মহাবিশ্বের হিমঘর থেকে জেগে ওঠা ৫টি প্রাচীন ভাইরাস!
এই বিশাল মহাবিশ্বটা যেন এক রহস্যের সিন্ধুক। এর গভীর থেকে মাঝে মাঝেই এমন সব জিনিস উঠে আসে, যা আমাদের কল্পনাকেও হার মানায়। আমরা মহাকাশে এলিয়েন বা ভিনগ্রহের প্রাণী খুঁজে বেড়াই, কিন্তু আমাদের পায়ের নিচেই, বরফের হাজার হাজার ফুট গভীরে ঘুমিয়ে আছে এমন সব অণুজীব, যা পৃথিবীর ইতিহাস বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি বরফায়িত মাটি (Permafrost) খুঁড়ে এমন কিছু প্রাচীন ভাইরাসের সন্ধান পেয়েছেন, যেগুলো হাজার হাজার বছর ঘুমিয়ে থাকার পর আবারও জেগে উঠছে। চলুন, পরিচিত হওয়া যাক এমনই ৫টি ভয়ঙ্কর ভাইরাসের সাথে।
১. পিথোভাইরাস সাইবেরিকাম (Pithovirus sibericum)

এই ভাইরাসটিকে বলা হয় 'দৈত্য ভাইরাস'-দের একজন। কারণ এর আকার সাধারণ ভাইরাসের চেয়ে বহুগুণে বড়, প্রায় একটি ব্যাকটেরিয়ার সমান!
- নাম: পিথোভাইরাস সাইবেরিকাম (Pithovirus sibericum)
- আবিষ্কার: ফরাসি বিজ্ঞানী জ্যাঁ-মিশেল ক্লাভেরি ও তার দল ২০১৪ সালে এটি আবিষ্কার করেন। সাইবেরিয়ার কোলিমা নদীর তীরে বরফের প্রায় ১০০ ফুট নিচ থেকে এর নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
- বয়স: এটি প্রায় ৩০, ০০০ বছরের পুরনো! অর্থাৎ, নিয়ান্ডারথাল মানুষ যখন পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল, সেই সময়ের ভাইরাস এটি।
- কতটা ভয়ানক: সৌভাগ্যবশত, এই ভাইরাসটি মানুষকে আক্রমণ করে না; এর শিকার হলো অ্যামিবা (Amoeba)। কিন্তু চিন্তার বিষয় হলো, যদি ৩০, ০০০ বছর পুরনো একটি ভাইরাস বরফের নিচে টিকে থেকে আবারও সক্রিয় হতে পারে, তাহলে এমন কোনো ভাইরাসও তো জেগে উঠতে পারে যা মানুষের জন্য প্রাণঘাতী!
২. প্যান্ডোরাভাইরাস ইয়েদোমা (Pandoravirus yedoma)

নামটা শুনলেই কেমন একটা রহস্যময় অনুভূতি হয়, তাই না? এর ক্ষমতাও তেমনই বিস্ময়কর। এটি এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া সবচেয়ে পুরনো পুনরুজ্জীবিত ভাইরাস।
- নাম: প্যান্ডোরাভাইরাস ইয়েদোমা (Pandoravirus yedoma)
- আবিষ্কার: জ্যাঁ-মিশেল ক্লাভেরির গবেষক দল ২০২২ সালে এই আবিষ্কারের কথা জানান। সাইবেরিয়ার ইয়াকুতিয়া অঞ্চলের একটি হ্রদের তলদেশের পারমাফ্রস্ট থেকে এটি পাওয়া যায়।
- বয়স: অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, এটি প্রায় ৪৮, ৫০০ বছরের পুরনো!
- কতটা ভয়ানক: এটিও একটি 'জায়ান্ট ভাইরাস' এবং এটিও অ্যামিবাকে আক্রমণ করে। এর ভয়ঙ্কর দিক হলো এর টিকে থাকার ক্ষমতা। প্রায় অর্ধ লক্ষ বছর বরফের নিচে থেকেও এটি নিজের কার্যকারিতা হারায়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেভাবে বরফ গলছে, তাতে এমন আরও কত অজানা ভাইরাস পরিবেশে ছড়িয়ে পড়বে, তা নিয়েই বিজ্ঞানীরা চিন্তিত।
৩. মলিভাইরাস সাইবেরিকাম (Mollivirus sibericum)

পিথোভাইরাসের সাথেই একই নমুনা থেকে এই গোলাকার ভাইরাসটিকেও খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল।
- নাম: মলিভাইরাস সাইবেরিকাম (Mollivirus sibericum)
- আবিষ্কার: ২০১৫ সালে, পিথোভাইরাসের আবিষ্কারক командаই এটি শনাক্ত করে।
- বয়স: এটিও প্রায় ৩০, ০০০ বছরের পুরনো।
- কতটা ভয়ানক: এর জেনেটিক গঠন আধুনিক ভাইরাসদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এটিও অ্যামিবাকেই সংক্রামিত করে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, এর মতো সম্পূর্ণ নতুন ধরনের ভাইরাস যদি মানবদেহে প্রবেশ করার ক্ষমতা অর্জন করে, তবে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা তাকে চিনতেই পারবে না।
৪. মেগাভাইরাস ম্যামুট (Megavirus mamut)

এই ভাইরাসটি একটি ম্যামথের দেহাবশেষের সাথে পাওয়া গিয়েছিল, যা এর নামকরণকে সার্থক করে তুলেছে।
- নাম: মেগাভাইরাস ম্যামুট (Megavirus mamut)
- আবিষ্কার: ক্লাভেরির দলই সাইবেরিয়ায় খুঁজে পাওয়া ম্যামথের পশম এবং অন্ত্রের নমুনা থেকে এটি পুনরুদ্ধার করে।
- বয়স: এটি প্রায় ২৭, ০০০ বছরের প্রাচীন।
- কতটা ভয়ানক: এটি প্রমাণ করে যে প্রাচীন প্রাণীদের দেহাবশেষের ভেতরেও ভাইরাস হাজার হাজার বছর ধরে টিকে থাকতে পারে। যদি কোনো প্রাচীন মানুষের দেহাবশেষ থেকে গুটিবসন্তের মতো কোনো ভয়ঙ্কর ভাইরাস জেগে ওঠে, তাহলে পরিস্থিতি কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
৫. উলকেনস্টক উলফ লেক ভাইরাস (Wolkenstock Wolf Lake Virus)
শুধু সাইবেরিয়া নয়, পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তের বরফের নিচ থেকেও মিলছে এমন প্রাচীন ভাইরাস।
- নাম: উলকেনস্টক উলফ লেক ভাইরাস (Wolkenstock Wolf Lake Virus)
- আবিষ্কার: ২০১৯ সালে তিব্বত মালভূমির বরফের একটি কোর (Ice Core) বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা এটি খুঁজে পান।
- বয়স: এটি প্রায় ১৫, ০০০ বছরের পুরনো। এই বরফের কোরে বিজ্ঞানীরা মোট ৩৩টি ভাইরাসের সন্ধান পান, যার মধ্যে ২৮টিই ছিল বিজ্ঞানের কাছে সম্পূর্ণ নতুন!
- কতটা ভয়ানক: এই আবিষ্কারটি দেখায় যে পৃথিবীর যেকোনো বরফাচ্ছাদিত অঞ্চলেই এমন অজানা বিপদ লুকিয়ে থাকতে পারে। এই ভাইরাসগুলো আধুনিক বাস্তুতন্ত্রে প্রবেশ করলে তার ফলাফল কী হবে, তা এখনো আমাদের অজানা।
শেষ কথা
এই প্রাচীন ভাইরাসগুলো আপাতত মানুষের জন্য সরাসরি হুমকি না হলেও এগুলো আমাদের জন্য একটি বড় সতর্কবার্তা। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে যেভাবে দুই মেরু এবং অন্যান্য অঞ্চলের বরফ গলে যাচ্ছে, তাতে হাজার হাজার বছর ধরে ঘুমিয়ে থাকা এমন আরও অসংখ্য অজানা ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া পরিবেশে মুক্ত হয়ে যেতে পারে। তখন হয়তো এমন কোনো মহামারির মুখোমুখি হতে হবে, যার জন্য আধুনিক বিজ্ঞান প্রস্তুত নয়। প্রকৃতি তার গর্ভে কত রহস্য লুকিয়ে রেখেছে, তা আমরা হয়তো কোনোদিনই পুরোপুরি জানতে পারব না।