আধুনিক তরুণ প্রজন্মের বিশাল একটা অংশ এখন ফেসবুক ব্যবহার করে। প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে এই সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলোতে সবারই ব্যাপক পদসঞ্চালন। টুইটার ও ফেসবুকের মাধ্যমে ক্ষণিকের মাঝেই জেনে যাওয়া যায় সারা পৃথিবীর অনেক খবর। আন্তর্জাতিক সাংবাদিকগণ তাদের ব্যক্তিগত টুইটার অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে থাকেন খুবই নিয়মিভাবে। তেমনি সমস্ত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানও এখানে সংযুক্ত হয়েছে সহজেই মানুষের কাছে পৌছাতে, তাদের কাছে নিজেদের সেবা ও পণ্য সম্পর্কে জানিয়ে দেয়া, ভোক্তাদের কাছ থেকে ফিডব্যাক নেয়া এবং সেই অনুযায়ী ব্যবসার উৎপাদন বৃদ্ধি করার নজীর রয়েছে পর্যন্ত। শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী এবং খেলোয়ার ও অন্যান্য সেলিব্রিটিরাও তাদের ভক্তদের অনেক কাছে চলে যেতে ব্যবহার করে ফেসবুক, টুইটারসহ অন্যান্য সোশাল নেটওয়ার্ক।
এই লেখাতে আমি কেবল ফেসবুকের ভুল ব্যবহারের ফলে উদ্ভুত কিছু সমস্যার ব্যাপারে কথা বলবো, তাও আবার বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সাধারণ তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের ব্যবহারের মাঝে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টা নিয়ে। লেখাটা পড়ার সময় মাথায় রাখতে হবে, ফেসবুক ব্যবহারের সুস্থ সামাজিক নেটওয়ার্কিং-এর সমস্ত ভালো দিকগুলোকে হিসেবে রেখে কেবলমাত্র উদ্ভুত কিছু সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে।
ফেসবুক যখন শুরু ৪/৫ বছর আগে, তখন এই দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী খুব বেশি ছিলনা। মূলত আর্থিকভাবে সচ্ছল এবং শহরবাসীরাই ছিলো এই ফেসবুকের ব্যবহারকারী। ধীরে ধীরে এই সাইট জনপ্রিয় হতে থাকে সারা বিশের মতন বাংলাদেশেও। হবারই কথা, এখানে সময় কাটানো যায়, পুরোনো বন্ধুদেরকে নিমিষেই কাছে পাওয়া যায়, কথা বলা যায়, ছবি শেয়ার করা যায় - এখন যুক্ত হয়েছে ভিডিও চ্যাট। আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবদের কাছাকাছি পেতে এরকম ফেসবুক জনপ্রিয় হবারই কথা।
কিন্তু আমাদের দেশের যাবতীয় প্রজন্মের একটা বিস্তীর্ণ অংশ অশিক্ষিত/অল্পশিক্ষিত। তাই ফেসবুকে একাউন্ট না থাকাটা অনেকেই নিজের মান-ইজ্জতের হানিকর ভেবেও একটা একাউন্ট খুলেছেন এমন কথাও জানি।
বছরখানেক আগেও আমার এলাকার স্টুডিওতে ঝুলানো ছিল - "এখানে ফেসবুকের ছবি তোলা হয়"। বলাই বাহুল্য, এটা মূলত গার্মেন্টসে কর্মরত পুরুষ এবং মূলত নারীকর্মীদের সুবিধার্থে একটা ব্যবসায়ীক আয়োজন ছিল। একইভাবে, ওয়াইম্যাক্সের আগমনের পরে সাইবার ক্যাফেগুলো ব্যবসা আগের মতন জমজমাট করতে না পারায় তাদের দোকানেও দেখা যায় "এখানে ফেসবুক ইউজ করা যায়"।
আমি ফেসবুকের একদম প্রথম থেকেই ছিলাম, তখন আমার ইন্টারনেট কানেকশন ছিল। এই দীর্ঘ সময় একটা অভিজ্ঞতা হলো, এখন স্কুলের পিচ্চি পিচ্চি ছেলেমেয়েরাও নিয়মিত ফেসবুক ইউজ করে। আমার এক বন্ধুর ছোটবোন বছর খানেক আগে বেশি নিয়মিত ফেসবুকিং করত যার বয়স ছিল মাত্র ১১ বছর। এরকম আরো অজস্র উদাহরণ আছে। প্রযুক্তির কারণে শিশুরা স্কুলে যাবার আগেই এখন মোবাইলের সমস্ত ফাংশন প্রায় ঘেঁটে ফেলে - এটাও হয়ত অমনই একটা ব্যাপার।
সেদিন একজনের নামের উপরের লিঙ্কে ক্লিক করে তার প্রোফাইলে চলে গেলাম। সামনেই পেলাম তার সদ্য সব পেইজে লাইক দেয়া নামগুলো, একটা আমার পছন্দের পেইজ, তার পাশেই প্রেমপত্র নিয়ে একটা পেজ। সেখানেও ক্লিক করলাম.
আচ্ছা, এরপর?
ভয়াবহ রকমের খ্যাত, ফালতু একেকটা প্রেমের কথা, বীভৎস সব আধা-অশ্লীল, পূর্ণ অশ্লীল (সো কলড রোমান্টিক) ছবি, আর কে কে জেগে আছেন লাইক দিন, ভালো লাগলে শেয়ার করুন, লাইক দিন শেয়ার করুন টাইপের স্বাভাবিক ফেরিওয়ালাগিরি দেখলাম।
আমি আরো বেশি অবাক হলাম যখন দেখি ১০ হাজারের উপরে লাইক পেইজটাতে, তাতে প্রতিটি সুপার খ্যাত টিউনেই একশর উপরে লাইক দেয়া। অর্থাৎ এদের প্রতিটি পোস্টই ছড়িয়ে গেছে অজস্র ছেলেমেয়ের মাঝে!
ফেসবুকে প্রবল হিট খাওয়া নিম্নমানের বানান ভুল কাব্যের উদাহরণঃ
ভালোবাসি তোমার অভিমানী চোখ
ভালোবাসি তোমার অভিমানী মুখ
ভালোবাসি তোমার মায়াবী চুল
তোমাকে দেখলে ভুলে যায় অনেক ভুল.
তুমি আমার জিবনের সব
তুমি আমার সুখের করলব
ভাল লাগে তোমার মৃদু মৃদু হাসি
তাইতো তোমায় খুব ভালোবাসি.
[এই কবিতার সাথে অর্ধনগ্ন এক নারীর ছবি ও হাত ধরা ছেলে একটা]
মুগ্ধমাতাল পাঠকদের নিম্নমানের টিউমেন্টঃ."তোমাকে আমি এতটাই ভালোবাসি / এত সুন্দর ক্যানও? / জটিল কথা / খুব সুন্দর / জোওওস হইসে / বালো লাগচে ".
নিম্নমানের ভালোবাসার ফেরিওয়ালাদের নিয়ে কিছু ভাবনাঃ
আমার যেটা ভয় লাগে, সেইটা আমাদের এই তরুণ প্রজন্মকে নিয়েই। সারাদিন যদি এইসব ভুয়া ভালোবাসা আর প্রেমের ট্যাবলেট গিলে বসে থাকে, তবে মেয়েদের মোবাইলে প্রতিদিন অজস্র আজেবাজে ছেলের ফোন আসবেই। প্রতিটা ছেলে মেয়েদেরকে জুলিয়েট মনে করে প্রেম নিবেদন করবে। প্রেম ছাড়া পেটের ভাত হজম হবেনা। 'বাংলাদেশী গ্ল্যামারাস মডেল' পেইজে প্রতি ছবিতে শত-সহস্র লাইক পড়বেই। চোখের পাপ, মনের পাপের বিশাল দুয়ার উন্মোচিত।
এই দৃশ্যগুলো আমাদের পুরো দেশের একট রূপ তুলে ধরে। এই সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের ভাবতেই হবে। যদি দিনে একবেলা না খেয়েও থাকতে হয়, তবু এইসব নিয়ে ভাবতে হবে - যদি আমরা ভালো চাই আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের। সবাইকে বোকা-গাধা বানিয়ে ভোগবাদী সমাজের পণ্য আর ক্রেতা বানিয়ে মুনাফা লাভ করে কিছু ব্যবসায়ী - আবেগ আর কামনাকে পুঁজি করে তাদের এই ব্যবসা।
হায়! আমি বা আমরা নাহয় বেঁচে গেলাম কোনভাবে। অথচ আমার মতন হাজার হাজার ছেলেরা এই বিভ্রমেই দিনরাত পার করে দিচ্ছে। এই তারুণ্য আর যৌবনের ডাক খুবই অসহনীয় - কীভাবে ওরা আদৌ কোন শান্তির খোঁজ পাবে? ওদের কাছে কীভাবে যাবে মুক্তির পয়গাম?
নানাবিধ ক্ষতি:
১৮+ যৌনউদ্দীপনার সূত্রপাতঃ
একদিন ভুলে ১৮+ পেইজে গিয়েছিলাম। এরকম প্রচুর অশ্লীল পেইজ রয়েছে, যারা যৌনাবেদনময় ছবি প্রচার করে তাদের নাম ফেরি করে। "এই মেয়েটাকে হট লাগলে কয়টা লাইক?" অথবা, "এরকম হট মেয়েদের ছবি পেতে ক্লিক করুন" টাইপের কথা বলে তারা ছড়িয়ে যাচ্ছে নিস্পাপ সম্ভাবনাময় তরুণ প্রজন্মের কাছে। পর্ণোগ্রাফির পিপাসাকে নিবৃত্ত করতে এরা সাহায্য করছে। অনেক ক্ষেত্রে হয়ত এদের কাছ থেকেই হাতেখড়ি হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের ধ্বংসযজ্ঞ। আমাদের নেই নীতিমালা, নেই পারিবারিক মোটিভেশন, প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রেও পর্ণোগ্রাফি, অশ্লীলতা নিয়ে কোন শিক্ষা নেই। ধর্মীয় চেতনাও হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত নতুন প্রজন্মের কাছে। এক কঠিন সামাজিক ক্ষয়ের দিকে আগাচ্ছে আমাদের গোটা জাতি।
যাদের নিয়ে আমি চিন্তিতঃ মুসলিমবোধ সম্পন্ন তরুণসমাজ?
ফেসবুকে আমি প্রায়ই চমকে গিয়ে ধাক্কা খাই আমি। দেখা গেলো, হয়ত কারো প্রোফাইলে গেলাম, সেখানে কুরআনের আয়াত বা হাদিস লেখা ছবি ঝুলছে (যাচ্ছেতাই ফন্ট ও রঙ সেইসব ছবির). তার ঠিক নিচেই বলিউডের নায়িকার অর্ধনগ্ন ছবি, অথবা ছবিতে রোমান্টিক দৃশ্য একটা ছেলে বা মেয়ের, তার নিচে সস্তা ক্যাপশন এই টাইপের - "সম্পর্ক হলো বিশ্বাসের"। এই ক্যাপশনের *সত্যতা* দেখে বিমুগ্ধ হয়ে মুসলিম ভাইটি বা বোনটি তা শেয়ার করে দিলেন। সম্পর্ক নিয়ে এরকম কথা জেনে, প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে টিপিক্যাল কিছু মিষ্টি কথা পড়ে ক্ষণিকের জন্য হলেও ভুলে গেলেন আল্লাহর কথা, তার নির্দেশনার কথা। অথবা ওয়েডিং সিরোমোনিতে বসে থাকা কোন এক বউয়ের আকর্ষণীয় ছবি, বন্ধুদের আড্ডাতে ছেলেমেয়েরা হাত ধরাধরি করে বসে থাকা ছবি (বিভিন্ন পেইজে এসব শেয়ার করা হয়), যার অধিকাংশই ভাইদের মাঝে একাকীত্বের অনুভূতি জাগায়, পাপের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়, যা পদস্খলনের প্রথম ধাপ।
এইসব প্রসঙ্গে আল্লাহ আমাদের বলেছেনঃ
♥ "…নির্লজ্জতার কাছেও যেয়ো না, প্রকাশ্য হোক কিংবা অপ্রকাশ্য…"[সূরা আনআম - ১৫১]
♥ "যারা পছন্দ করে যে, ঈমানদারদের মধ্যে ব্যভিচার প্রসার লাভ করুক, তাদের জন্যে ইহাকাল ও পরকালে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে…" [আন নূর :১৯]
♥ "মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গর হেফাযত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে… " — [সূরা আন নূর :৩০]
♥ "আমি মানুষ সৃষ্টি করেছি এবং তার মন নিভৃতে যে কুচিন্তা করে, সে সম্বন্ধেও আমি অবগত আছি। …" [সূরা ক্বাফ -১৬]
দিগ্বিদিগ জ্ঞানশূণ্য টিপিক্যাল মডারেট মুসলিমের অন্তরকে ধারণ করে ছিলাম অনেক বছর। আমি জানি, যতক্ষণ না পর্যন্ত নিজেকে অশ্লীল দৃশ্য থেকে সম্পূর্ণরূপে নিজেকে রক্ষা করতে নিয়াত করেছিলাম, কখনই আল্লাহর অনুভবের প্রশান্তি অর্জন করতে পারিনি একটুও। যখনই নির্লজ্জ অপছন্দনীয় কোন কিছুতে জড়িয়ে পড়ি, অন্তরের শান্তি হারিয়ে যায়, আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল হয়ে যাই। এইটা খুব খারাপ জিনিস, খুব খারাপ। আর খুব বেশি সাবধান থাকার মতন একটা বিষয়। নিজের গায়ে একটা ছুরির আঘাত আসাকে অনুমুতি দেয়াও এর চাইতে কম ক্ষতিকর বলে আমার অনুভব হয়।
চোখ হলো মনের দরজা, চোখ দিয়ে দেখি আর অন্তরে আমরা অনুভব করি, তাকে ধারণ করি। যেই চোখ দিয়ে আপনি অশ্লীল ও নোংরা জিনিস দেখছেন, আপনি কীভাবে আশা করেন সেই অন্তরে আল্লাহ রব্বুল আলামীনকে ধারণ করতে পারবেন। আল্লাহ হলেন মহাপবিত্র, মহাসুন্দর, মহামহিম।
একজন মুসলিম কখনই নিজেকে প্রশ্রয় দিবেনা এমন কোন দৃশ্য, মূহুর্ত, ঘটনা সামনে আশাকরিয়ে দিবে, ফলশ্রুতিতে তা আমাদের জীবনে অপূরণীয় ক্ষতিই বয়ে আনবে। কোন পাপকেই ছোট মনে করা উচিত নয়।
আমি রবিক লকুফিশ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 7 বছর 6 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 3 টি টিউন ও 0 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 2 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
Sorry to say, it’s not a religious blog.