টেকটিউনস এখন আর ছোট্টটি নেই। এর পরিসর অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন টেকটিউনস বলতে কেবল প্রযুক্তি নির্ভর লেখার স্থান বুঝায় না।
    ইনশাআল্লাহ’ এর নীতিমালাতেও পরিবর্তন আসবে।

    এরপরেও যদি শিহাব ভাই আপনার কোন আপত্তি থাকে আমাকে জানাবেন আমি নিজেই টিউনটি ডিলিট করে দেব।
    আবারো আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ।

      @মোঃ সিজার আহমেদ: আপনার সুন্দর সাবলীল সরাসরি উত্তর দেয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার এই টিউমেন্টটি থেকে অনেক পুরোনো টিউমেন্টারের অনেক কিছু শেখার আছে।

      // আশ্চর্যের কথা আমার টিউনকে এখনো রিমুভ বা আমাকে অপসারন করা হয় নি। অারো আশ্চর্যের কথা এই দুটি নিয়ম ভঙ্গ করে এমন অসংখ্য টিউন আপনি টেকটিউনসে দেখতে পাবেন। যাদের টিউন আজ পর্যন্ত ডিলিট করা হয় নি বা তাদের কাউকেও অপসারন করা হয় নি। //
      সেটা স্বীকার্য। কেন সেগুলো অপসারন করা হয় না তা আমারো বোধগম্য নয়। হয়ত সেটা মডারেটরদের অসচেতনতা বা অসাবধানতা। তবে কোনটিই যে ডিলিট করা হয় নি তা নয়, কিছু কিছু ডিলিট করা হয়েছে তবে তা অতি নগন্য সংখ্যায়।

      // মূলত সেই টিউনগুলোই আমাকে আমার এই টিউনটি করতে উদ্বুগ্ধ করেছে। //
      আপনাকে আর দোষারোপ করা সম্ভব নয়। টেকটিউনস যদি তাদের নীতিমালা বহির্ভুত টিউন বজায় রাখে তবে সেটার রেফারেন্সে আপনি আরেকটা করতে পারেন। আমি হয়ত বলতে পারি নীতিমালার লংঘন তবে সেটা কার্যকরী কিছুই হবেনা। টেকটিউনস ই সেই সুযোগ সেচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক আপনাকে দিয়েছে।

      // আমার মনে হয় টেকটিউনস এখন আর ছোট্টটি নেই। এর পরিসর অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন টেকটিউনস বলতে কেবল প্রযুক্তি নির্ভর লেখার স্থান বুঝায় না। //
      টেকটিউনসের পরিসর বৃদ্ধি পেলে সেটা আদৌ কতটুকু ভাল বা খারাপ হবে সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে যতদিন কর্তৃপক্ষ দাপ্তরিকভাবে ঘোষনা না দিচ্ছে ততদিন ‘এটা কেবল প্রযুক্তি নির্ভর স্থান নয়’ সেটা বলা সমীচীন হবে না।
      যতদিন নীতিমালা পরিবর্তিত না হচ্ছে ততদিন এখানে ভিন্ন বিষয়ের টিউনও মনে হয় থাকা টা শৃংখলার ব্যত্যয়।

      এই টিউমেন্টে কর্তৃপক্ষের জন্যও খুব গুরুত্বপূর্ন কিছু মেসেজ আছে। টিউনের বিষয়বস্তু বাদ দিয়ে আপনার এই টিউমেন্টের জন্যই এই টিউন থাকুক আমি চাই, অন্তত যতদিন এই মেসেজ কর্তৃপক্ষের কাছে না পৌছে।

        @শিহাব খান: অাপনাকে আবারো ধন্যবাদ শিহাব ভাই ।

        আসলে আমি টিউনার নতুন হলেও টেকটিউনসের ভিজিটর নতুন নই । গত ৩-৪ বছর আগের টেকটিউনস আর এখনকার টেকটিউনসের তুলনা যদি আকাশ আর মাটি দিই তবুও মনে হয় আমি ভুল করব না ।

        নিজের ক্ষোভ থেকেই বলছি, টেকটিউনসের নীতিমালা নিয়ে টিউনাররা যত বিচলিত টেকটিউনসের সম্মানিত অ্যাডমিন বৃন্দ তার বিন্দু মাত্রও নন । নীতিমালা নিয়ে আপনি-আমি কাদা ছুড়াছুড়ি করে মরি, কিন্তু যাদের হস্তক্ষেপ করার কথা তারা কিছুই করেন না । মাঝে মাঝে তারা কিছু পোষ্ট ডিলিট করে এটা জানান দিতে যে তারা এখোনো আছেন । সম্প্রতি স্প্যাম টিউনের সংখ্যা বেড়ে গেলে ও টেকটিউনসের র‌্যাঙ্ক নিচে নেমে আসলে তাদের টনক নড়ে । রেজিস্ট্রেশন বন্ধ করা হয় ।
        দেয়ালে পিঠ ঠেকলেই কেবল কেন বিকল্প চিন্তা করতে হবে ? তার আগে কেন নয় ?
        প্রথম থেকেই যদি স্মানিত অ্যাডমিন বৃন্দ আরো সতর্ক থাকতেন তবে আমার মনে হয় না যে, আমরা আমাদের আগের টেকটিউনসকে হারাতাম ।
        যাই হোক ভাই । এসব বলে এখোনো কোন লাভ নেই ।
        ভালো থাকবেন ।

বিজ্ঞান অথবা প্রযুক্তি বিষয়ক যদিও নাহইয়া থাকে তারপরেও আমার কাছে অনেক ভালো লাগছে

ধন্যবাদ ভাই এই রকম সুন্দর ভাবে উপস্তাপন করার জন্য
এই টিউন থেকে বাংলাদেশের সকল বিদাতিরা শিক্ষা নিবে আশা করি