বিজ্ঞানের বিস্ময়-পুরুষ: নিকোলা টেসলা ভুলে যাওয়া এক ক্ষণজন্মা প্রতিভা

টিউন বিভাগ জীবনী
প্রকাশিত

জন্ম হয়েছিল খারাপ আবহাওয়ার এক অন্ধকার রাতে, তাই মানুষ ব্যাঙ্গ করে বলত "চাইল্ড অব ডার্কনেস"

 কিন্তু তার আশীর্বাদী মা বলেছিলেন আমার ছেলে "চাইল্ড অব লাইট"। আর সত্যিকার অর্থেও তিনি ছিলেন একজন সুপার হিউম্যান। তার মেধা ও যোগ্যতা আইন্সটাইন থেকে কোন অংশে কম ছিল না। কিন্তু বিস্ময়কর এই প্রতিভাবান মানুষটি থেকে গেছেন একরকম আড়ালেই। আজ আমরা জানব বিজ্ঞানের গতি বদলে দেওয়া বিস্ময়পুরুষ নিকোলা টেসলা সম্পর্কে।

 নিকোলা টেসলা ১০ জুলাই ১৮৫৬ সালে বর্তমান ক্রোয়েশিয়ায় জন্ম গ্রহণ করেন। শিক্ষাজীবনের শুরুর দিকে বেশ সফল ছিলেন তিনি। ১৮৬১ সালে একটি প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন টেসলা। সেখানে তিনি গণিত, জার্মান ভাষা ও ধর্মতত্ত্ব নিয়ে পড়তে শুরু করলেন। তিনি এতটাই বিস্ময় বালক ছিলেন যে স্কুলে থাকাকালীন সময়েই জটিল সব অংকের উত্তর মুখে মুখে বলে দিতে পারতেন। এমনকি উচ্চ মাধ্যমিকের চার বছরের কোর্স তিনি তিন বছরেই শেষ করেছিলেন।

 নিকোলা টেসলা মানেই বিস্ময়কর চিন্তা আর রহস্যময় এক্সপেরিমেন্ট।

 তার জীবন নানা রহস্য আর ঘটনায় ভরপুর। ১৮৭৪ সালে আর্মিতে ভর্তি হওয়া থেকে বাঁচতে পালিয়ে যান টেসলা। সেই সময়ে পাহাড় আর জঙ্গলে কেটেছে তার দিনগুলো। একাকী সেই সময়ে পড়তে ভালোবাসতেন মার্ক টোয়েনের লেখা।

 ১৮৭৫ সালে টেসলা যেন নিজের আসল জায়গায় বিচরণ শুরু করলেন। ভর্তি হলেন অস্ট্রিয়ার একটি পলিটেকনিকে। সেখানে প্রথম বর্ষে সর্বোচ্চ নাম্বার ও পান টেসলা। কিন্তু বিধীবাম। পরে জুয়ায় আসক্ত হয়ে শেষ হয় তার একাডেমিক ক্যারিয়ার।

 ১৮৮১ সালে হাঙ্গেরিতে পাড়ি জমান টেসলা।

সেখানে একটি টেলিগ্রাম কোম্পানিতে কাজ শুরু করেন তিনি। সে সময় টেলিফোন এম্পলিফায়ারের অনেক উন্নতি সাধন করেন টেসলা। তার এসব কাজে অভিভূত হয়ে সেখান থেকে একটি চিঠি দিয়ে তাকে বলা হয় টমাস আলভা এডিসনের সাথে দেখা করে চিঠিটা পৌঁছে  দিতে। তাতে লেখা ছিল "আমি পৃথিবীতে দুজন মহাজ্ঞানী মানুষকে চিনি যার একজন তুমি আর ওপর জন যে তোমার সামনে দাড়িয়ে আছে। " সেই থেকে টমাস আলভা এডিসনের সাথে কাজ শুরু করেন টেসলা। সময়টা ছিল ১৮৮৪। এডিসন তাকে ডিসি জেনারেটরের পুণরায় ডিজাইন করতে বলেন। বিনিময়ে ৫০ হাজার ডলার পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দেন। অক্লান্ত পরিশ্রম করে টেসলা সফল ভাবে সেই কাজ করেও দেন। কিন্তু বেঈমানী করেন এডিসন। তিনি বলেন, "আরে তুমি তো দেখি রসিকতাও বুঝ না। " পরে এডিসন টেসলাকে সাপ্তাহিক বেতন ১০ ডলার থেকে ১৮ ডলার করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু এই ৮ ডলারের সাপ্তাহিক বেতন বৃদ্ধির চাটুকারিতা প্রত্যাখ্যান করেন টেসলা। আর ছেড়ে দেন এডিসন ক্লাব।

 এডিসন ক্লাব ছাড়ার পর ১৮৮৬ সালে টেসলা রবার্ট লেন ও বেঞ্জামিন ডালে নামক দুইজন ব্যাবসায়ীর সাথে যোগ দেন টেসলা। এই দুই ব্যাবসায়ী টেসলাকে তড়িৎ বাল্ব ও কারখানা নির্মানে আর্থিক সহায়তা করতে সম্মত হন। আলোর ব্যবহারের নকশার উপর ভিত্তি করে টেসলা সর্বপ্রথম তৈরি করেন বৈদ্যুতিক বাল্ব। একই সময়ে তিনি ডাইনামিক যন্ত্রের ডিজাইন ও করেছিলেন। এটা আবার ছিল আমারিকার প্রথম ডিজাইন। কিন্তু নিকোলা টেসলার নতুন এই আবিষ্কারের প্রতি তেমন আগ্রহ দেখাননি বিনিয়োগকারীরা। এমনকি তারা টেসলাকে কোনরকম টাকা-পয়সা ছাড়াই বের করে দিতে চান। এভাবে টেসলা প্রায় সকল ক্ষমতাই হারাতে থাকেন কোম্পানি থেকে। এই সময়টাতে বড় বিপদে পরে যান টেসলা। কোনমতে তখন দিনপার করতে মাত্র ২ ডলারের বিনিময়ে তড়িৎ মেরামতের কাজ করতেন টেসলা।

টেসলা ১৮৮৬ সালের প্রায় শেষের দিকে  ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন এর নিয়ন্ত্রক আলফ্রেড ব্রাউন এবং নিউইয়র্কের এটর্নি চার্লস এফ পিক এর সাথে যোগাযোগ শুরু করেন। টেসলা তখন অল্টারনেটিং কারেন্ট বা চল বিদ্যুত নিয়ে কাজ শুরু করেন। তার এই কাজ ছিল সেই সময় হতে অনেক এগিয়ে। অনেকটা অবিকশিত ডিসি কারেন্ট যখন কিনা তাতে বিনিয়োগের অভাব নেই সেখানে অল্টারনেটিং কারেন্টের চিন্তা তো অনেক দুরে। অন্তত এডিসনের মতো স্বার্থন্বেষী মানুষের জন্য। এই বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার অনেক সুবিধা ছিল যা টেসলার মতো জিনিয়াস সময়ের অনেক আগেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।

অল্টারনেটিং কারেন্টের অন্যতম বড় সুবিধা হলো  এর মাধ্যমে শুধুমাত্র একটি পাওয়ার স্টেশন হতে  বহুদূর পর্যন্ত বিদ্যুৎ পৌঁছানো সম্ভব। কিন্তু ডিসির সমস্যা হলো কেবল ৮০০ মিটার ক্ষেত্রফলের  মধ্যেই এটি কাজ করতে পারতো। ফলে এসি মোটরের এই সুবিধা একে ক্রমেই জনপ্রিয় করে তুলল। এদিকে এসি মোটর জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় বিপাকে পরে যান এডিসন। কারণ তার ডিসি মোটির এক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে পড়েছিল। কিন্তু এতে অনেকটা উন্মাদের মতো আচরণ করেন এডিসন। তিনি জীবিত কুকুর, বিড়াল, খরগোশ এমনকি সারকাস থেকে হাতি আনিয়েও এগুলোকে অল্টারনেটিং কারেন্টের শক দিয়ে মারেন। তার এই উন্মাদ আচরণের শিকার হয়েছিল অবলা এই প্রাণী গুলো। যাইহোক সত্য কথা বলতে কি আজও ইতিহাসে এডিসন একজন কিংবদন্তি। কিন্তু টেসলা রয়ে গেছেন অনেক আড়ালেই।

টেসলা ছিলেন একজন মহান সাধক। তার প্রতিটি কাজের উদ্দেশ্যই ছিল মানব কল্যাণ। এডিসনের মতো ব্যাবসায়ীক ছলনায় ডুবে থাকতেন না টেসলা

কিন্তু এডিসন টেসলাকে নানা ভাবে খলনায়ক করে নিজেকে হিরো করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ জয়টা টেসলারই হচ্ছে। এখন ঘরে ঘরে অল্টারনেটিং কারেন্ট, আছে তড়িৎ বাতি, রিমোট কন্ট্রোল, রেডিও সহ আরও কত কি। এখানে হয়ত আপনি রেডিওর জন্য মার্কনীকে কৃতিত্ব দিবেন। কিন্তু মার্কনির অনেক আগেই টেসলা বেতার আবিষ্কার করেছিলেন। এখানে উল্লেখ করা জরুরি যে শুধু টেসলা নন বরং বাঙালি বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ও মার্কনীর অনেক আগেই বেতার আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু জগদীশ চন্দ্র বসু ও ছিলেন এক উদার মনের মানুষ। প্যাটেন্টের কথা চিন্তা না করে বিজ্ঞানের স্বার্থে আর মানব কল্যানের লক্ষ্যে এই বেতার কৌশল উন্মুক্ত করে দেন সকলের জন্য। যাইহোক, এছাড়া এর সাথে জড়িয়ে আছে ক্লার্ক ম্যাক্সয়েল, হেনরিখ হার্জের মতো জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের নাম। কিন্তু এক্ষেত্রে বেতারের সবচেয়ে সফল আবিষ্কারক কিন্তু টেসলাই। মার্কনী যে সিগন্যাল তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন তার দৌড় ছিল বাড়ির চিলেকোঠা পর্যন্তই। কিন্তু ১৮৯১ সালে টেসলার আবিস্কৃত বেতার তরঙ্গ সেকেন্ডে ১৫০০০ হাজার চক্র সম্পন্ন করতে পারত। আর তা তো হওয়ারই ছিল। কারণ এতে তিনি ব্যবহার করেছিলেন তারই আবিস্কৃত শক্তিশালী টেসলা কয়েল। মার্কনী প্রথম দিকে পেটেন্ট করতে গিয়ে অনেকটা অপমানিতই হয়েছিলেন। সালটা ছিল ১৯০০। কারণ তিনি টেসলার আবিস্কৃত মডেলটাই ব্যবহার করেছিলেন। সেটাকে তিনি নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছিলেন মাত্র। কিন্তু ১৯০৪ সালে ঠিকই পেটেন্ট নিজের করে নেন মার্কনী। ওই সময়কার কিছু লেখা থেকে জানা যায় যে কিছু প্রাভাবশালীদের সাথে তার উঠাবসা ছিল। আর তার ফল যা হবার তাই ই হয়েছে। ফলে টেসলা আবারও হারান তার অনবদ্য এক আবিষ্কারের স্বীকৃতি। অতএব শেষমেশ নামটা কামালেন মার্কিনী। আর নোবেল প্রাইজটাও গেল তার পকেটে।
 
কিন্তু পরে আবার ১৯৪৩ সালেই আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট রেডিওর পেটেন্টে ইতালিয়ান বিজ্ঞানী মার্কনি’র নাম বাতিল করে দিয়ে নিকোলা টেসলার নাম ঘোষণা করেছিলো। কিন্তু ততদিনে নিকোলা টেসলা মৃত।

এদিকে এই সময়টাতেও টেসলা কিন্তু মানব কল্যাণে ঠিকই নিয়োজিত আছেন। এসময় ওস্টিংহাউজ কোম্পানির সাথে সাশ্রয়ীভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কাজ করছিলেন টেসলা। তার হাত ধরেই সর্বপ্রথম জলবিদ্যুতের মতো সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনের পথে হাটতে শুরু করে মানবজাতি। তিনিই প্রথম নায়াগ্রা জলপ্রপাতের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম হন। কিন্তু এক্ষেত্রে ও টেসলা তার প্রাপ্য সম্মান পাননি। এডিসনের প্রতারণার পর টেসলা যোগ দিয়েছিলেন ওয়েস্টিংহাউজ কোম্পানিতে। কিন্তু ব্যাবসায়ী হিসেবে অপরিপক্ক টেসলা তার বিস্ময়কর মেধার যথাযথ মূল্যায়ন পাননি। বরং টেসলার মেধা বিক্রি করে নাম কামিয়ে নেন ওস্টিংহাউজ। আর টেসলা থেকে গেলেন সেই আড়ালেই। কেবল এডিসন, মার্কনী বা ওয়েস্টিংহাউজ ই নন টেসলার অনেক বিস্ময়কর আবিষ্কারই হয় চুরি করা হয়েছে কিংবা নামে মাত্র বিজ্ঞানীদের হাতে চলে গেছে। তাদের ব্যাপারে টেসলার বিখ্যাত উক্তিটি হলো "তারা আমার আইডিয়া চুরি করলো কি করলো না তাই নিয়ে আমি মোটেও শংকিত নই, আমি শংকিত তাদের নিজেদের কোন আইডিয়া নেই এই ভেবে। "এই না হলেন টেসলা, সত্যিকারেরই একজন প্রবাদ পুরুষ।

আসলে টেসলা কোনদিনই নাম যশের পিছনে দৌড়াননি। বেতার বা বিদ্যুতের সুবিধাগুলো মানুষ পাচ্ছে এই ভেবেই হয়তো তিনি খুশি থাকতেন। টেসলা যদি ব্যবসা করতে চাইতেন তবে তিনি তার সময়ে সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের একজন হতে পারতেন। কারণ যুগের তুলনায় আধুনিক প্রযুক্তির দাম কত এ যুগের মানুষ হিসেবে আপনি নিশ্চয়ই সেটা বুঝবেন। আর টেসলার আবিস্কৃত প্রযুক্তি গুলো ছিল তার যুগ থেকেও এগিয়ে।

এবার কিছু চমকপ্রদ বিষয় নিয়ে আলোচনা করি।

এসব অসাধ্য কাজগুলো তিনি সহজেই করে ফেলেছিলেন, কারণ তিনি যে নিকোলা টেসলা। একবার তিনি বেশ বড় আকারের টেসলা কয়েল ব্যবহার করে প্রায় ১৩০ ফুট দৈর্ঘ্যের বৈদ্যুতিক রশ্মি তৈরিতে সক্ষম হন। তার উপর আবার নিউইয়র্কে সৃষ্টি করেছিলেন রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার এক ভূমিকম্প। এর তীব্রতা এত বেশি ছিল যে নিউইয়র্কের ফিফথ এভিনিউ পুরোপুরি ধসে গিয়েছিল। টেসলা একবার বলেছিলেন যে, "আমি এমন একটি ভুমিকম্প তৈরি করতে সক্ষম যা পুরো পৃথিবীকে দুই ভাগ করে দিতে পারে। "টেসলা অবশ্য এর প্রমাণ ও দিয়েছেন। তবে এত বড় করে না হলেও নিউইয়র্কে সৃষ্ট ভুমিকম্পের ঘটনা থেকে তার কথাটি আরও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে।

১৯৩৫ সালে আবিষ্কৃত হয় রাডার।

আবিষ্কারকের নাম রবার্ট ওয়াটসন। কিন্তু এর ও অনেক আগে ১৯১৭ সালেই টেসলা এই প্রযুক্তিটির থিওরি দিয়ে যান। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দরুন তিনি এই আবিষ্কারও দেখাতে পারেননি। তবে ইউএস নেভির জন্য তিনি তা প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু তাকে প্রত্যাখ্যাত হতে হয়। কারণ সেই এডিসনই। কারণ এডিসন তখন ইউ এস নেভির রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট এর প্রধান ছিলেন। সুতরাং টেসলার প্রত্যাখ্যাত হওয়া তাই স্বাভাবিকই ছিল। আজকের দিনের আধুনিক প্রযুক্তিগুলোতে যে ট্রানজিস্টর ব্যবহার করা হয় তার ও উদ্ভাবক ছিলেন সেই টেসলাই। কিন্তু সময়ের আগেই তার চাহিদা মেটাতে গিয়ে বরাবরই আড়ালেই থেকে যান এই মহান মানুষটি।

১৮৯৪ সালে অদৃশ্য তরঙ্গ নিয়ে কাজ শুরু করেন টেসলা।

তবে তার কোন প্যাটেন্ট নেন নি। উইলিয়াম রন্টজেন যে তরঙ্গের নাম দেন এক্স-রে বা অজানা রশ্মি সেটিই প্রথম আবিস্কার করেন টেসলা। কিন্তু ১৮৯৫ সালে অগ্নিকাণ্ডে তার ল্যাবের প্রায় সবকিছুই পুড়ে গিয়েছিল। ফলে এক্স-রে সংক্রান্ত গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করতে পারেন নি টেসলা। অবশ্য রন্টজেন টেসলাকেই স্বীকৃতি দেন। টেসলা এই অদৃশ্য তরঙ্গকে ভয়ংকর বলে বর্ণনা করেন। কারণ এক্স-রে বলতে যা বুঝায় সেই অদৃশ্য-অজানা তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্যে ছিল খুব কম। ফলে এটি ছিল খুবই শক্তিশালী এক তরঙ্গ। টেসলা অনুরোধ করেন এমন ভয়ংকর রশ্মি যেন মেডিকেলে ব্যবহার করা না হয়। কিন্তু এডিসন টেসলার কথাকে পাত্তা দেননি। তিনি তার এক কর্মচারীর উপর এটি এত বেশি পরিমাণে ব্যবহার করেন যে লোকটি পরে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। টেসলার ভবিষদ্বানীই পরে সত্য প্রমাণিত হয়। তাছাড়া ভ্যাকুয়াম টিউব, রোটারি ইঞ্জিন, লাউডস্পিকার, তারবিহীন যোগাযোগ ব্যবস্থা সহ আধুনিক প্রায় সব প্রযুক্তির পিছনেই অবদান ছিল বিস্ময়কর প্রতিভাবান এই মানুষেটির।

তার ছিল ফটোগ্রাফিক মেমোরি ফলে ম্যাজিকের মতো অনবদ্য সব আইডিয়া নিয়ে আসতে খুব একটা বেগ পেতে হতো না তাকে। তার কল্পনা শক্তি ছিল অবিশ্বাস্য। মনের মধ্যে হাজার হাজার ডিজাইন তৈরি করে ফেলতেন তিনি। মনে মনে সমাধান করে ফেলতেন ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাস মতো জটিল সব গণি। তদুপরি তিনি ছিলেন অত্যন্ত পরিশ্রমি। ল্যাবে ১৮ ঘণ্টা দৈনিক কাজ করতেন। শুনা যায় একবার নাকি একটানা ৮৪ ঘন্টাই ল্যাবে কাটিয়ে দেন তিনি। তার মেধা আর পরিশ্রমই তাকে বিস্ময়কর সব আবিষ্কার করতে দারুণ ভাবে সাহায্য করে

সালটা ১৮৯৮। এই সালটা বিজ্ঞানের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে নানা কারণে। তখন যে অতি ক্ষুদ্র আর অতি বৃহৎ বস্তু নিয়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণা তুঙ্গে। এই সময়ে টেসলাও এক বিস্ময়কর আবিষ্কার সকলের সামনে নিয়ে আসলেন। পৃথিবীর মানুষকে প্রথম দেখালেন দুর থেকেও কোন কিছু নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এটাই ছিল পৃথিবীর প্রথম রিমোট কন্ট্রোল প্রযুক্তি। তবে এর সাথে আরও কয়েকটি আবিষ্কার পেয়ে যায় মানবজাতি। তিনি দেখিয়েছিলেন রিমোট চালিত একটি নৌকা। যাকে স্পর্শ ছাড়াই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এর মধ্যেই নিহিত ছিল আধুনিক গাইডেড মিসাইল সিস্টেম আর রোবট প্রযুক্তির  দারুন এক মিশ্রন। একের ভিতর তিন যাকে বলে। তিনি যে টেসলা তাই একের ভিতর তিন তার কাছেতো সাধারণই বটে। এই অভিনব প্রযুক্তির মূল্য আজ ঠিকই বুঝছে সারা বিশ্ব। তাছাড়া ১৯২৮ সালে উলম্ব বরাবর উড়তে পারে এমন একটা প্লেন ও তৈরি করেন টেসলা। এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন টেসলা কেমন জিনিয়াস ছিলেন। ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে তাই তার সমকক্ষ কেউ নেই। এই প্রযুক্তিটির প্যাটেন্টই ছিল এই মহান সাধকের সর্বশেষ কোন অফিসিয়াল স্বীকৃতি।

শেষ জীবনে তিনি সাধারণ মানুষের কাছে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ পৌছানোর একটা কাজ শুরু করেন। তিনি চেয়েছিলেন সাধারণ মানুষ বিনামূল্যে বিদ্যুৎ সুবিধা পাক। সে জন্য তিনি একটি বিশাল টাওয়ার ও নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। এর বাস্তবায়নের জন্য তিনি অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের সাথে আলোচনাও করেন। কিন্তু এতে কোন ফল হয়নি। উল্টো এ নিয়ে ব্যক্তিগত ভাবে কাজ করতে গিয়ে পুঁজিবাদীদের রোষানলে পড়তে হয় তাকে। শেষ দিকে এই নিয়ে তাকে অনেক বিড়ম্বনার মধ্যেও পড়তে হয়। সাধারণ মানুষের জন্য তিনি অনেক কিছুই করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্বার্থান্বেষী মহলের ব্যাবসায়িক কূটকৌশল তার এসব পরিকল্পনাকে বাস্তবে রুপ দিতে দেয় নি।

কিন্তু শেষ ঘটনা গুলো আরও হৃদয়বিদারক।

১৯৪৩ সালের ৬ ই জানুয়ারি নিউইয়র্কের একটি হোটেল-রুমে সম্পুর্ন নিঃস্ব অবস্থায় মারা বিজ্ঞানের এই একনিষ্ঠ সাধক। তার মৃত্যুর পর পরই তৎকালীন এফ বি আই প্রধান এডগার জে হুভার আরও কিছু সদস্যদের সাথে নিয়ে টেসলার হোটেল রুমে হামলা চালায়। ফলে টেসলার সব গবেষণা পত্রই চলে যায় এফ বি আইয়ের হাতে। অনেক ষড়যন্ত্র তত্ত্ব মতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার পিছনেও ছিল টেসলার এসব গবেষণাপত্র গুলো। তিনি যেহেতু সব সময় বিস্ময়কর সব আইডিয়া নিয়ে আসতেন তাই তার অপ্রকাশিত আইডিয়া গুলোর যে গবেষণা পত্র ছিল তা তো আর এমনি এমনি পড়ে থাকেনি। আর এফ বি আই তা পেয়েছে মানে তো তার আইডিয়া গুলোর পরীক্ষা অবশ্যই হয়েছে। হয়তো আধুনিক অনেক প্রযুক্তিরই আইডিয়া টেসলা দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সেই আড়ালেই থেকে গেলেন।

তিনি ছিলেন এক বিস্ময় পুরুষ।

তার মৃত্যুর ৭ যুগ পরেও তারবিহীন বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা নিয়ে বিজ্ঞানীরা আমতা আমতা করছেন। এখনও তারা হচ্ছে হবে বলছেন। কিন্তু আজ থেকে ১১৮ বছর আগে এমন আইডিয়া রীতিমতো হেসেখেলে দিয়েছিলেন টেসলা। সুযোগ পেলে তার বাস্তবায়ন ছিল তখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র। আজও টেসলার গবেষণা গুলো অবিশ্বাস্য ভাবে শিহরিত করে হাজারো বিজ্ঞান প্রেমিদের। তিনি এতই অগ্রবর্তী চিন্তা করতেন যে শত বর্ষ আগেও তিনি "thought camera" তৈরি করতে চেয়েছিলেন। অর্থাৎ কেউ যাই চিন্তা করবে তারই একটি প্রতিবিম্ব পাওয়া যাবে। এই আধুনিক যুগে এসেও যা অবিশ্বাস্য লাগে টেসলা শত বছর পূর্বেই তার আইডিয়া দিয়ে গেলেন।

মৃত্যুর আগে অন্তত ৩০০ টি প্যাটেন্ট ছিল তার। এত এত অবাক করা আবিষ্কার যিনি করতে পেরেছিলেন তিনি সুযোগ পেলে আরও কত কিনা দিয়ে যেতেন। হয়তো বা শক্তি ও কম্পন নিয়ে মানবজাতিকে আরও অনেক কিছু দিয়ে যেতেন। কল্প বিজ্ঞানের লেখকেরাও যা চিন্তা করতে পারেন না টেসলা তার ও আগে তার বাস্তবায়ন শুরু করে দিতেন। একজন বিজ্ঞান মনস্ক ব্যক্তি হিসেবে আপনি যদি তার সমীকরণ গুলোর দিকে তাকান তবেই বুঝতে পারবেন তার চিন্তার গভীরতা আর পরিধি কত ব্যাপক ছিল।

সবশেষে বলতে হয় টেসলা আসলে টেসলাই।

তার মতো আরেকজন কে পেতে মানব জাতিকে আর কত বছর অপেক্ষা করতে হবে জানিনা। যে কোন বিষয় নিয়ে তার চিন্তা ভাবনা ছিল অনেক আধুনিক। সৃষ্টিকর্তা তাকে বিস্ময়কর এক কল্পনা শক্তি দান করেছিলেন। ফলে হাজার হাজার ডিজাইন মানসপটে একে ফেলতেন তিনি। বাস্তবে  কোন কিছু না দেখেও তার অনুমান করার মতো আশ্চর্যজনক ও বিস্ময়কর এক ক্ষমতা ছিল তার মধ্যে। অথচ আমরা তাকে হেলায় হারিয়েছি। আজ শত বছর পর ও তাই এই মহান সাধকের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা হাজারো বিজ্ঞান প্রেমিদের। ভালো থেকো হে মহান সাধক।
বিঃদ্রঃ লেখাটি ২ বছর আগে লিখেছিলাম এবং একটি ব্লগে প্রকাশ করে ছিলাম। যেহেতু আমার প্রোফাইল এ তার ছবি যোগ করেছি তাই তার সম্পর্কে কিঞ্চিৎ আলোচনা করা সমীচীন মনে করেছি। ধন্যবাদ

Level 0

আমি সজল মিয়া। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 1 বছর 6 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 1 টি টিউন ও 0 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস