ভিক্ষা

টিউন বিভাগ জীবনী
প্রকাশিত

অনেক দিন লেখালেখি করি না। সাধারণত ডায়েরি লেখা পড়ে মাঝে মধ্যে। আর ইদানিং বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া apps বের হওয়ায়, হাতে লেখা ডায়েরির মূল্য বেশি একটা থাকে না। ভাবলাম দেশে যখন বাংলায় একটা ওয়েবসাইট আছেই, সেখানে কিছু লিখি। ব্যস, যেমন ভাবা তেমন কাজ। একাউন্ট খুলে লেখা শুরু করে দিলাম।

আজকে যে ঘটনাটা নিয়ে লিখবো, সেটা সামাজিক আর অর্থনৈতিক একটা গ্যাড়াকলের ঘটনা। আমাদের নিত্যদিনের ঘটনা। একটা ভিক্ষুকের ঘটনা। হাসি পাচ্ছে? বিরক্ত হচ্ছেন? স্বাভাবিক।  আমিও তো হই এসব দেখলে, আপনার আর দোষ কি! কিন্তু জানেন, না বলে না, শান্তি পাচ্ছি না। শুরু করে দিলাম কাহিনীটা। কাহিনীটার শুরু থেকেই বলবো, এমনকি আমি কাহিনীর সাথে জড়ানোর আগের কথাও বলবো। শুরু করা যাক-

সোনাডাঙা (খুলনা) বা ডালমিলের (খুলনা) কোনো বস্তি এলাকার সবচেয়ে বাজে আর সস্তা একটা ঘরে থাকে এক দরিদ্র পরিবার। স্বামী স্ত্রী আর দুই কন্যা। স্বামী রিকশাওয়ালা অথবা সাধারণ কোনো চা ফেরিওয়ালা অথবা পঙ্গু কোনো মানুষ। আমি হয়ত জানি না। স্ত্রীটি নিউমার্কেট বা ময়লাপোতা এলাকায় ফুটপাথে বসে থাকা এক ভিক্ষুক। বোরকা পরেন, চলাচল করা মানুষগুলোর দিকে হাত বাড়িয়ে ধরেন আর বলেন, "কিছু দিয়ে যান, ভাই", "আপা, খাই নাই এখনো", "কাকা, কয়ডা টাকা দ্যান"। কেউ দেয়, কেউ বিরক্ত হয়, কেউ মৌন থাকে, কেউ দেয় গালি। তার মানে, মানুষের সবগুলো অভিব্যক্তির সাথে তিনি কমবেশি পরিচিত। এভাবেই দিন চলে, খেয়ে বা না খেয়ে। দিনশেষে তাকে দেখা যায় একটা ফুটো থালায় মোটা চালের ভাত আর সকালের বাসি তরকারি দিয়ে লোকমা তুলছে মলিন মুখে। পাশে আসন গেড়ে পথের ধুলাতেই বসে গেছে দুই শিশু কন্যা। একজন ৪ বছর, আরেকটি সবে ২ কি ৩ বছরের। শরীর ঢাকতে যেটুকু আবরণ দরকার, শিশু দুটোর গায়ে সেটুকুই আছে। মা নিজে এক লোকমা তুলছে মুখে, পরের দুই লোকমা ভাগ পাচ্ছে শিশুরা। আনন্দের সাথেই খায় তারা। মাঝে মাঝে বড় বড় বাস বা ট্রাকের শব্দে ঘাড় ফেরায়। গালের একপাশ ফুলে আছে, চাবাতে চাবাতেই ময়লা হাতের চেটো দিয়ে ঠোঁটের কোণায় লেগে থাকা ভাত সরায়। কেমন যেন একটা গা ঘিনঘিনে ব্যাপার।

সন্ধ্যা নামার অনেক পরে তারা ঘরে ফেরে। কখনো দিনশেষে ৫০০ টাকাও হয়, কখনো ১০০। বোন দুইটি চঞ্চল প্রকৃতির আর ছেড়া দুটো পুতুল নিয়ে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত খুনসুটি করতে থাকে। ছোটটা বেশি দুষ্টু আর মনে হয় একটু হিংসুটেও। বড় বোন নরম বলে মাঝে মাঝে তার চুলে টান পড়ে, পুতুল মার খায়, খাটের নিচে লুকিয়ে রাখা হয়। বাল্যকালে আমরাই কত কিই না করতাম। তাদের আর কি দোষ!

শুক্রবার সব ভিক্ষুকদের একটা সৌভাগ্যের দিন। জুমার নামাজ শেষে মসজিদের বাইরে বসলেই দুই তিন দিনের টাকা উঠে যায় ১/২ ঘন্টায়। ভিক্ষুক কেন, আপনি আমিও যদি ছেড়া জামা আর পুরোনো লুঙ্গি পরে উষ্কখুষ্ক চুলে মসজিদের বাইরে হাত পেতে বসি; কম করে হলেও ১০০ টাকা নিয়ে ফিরতে পারবো। বেশি কত পাবো, তা আর নাহয় নাই বলি। আর ঢাকার কোনো মসজিদ হলে তো কথাই নেই।

কিন্তু, সবাই মসজিদের বাইরে বসতে পারে না। ভিক্ষুকদের একটা সংস্থা আছে, বা কমিউনিটি। তারা এরিয়া সিলেক্ট করে দেয় আর সিলেক্টেড ভিক্ষুকরাই সেখানে পজিশন পায়। আউটসাইডার কেউ এলে তাকে গালি দিয়ে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়, কখনো মারপিট করে তাড়ানো হয়।

আজ শুক্রবার। ময়লাপোতা (খুলনা) এরিয়ায় আমাদের গল্পের ভিক্ষুকটি রাস্তায় বসে বেশি রোজগার করতে পারবে না। হাসপাতাল অর্ধ-বন্ধ থাকে, ভিজিটর বেশি আসেও না। এদিকে নতুন ভিক্ষুক হওয়ায় কোনো মসজিদের সামনে ওই নোংরা বাচ্চাদুটো নিয়ে বসাও যাবে না। কমিউনিটি ফ্যাক্ট। অগত্যা.শুরু হলো হাটা। শিশুদুটি আগে কখনো বাড়ি বাড়ি যায়নি। নতুন অভিজ্ঞতা হবে তাদের আজ। সেজন্যই বোধহয় বড়টি গম্ভীর, ছোটটি ব্যাপক উৎসাহিত। বড়লোক বাড়িওয়ালা গুলোকে আজ হয়ত দেখা যাবে। নাদুসনুদুস বড়লোকের বাচ্চাগুলো পুতুলের মত ফর্সা হয়। তাদের হাটাচলা দেখেই ক্ষুধা মিটে যায়, খিদেও লাগে না। দুপুরের রোদে এই অবুঝ শিশুদুটি হাটতে থাকে মায়ের সাথে।

- আচ্ছা আম্মু, আমরা ওই বাড়িগুলোতে যায়ে কি করবো? কি বলবো?

- সালাম দিবা। আর হাসবা। যদি তাড়ায়েও দেয়, রাগ হবা না। কাদবাও না। হাসবা।

- যদি মারে? কানবো না?

- মারবে ক্যান? মারবে না। কোনো কিছুতে হাত দিবা না।

- আসসা। সালাম পারি না।

- এত কথা বলতি হয় না। জুই তো কিছু কচ্ছে না, তুই এত কথা কচ্ছিস ক্যান? চুপ কইরে হাট।

বড়টির নাম সম্ভবত জুই। সে তাকিয়ে থাকে দারাজের ডেলিভারি পয়েন্টের নিচতলার টিভি শোরুমে চলতে থাকা বিশাল স্ক্রিনের টিভির দিকে। তাদের ঘরে টিভি নাই, বাড়িওয়ালার বাসায় আছে, তাও এত বড় না। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে হাটতে হাটতে হোচট খায় জুই। মা ধরে ফেলে আর শক্ত ফুটপাথে উলটে পড়া থেকে বেচে যায় মেয়েটা। একটা হালকার উপর ঝাপসা ঝাড়ি খেয়ে বাকি পথ হাটতে থাকে তারা।

আমি জুমার নামাজ শেষে ভাই আর মায়ের সাথে গরুর গোশ আর ভাত খেয়ে সবে উঠেছি। ইন্টারন্যাশনাল জব আমার, তাই রবিবার ছুটি। শুক্রবার অফিসে যাই এই দুপুরের খাওয়া শেষে। হাত মুখ ধুয়ে রেডি হলাম, সব গোছগাছ করে বেরোবো। এমন সময়ে নিচে থেকে আওয়াজ আসে, "মা, কয়টা ভাত দেবেন?" বাড়িতে উপরতলায় মিস্ত্রি কাজ করছে। সেই শব্দে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে দূর্বল কন্ঠটা। কম করে হলেও ৫/৬ বার ডেকে ভিক্ষুক চলে যায়। আমি সিড়ি দিয়ে নেমে গেটের কাছে এসে দেখি দুটো শিশু। এরকম বাহারি গেট তারা দেখেনি। ছোটটা বড়টাকে ভিতরে মানে আমাদের নিচের বারান্দায় রেখে বাইরে দিয়ে গেট চেপে রেখেছে। একবার উঁকি দিলো, আমাকে দেখলো। লজ্জা পেল মনে হয়, আবার কেমন যেন সাহসও পেল। তাই বিড়বিড় করে বলতে লাগলো, "আয় তোরে আটকায় দি। আসতি পারবি না"। বড়টা কথা কম বলে আর সেভাবেই একটু ভীত হয়ে বলতে থাকে, "আটকাস না, মারবে কিন্তু। " ছোটটা আবার ভিতরে ঢোকে আর পাশের কোনো বাসা থেকে তাদের মায়ের ডাক শোনা যায়, "কই, আয়। আসলি না!"

আমি গেটের কাছে এসে হঠাৎ একটা ধাক্কা খাই মনের মধ্যে। একটা শিশু এপাশে, আরেকটা ওপাশে। ছোটটা দুষ্টু হলেও ভারী মায়াবী চোখ। আমি আস্তে করে দুজনকে বাইরে এনে গেটের হ্যানডেল ঘুরিয়ে দেই। ও পর্যন্ত হাত যাওয়ার উচ্চতা শিশুদুটির হয়নি। ওদের কাছে গেটের ডিজাইনটা এতই ভালো লেগেছে যে, গেটের দিকেই তাকিয়ে থাকে তারা। আরেকবার আমার দিকেও তাকায়।

অফিসে যাওয়ার সারাটা পথ আমাকে খুব নাড়া দিয়েছে শিশুদুটি। তাদের দূর্বল মা ভরদুপুরে ভদ্রলোকদের পাড়ায় এসে খাবার চাচ্ছে। মাংসের গন্ধ সব বাড়িতেই। কেউ হয়ত খেতে বসেছে, কেউ খেয়ে বিশ্রামে গেছে, কেউ খাওয়ার অর্ধপথে। আমি শিওর, এই ভিক্ষুক মা আর তার বাচ্চাদুটি আজকে ভাত পেলেও কোনো মাংস পায়নি। অনেক আশা করে বড়লোকদের এলাকায় এসেও ভাত আর সকালের ভাজিভুজি নিয়ে যেতে হয়েছে হয়ত। কিন্তু somehow আমি বাচ্চাদুটির গেট নিয়ে খেলা করার scene টা ভুলতে পারছি না। গেটের বাইরে আসার পরে তাদের সাময়িক চুপ থাকাও নাড়া দিচ্ছে। কারণ আমি ভাল করেই বুঝতে পারছি যে তারা হয়ত ভয়ে চুপ করে ছিল, পাছে যদি ঝাড়ি দেই। অবুঝ ছোট মেয়েটি হয়ত মানুষের উগ্রতা অতটা দেখেনি এখনো, তাই আমার দিকে তাকিয়ে ফ্যালফ্যাল করে হেসেছিল! আমার বাল্যকালে এ ধরনের কোনো নেগেটিভ স্মৃতি আছে কিনা, তাও মনে করতে পারছি না।

নাকি এটা আমাদের পুরুষ জাতের একটা সমস্যা? শিশুদের দেখলে কেমন জানি একটা পিতৃত্বের ভাব জেগে ওঠে- মায়ায়। যেমন হয়েছিল আদম আঃ এর, দাউদ আঃ কে দেখে। এজন্য নিজের ১০০০ বছর বয়স থেকে ৪০ বছর দিয়েও দিয়েছিলেন দাউদ আঃ কে। স্নেহ, কখন কিভাবে আপনার মধ্যে উদয় হবে, নিজেও টের পাবেন না। হয়ত এরকম শিশু দুটোর মত আমারও ফুটফুটে দুটো বাচ্চা থাকার কথা ছিল! হয়ত সেই স্নেহই আমাকে বারবার নাড়া দিচ্ছে। আমি রাস্তার মাথায় গিয়ে পিছনে ফিরলাম- বাচ্চা দুটোকে দেখিনি। হয়ত মায়ের বকুনি খেয়ে আরেক বাড়িতে গিয়েছে। কিংবা, রাস্তায় আর কোনো লোক না থাকায়, disappear হয়ে গিয়েছে।

উপরওয়ালা মাঝে মধ্যে আমাদের পরীক্ষা নেন। বড় বড় সিলেবাসের পরীক্ষার মধ্যে অন্যতম হলো- দানের পরীক্ষা। সুপাত্রে দান করছেন নাকি অপাত্রে- সেটাও একটা সিলেবাস। শিশুরা Angel টাইপ হয়- সব ধর্মেই বলা আছে। আর এঞ্জেলরা মাঝে মাঝেই পৃথিবীর মানুষগুলোকে দেখতে আসে, বুঝতে আসে, পরোক্ষভাবে বোঝাতে আসে নৈতিকতা।

আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি ভিক্ষুক মহিলাটিকে। আজ হয়ত দান করতে পারিনি, ভাত দিতে পারিনি। কিন্তু যদি কখনো খুঁজে পাই; নিরাশ করবো না, ইনশাল্লাহ। শিশুদের ভালবাসুন, তাদের দুষ্টুমিগুলো নিজের বাল্যকালের দুষ্টুমির সাথে কাটাকাটি করে নিন। দেখবেন, রাগবেন না। একটা প্রশান্তিময় হাসিতে ছেয়ে যাবে আপনার মুখ, অজান্তেই।

 

Level 0

আমি বনি আমিন। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 1 বছর 3 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 1 টি টিউন ও 0 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস