আমাদের সকলেরই পুরাকীর্তি বা প্রত্নতত্ত্ব সম্পর্কে সবারই আগ্রহ রয়েছে। ছোট বেলা থেকেই আমরা সমাজ বইয়ে এইসব পুরাকীর্তি সম্পর্কে নানান তথ্য পেয়েছি। আবার আমরা অনেক সময় ঘুরতে, পিকনিক অথবা শিক্ষাসফরেও এই ধরনের ঐতিহাসিক স্থান সমূহে যাই।
মানুষের ইতিহাস জানার জন্য পুরাকীর্তির গুরুত্ব অপরিসীম। তবে ইতিহাসের এইসব জটিল বিষয় যাদের ভাল লাগে না তাদের কাছেও পুরাকীর্তি একটি আকর্ষনীয় বিষয়।
পুরাকীর্তি বলতে প্রাচীনকালের মানুষের সমাজ-সংস্কৃতি, জীবন ধারার বিভিন্ন পদ্ধতি, সভ্যতা জানতে সহায়ক এমন সব কীর্তিকে বোঝায়। পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের পর তারা সৃষ্টি করেছে জীবন যাত্রার প্রণালী, আচার-আচরণ, সৃষ্টি হয়েছে সভ্যতা। এর মধ্যে কিছু পুরাকীর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে আর কিছু রয়ে গেছে মানুষের দৃষ্টি অগোচরে। জাদুঘর এইসব পুরাকীর্তির আশ্রয়স্থল।
শ্রম ও ব্যয় সাধ্য দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুরাকীর্তি সংরক্ষণ করতে হয়। এখন বর্তমানে পুরাকীর্তি বিষয়ক একটি নতুন শাখা সৃষ্টি হয়েছে। প্রত্নতত্ত নামের এই শাখায় ইতিহাস, ভূগোল, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ের ব্যাপক প্রয়োগ ঘটেছে। নতুন তথাপি সমৃদ্ধ এই শাখার কল্যাণে মানব জাতির অজানা অনেক কিছু কালের গর্ভ থেকে মানেষের চোখের সামনে ধরা দিয়েছে।
আমরা সবাই কম-বেশি পৃথিবীর উল্লেখ্য যোগ্য পুরাকীর্তির সম্পর্কে জানি। মেসোপটেমিয়া, সিন্ধু সভ্যতা এইসব নাম আমাদের কাছে অতি পরিচিত। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না প্রত্নতত্তের বিষয়বিস্তু, প্রত্নতাত্তিক উদ্ধার কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন টেকনলোজি সম্পর্কে। চলুন দেখি ধ্বংস হওয়া সভ্যতা কিভাবে উদ্ধার করা হয়-
প্রত্নবস্তুকে প্রধানত তিনটি ভাগে বিভক্ত-
আর্টিফ্যাক্টস বলতে বোঝায় মানুষের তৈরি সেইসব জিনিস যা আকৃতিগত ভাবে কোন রূপ পরিবর্তন ছাড়াই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া যায়। যেমন-তীর-ধনুক, বিভিন্ন ধরনের পাত্র ইত্যাদি। যেমন-সুমেরিয়রা মাটির চাকতিতে অনেক কিছু লিখে রেখেছিল।
এই ধরনের পুরাকীর্তি প্রাকৃতিক ক্রিয়ার ফলে মানুষের প্রতিক্রিয়া বোঝা যায়। শস্যের বীজ, পশুর হাড় প্রভৃতি দেখে এই প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানা যায়।
অতীতকালে মানুষের তৈরি বড় আকারের নির্মাণ কাজ যা সহজে স্থানান্তর যোগ্য নয় তাই এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। যেমন-মিশরের পিরামিড, রোমানদের তৈরি নগর রক্ষা, সেচের খাল ইত্যাদি।
প্রত্নতাত্তিক ইতিহাস খুব বেশি পুরনো নয়। ১৮০০ শতকে এই বিদ্যা এক ধাপ এগিয়ে যায়। ১৮৫৯ সালে চার্লস ডারউইন “অরিজিনাল অফ স্পেসিস” নামের বই প্রকাশিত হওয়ার পর মানুষের অতীত ইতিহাস ও বিবর্তন সম্পর্কে জানার আগ্রহ বহু গুণে বেড়ে যায়। ১৯২২ সালে ইংরেজ প্রত্নতত্তবিদ হাওয়ার্ড কাটার মিশরের তুতেন খামুকের সমাধি আবিষ্কার করে পুরো পৃথিবীতে হৈ-চৈ ফেলে দেন। ১৯৪০ এর দশকে ইউলার্ড এফ লিবি নামের এক আমেরিকান রসায়নবিদ রেডিও কার্বণ পদ্ধতিতে সময় নির্ণয় কৌশল আবিষ্কার করে প্রত্নকীর্তির সময়কাল নির্ধারণের আধুনিক পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। প্রত্নকীর্তি আবিষ্কারের অনেক গুলো ধাপ রয়েছে। চলুন দেখি ধাপ গুলো-
যেখানে প্রত্নকীর্তি রয়েছে প্রথমে সেই জায়গা নির্বাচন করতে হবে। মাটির নিচে, গভীরে, পানির নিচেও প্রত্নকীর্তি থাকতে পারে। ১৮ মিটার গভীরতা পর্যন্ত সাধারণ মেটাল ডিটেকটরের মাধ্যমে ধাতব প্রত্নকীর্তি চিন্হিত করা যায়। এছাড়াও আরো অনেক পদ্ধতিতে প্রত্নকীর্তি সনাক্ত করা যায়।
পুরো প্রত্নস্থল ভালোভঅবে পর্যবেক্ষণ করে এর ছবি ও ম্যাফ তৈরি করা হয়। ভাল ফলাফলের জন্য নিখুঁত ভাবে সার্ভে করতে হয়।
খুবই যন্ত এবং সাবধানতার সাথে প্রন্তস্থল খনন করতে হবে। এলোপাথারি ভাবে যেখানে সেখানে খনন কাজ না চালিয়ে স্থানকে নির্দিষ্ট কেয়কটি অংশে ভাগ করে সুশৃঙ্খল ভাবে আলাদা আলাদা ভাবে খনন কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে ট্রাক্টর ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে আর্টিফ্যাক্ট সনাক্তকরণের জন্য তুলির মতো ছোট জিনিসের প্রয়োজন। আবার মাটিতে রয়েছে শস্য কণা সনাক্তকরণের জন্য রাসায়নিক পরীক্ষা করতে হয়। এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় আবহাওয়াবিদদের সাহায্য নেওয়া হয়।
পানির উপর থেকে শক্তিশালি ক্যামেরায় তোলা ছবি পর্যবেক্ষণ করে প্রাচীন নগর সহ নানান পুরাকীর্তি পাওয়া গেছে। আমরা অনেকেই এই দৃশ্য জনপ্রিয় মুভি টাইটানিকে দেখেছি নিশ্চয়ই। সাবমেরিনের মতো সমুদ্রযান থেকে তোলা ছবি এবং শব্দ তরঙ্গের প্রতিধ্বনি বিশ্লেষণ করে এই কাজকে আরোও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে।
যেকোন পুরাকীর্তি থেকে প্রত্নতত্ত পাওয়া গেলে এগুলোর শ্রেণীবদ্ধকরণ এবং মূল্যায়ন করা খুবই প্রয়োজন। আর্টিফ্যাক্ট শ্রেণীবদ্ধকরণের দুটি প্রধান পদ্ধতি হলো-
পুরাকীর্তির ব্যাহিক আকার-আকৃতি, ব্যবহারের ধরন, নির্মাণ সামগ্রী প্রভৃতি বিবেচনা করে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। যেমন-একই এলাকায় প্রাপ্ত একই ধরনের মৃৎপাত্রকে এই শ্রেণীভুক্ত করা হয়।
এই পদ্ধতিতে একই ধরনের জিনিসকে এক সারির আওতাভুক্ত। যেমন-একটি সময় কালের মৃৎপাত্র একটি বিশেষ সারির বা সিরিজের অন্তর্ভুক্ত। এক্ষেত্রে তারিখ নির্ধারণ গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
প্রত্নকীর্তির সময় নির্ধারণ:-সাধারণত দুটি পদ্ধতিতে প্রত্নকীর্তির সময় নির্ধারণ করা হয়।
কোন একটি বিশেষ বস্তু বিশেষের সাথে তুলনা করে যখন কোন প্রত্নবস্তুর সময়কাল নির্ধারণ করা হয় তাকে তাকে আপেক্ষিক ডেটিং বলে। যেমন-হাড়ের বয়সের সাথে তুলনা করে প্রত্নবস্তুর বয়স অনেক সময় নির্ধারণ করা হয়। হাড়ের ফ্লোরিন বয়স বারার সাথে সাথে কমতে থাকে। ফ্লোরিন মাপার মাধ্যমে হাড়ের নির্ণিত বয়সের সাথে তুলনা করে প্রত্নবস্তুর বয়স নির্ধারণ করা হয়।
যখন কোন প্রত্নবস্তুর বয়স সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করা হয় তখন তাই নিশ্চিত ডেটিং পদ্ধতি। যেকোন জীবিত বস্তুর জীবন কালে কার্বণ ১২ ও ১৪ অব্যাহতভাবে গ্রহণ করে। এই কার্বণ পরমানুকে রেডিও কার্বণ বলে।
নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে রেডিও কার্বণরে পরিবর্তন ঘটতে থাকে এবং নাইট্রোজেন পরমানুতে পরিবর্তন হয়। জীবদেহে রয়ে যাওয়া ১২ ও ১৪ এর রয়ে যাওয়া অনুপাত বিশ্লেষণ করে ৫০ হাজার বছর আগেকার নিদর্শনও সনাক্ত করা যায়। যদিও ৬০ হাজার বছর বছর আগেকার নিদর্শন সনাক্তকরণরে পদ্ধতি ইতিমধ্যে আবিষ্কৃত হয়েছে। এছাড়াও পটাসিয়াম আর্গন পদ্ধতিতেও সময়কাল নির্ধারণ করা যায়। পাথরের বয়স নির্ধারণে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
এছাড়াও গাছের ভেতরে প্রতি বছর সৃষ্টি হওয়া চক্র বা রিং-এর সংখ্যা গুণেও ডেনড্রোক্রোনোলজি পদ্ধতিতে প্রত্নবস্তুর বয়স নির্ধারণ করা হয়। ৮ হাজার রছর পুরোন কাঠের তৈরি সামগ্রীর বয়স নির্ধারণে এই পদ্ধতি বেশ সফল।
প্রত্নবস্তুকে ভাল ভাবে বিশ্লেষণ করে নানান ধরনের প্রত্নবস্তুর মধ্যে তুলনা করে ভূ-তত্ত, প্রকৌশল বিদ্যা, কৃষিবিজ্ঞান ইত্যাদি বিজ্ঞানের সাহায্যে মানুষের ইতিহাসের অনেক অজানা তথ্য প্রতিনিয়ত আবিষ্কৃত হচ্ছে।
প্রত্নতত্ত বা পুরাকীর্তির উপর আমার আগ্রহ অনেক ছোটবেলা থেকেই। আর সেই আগ্রহ থেকে এর উপর জানা বা পড়া বিভিন্ন তথ্য এই টিউনের মাধ্যমে শেয়ার করলাম। আশা করি টিউনটি সবারই ভালো লাগবে আর পুরাকীর্তির উপর একটি নতুন দৃষ্টি ভঙ্গি তৈরি হবে।
আমি ইয়াসিন আরাফাত। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 15 বছর 5 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 134 টি টিউন ও 406 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 4 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
এই তো শুরু পথ চলা.. চলছি আমি একলা.. অনেক কিছু আমার মাঝে.. সুযোগ পেলেই করে খেলা..
SIMPLY AWESOME